Robbar

বিজ্ঞাপনে উপার্জনক্ষম পাত্রীর খোঁজ পাওয়া যায় ১৯৫০ সাল থেকেই

Published by: Robbar Digital
  • Posted:September 24, 2025 8:15 pm
  • Updated:September 25, 2025 7:09 pm  
Matrimony advertisement and working women

সে সময়ে বিয়ের বাজারে চাকরিরতাদের বিশেষ চাহিদা-জোগান না থাকলেও তেমন বিজ্ঞাপন যে একেবারেই চোখে পড়ে না তা নয়, বিশেষত ১৯৪৯-এর পরে। ১৯৫০-এর ৯ জুলাই যুগান্তরে দেখি, ২৭ বছর বয়সি সরকারি চাকুরে, এমএ পাশ, ব্যানার্জী পদবীর পাত্র চান ‘ধনী উপার্জনক্ষমা পাত্রী’।  ওই বছরের ১৩ আগস্ট একই খবরের কাগজে দেখি– ‘পূর্ববঙ্গীয় আই-এ পাশ মধ্যমা সুন্দরী (২১) গভর্নমেন্ট চাকুরিয়া পাত্রীর জন্য কমপক্ষে আই-এ পাশ পাত্র চাই। নগদ টাকা ও উপযুক্ত যৌতুক দিতে প্রস্তুত।’ পরের বছর ২৮ জানুয়ারির যুগান্তরে দেখি, এক ইঞ্জিনিয়ার পাত্রের ‘চাকুরে পাত্রীও চলিবে।’ ২২ জুন ১৯৫৮-র আনন্দবাজার পত্রিকায় দেখছি মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বার্ষিক ছাত্রী– সুশ্রী সুন্দরী স্বাস্থ্যবতী (২০) বাৎস্য গোত্রীয়া বারেন্দ্র পাত্রীর জন্য ডাক্তার পাত্র চাই। বিবাহান্তে পাঠে আপত্তি না থাকা বাঞ্ছনীয়।’ সে দিনের কাগজেই দু’টি বিজ্ঞাপনে চাওয়া হয়েছে ‘সুন্দরী উপার্জনশীলা’ পাত্রী। সেদিন গোটা পাতায় দু’টি হলেও এমন বিজ্ঞাপনের সংখ্যা আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। 

অন্বেষা সেনগুপ্ত

সীমন্তিনী মুখোপাধ্যায়

সুপূর্ণা ব্যানার্জি

২৬.

সম্ভ্রান্ত, দক্ষিণরাঢ়ী, কায়স্থ, বসু পরিবারের ম্যাট্রিকপ্লাকড (২২), ফরসা, খুব সুশ্রী পাত্রীর জন্য ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার বা চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট পাত্র চাই– যৌতুক ২৫০০০ ভিন্ন পাত্রী পিতার কলিকাতার সম্পত্তির অংশ একখানা ভাল বাড়িও পাইবেন। 

আনন্দবাজার পত্রিকা-র পাত্রপাত্রী কলামের এই বিজ্ঞাপনটি ১৯৫৮ সালের ১৬ জুনের। সে সময়ের খবরের কাগজ দেখলেই জানা যায়– যৌতুক বা পণ নিয়ে তেমন রাখঢাক ছিল না কোনও পক্ষের। পাঁচ হাজার, আট হাজার, বা পঁচিশ হাজার, কখনও নির্দিষ্ট দর হেঁকেছেন পাত্রীপক্ষ। কখনও লিখেছেনপ্রচুর যৌতুক তবে পাত্রসন্ধানী বেশিরভাগ বিজ্ঞাপনেই লেখা থাকত, ‘যৌতুক পাত্রানুযায়ী রেডিওআর্টিস্ট পাত্রীরযৌতুক দিতে অক্ষম পিতাতাঁর অপারগতাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন বিজ্ঞাপনে (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৮ এপ্রিল, ১৯৫৮) কাগজে পাত্রপাত্রী কলামে যেদিন এমন অনেক বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছে, তেমনই একদিন পাশের পাতায় রবিবাসরীয় বিভাগে পাই যোগেন্দ্রনাথ রায়েরগরমিলগল্পটি (আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৫ জুন, ১৯৫৮) গল্পের নায়ক সুরঞ্জন বিয়ের অনেক আগেই মাকে দিয়ে কবুল করিয়ে নিয়েছে, যৌতুক নেওয়া হবে না তার বিয়েতে।অত্যন্ত গরিব অবস্থা থেকে আপনার পায়ে দাঁড়িয়েছে সুরঞ্জন। শ্বশুরের দান গ্রহণ করে ছোট করবে না নিজেকে।প্রশ্ন জাগে, যাঁরা কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে পণ দেওয়া নেওয়া করতেন, তাঁরা বাকি কাগজটি পড়তেন কি না। যেমন আরেক রবিবার, ‘নারীর কথাবিভাগে শ্রীমতী রাধা মিত্র পণপ্রথা সম্পর্কে লিখছেন, ‘স্বাধীনতা লাভের দশ বছর পরেও এমন একটি কুপ্রথা চলিত রয়েছে, মেয়েদের পক্ষে এটা ঘোরতর অপমানকর‘ (আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৬ মার্চ ১৯৫৮)

১৯৫২ সালের বাংলা ছবি

পাত্রের গুণাবলির মধ্যে প্রধান তাঁর রোজগার, পারিবারিক প্রতিপত্তি এবংনির্ঝঞ্ঝাট সংসার বন্ধনীর মধ্যে বেতনের অঙ্ক লিখে দেওয়ার দস্তুরও ছিল। পাত্রের চেহারা কী রকম, তা নিয়ে বাক্যব্যয় করতেন না প্রায় কেউই। অন্য দিকে ভালো পাত্রী মানেই সুন্দরী, স্বাস্থ্যবতী, গৃহকর্মে নিপুণা। কোনও কোনও পাত্রপক্ষ আবার অল্পেতে খুশি নন– তাঁরা লিখেই দিয়েছেন, ‘পরমাসুন্দরী গৌরবর্ণাপাত্রী চাই। পাত্রীপক্ষও বিজ্ঞাপনে কম যাননি, পাত্রীর বিবরণে লিখেছেন, ‘অতীব সুন্দরী, দীর্ঘাঙ্গী…’, ‘ট্ল, স্লিম, গৌরবর্ণা, প্রকৃত সুন্দরী…’, ‘অসামান্যা সুন্দরী, দুধেআলতা রং…’, ‘এইরূপ নিখুঁত সুন্দরী পাত্রী বিরল‘… তবে সে সময়ের কাগজে স্পষ্ট, সেই পরমাসুন্দরীশিক্ষিতাবামধ্যম শিক্ষিতা‘, যা হন না কেন, গৃহকর্মনিপুণা, নম্রস্বভাবা না হলে তাঁর বিয়ে হওয়া মুশকিল। একটি বিজ্ঞাপনে আবারদরিদ্রা সদ্বংশজাতা সুশ্রী পাত্রীচাওয়া হয়েছে (আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৬ মার্চ ১৯৫৮) 

নরেন্দ্রনাথ মিত্রেরদূরভাষিণীউপন্যাসে মৃন্ময় যেমন বলে, ‘বউও যদি চাকরিতে বের হয়, সারাদিন বাইরে থাকে, তাহলে ঘর গুছোয় কে? এদিক থেকে আমি একটু সেকেলে। আমরা কেরানিগিরি করি ক্ষতি নেই। কিন্তু ঘরে যে আসবে সে রানী হয়ে থাকবে। দেখতে মোটামুটি সুন্দর হবে। যাতে শাঁখাসিঁদুর পরলে বেশ মানায়। জানেন তো, সুন্দর না হলে সিঁদুরে মানায় না।’

যৌতুক পট। শিল্পী: জবা চিত্রকর

বয়স বেশি হলেও বিয়ের বাজারে মেয়েদের দর কমে যেত। সেন্সাস বা জাতীয় নমুনা সমীক্ষায় সে যুগে অবিবাহিতা মেয়েদের বয়স কমিয়ে বলার রেওয়াজের কথা লিখেছেন অশোক মিত্র, প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবিশ। ১৫ জুন, ১৯৫৮ আনন্দবাজার পত্রিকায়নারীর কথাকলামে কুন্তলা ভট্টাচার্য লিখেছেন মেয়েদের ঘরোয়া আড্ডায়পাড়া পড়শীর মেয়েবউদের বয়স নিয়ে ঝুড়ি ঝুড়ি মুখরোচক কথায় সবাই বেশ মশগুল হয়ে থাকেন।সম্ভবত নতুন বউয়ের বয়স কম রাখতেই এক বিএসসি উদারহৃদয় পাত্রডাক্তারি পড়িতে ইচ্ছুক সুন্দরী স্বাস্থ্যবতী মেধাবী পাত্রীচাইছেন। লিখছেন, ‘পাত্রীকে পড়িবার জন্য সর্বপ্রকার সুযোগ সাহায্য দেওয়া হইবে‘ ( আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৪ এপ্রিল, ১৯৫৮)  এমন স্কলারশিপ না দিয়ে সরাসরি ডাক্তার পাত্রী চাইলে হয়তো বউয়ের বয়স নিয়ে খুঁতখুঁতানি থেকে যেত।

ছবিটি প্রতীকী

সে সময়ে বিয়ের বাজারে চাকরিরতাদের বিশেষ চাহিদাজোগান না থাকলেও তেমন বিজ্ঞাপন যে একেবারেই চোখে পড়ে না তা নয়, বিশেষত ১৯৪৯এর পরে। ১৯৫০এর জুলাই যুগান্তরে দেখি, ২৭ বছর বয়সি সরকারি চাকুরে, এমএ পাশ, ব্যানার্জী পদবীর পাত্র চানধনী উপার্জনক্ষমা পাত্রী  ওই বছরের ১৩ আগস্ট একই খবরের কাগজে দেখি–পূর্ববঙ্গীয় আই পাশ মধ্যমা সুন্দরী (২১) গভর্নমেন্ট চাকুরিয়া পাত্রীর জন্য কমপক্ষে আই পাশ পাত্র চাই। নগদ টাকা উপযুক্ত যৌতুক দিতে প্রস্তুত।পরের বছর ২৮ জানুয়ারির যুগান্তরে দেখি, এক ইঞ্জিনিয়র পাত্রেরচাকুরে পাত্রীও চলিবে।২২ জুন, ১৯৫৮ আনন্দবাজার পত্রিকায় দেখছি– মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বার্ষিক ছাত্রী– সুশ্রী সুন্দরী স্বাস্থ্যবতী (২০) বাৎস্য গোত্রীয়া বারেন্দ্র পাত্রীর জন্য ডাক্তার পাত্র চাই। বিবাহান্তে পাঠে আপত্তি না থাকা বাঞ্ছনীয়।সে দিনের কাগজেই দু’টি বিজ্ঞাপনে চাওয়া হয়েছেসুন্দরী উপার্জনশীলাপাত্রী। সেদিন গোটা পাতায় দুটি হলেও এমন বিজ্ঞাপনের সংখ্যা আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। 

রোচনা মজুমদার তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, বিশ শতকের গোড়াতেই শহুরে সমাজে ছাপার অক্ষরে বিয়ের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমেবিয়ের বাজারনির্মিত হয়। বাড়তে থাকে পণের চাহিদা। পুরুষের শিক্ষা এবং পেশার বাজারদর স্থির হয় বিয়ের বাজারে। আগের প্রজন্মের পুরুষরা বিয়ের মাধ্যমে সামাজিক সম্মান বাড়াতে চাইতেন। বিশ শতকের পুরুষ চাইতেন টাকা। অনেকগুলো বিয়ে করে আগেকার কুলীনরা যা আদায় করতেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় পাশ দেওয়া নব্যকুলীনেরা একটি বিয়ে থেকেই তা উসুল করে নিতেন।

 

আমরা এই কাজটির সূত্রে সেই সময়ের যেসব চাকরিরতার সঙ্গে কথা বলেছি, তাঁরা অনেকেই নিজেদের পছন্দে বিয়ে করেছেন। ১৯৪৭এর জুলাই যুগান্তরে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে দেখছি, ‘স্বল্প ব্যয়ে স্বল্পতর হাঙ্গামায় নিষ্পন্ন হয়বলে অনেক তরুণতরুণীই সিভিল ম্যারেজ অ্যাক্টে বিবাহের দিকে ঝুঁকছিলেন। সম্বন্ধ দেখে বিয়ে হয় পেশায় নার্স উদ্বাস্তু পরিবারের মেয়ে অঞ্জলি আচার্যের। তিনি আমাদের বলেন তিনিগৌরবর্ণা, প্রকৃত সুন্দরীনা হওয়ায় তাঁর পাত্র জোটা কঠিন ছিল। তাঁর এক জা ছিলেন, যাঁর গায়ের রং কালো। উঠতে বসতে শ্বশুরবাড়ির লোকেরা গায়ের রং নিয়ে খোঁটা দিতেন তাঁকে। অঞ্জলিকে দেখে তিনি ভাবলেন, একে বউ করে ঘরে নিয়ে গেলে আর খোঁটা শুনতে হবে না। হবুশাশুড়ি অবশ্য সহায়সম্বলহীন অবস্থা থেকে নিজের জেদে নার্সিং পাশ করে চাকরি করা একামেয়েটিকে দেখেই বলেন, ‘ মেয়ের দায়িত্ববোধ আছে। সংসারে এমন মেয়েই চাই।’ 

২২ জুন, ১৯৫৮-র আনন্দবাজারে পাত্র চাওয়া হয়েছে ত্রিশ বৎসর বয়সি গৃহকর্মনিপুণা সুশ্রী স্বাস্থ্যবতী বৈদ্য স্কুলশিক্ষয়িত্রীর জন্য। জানানো হয়েছে, পাত্রীপক্ষ যৌতুক দিতে অক্ষম। নিজস্ব ব্যবসা চালাতেন অশীতিপর অঞ্জলি হালদার। তিনি আমাদের বলছিলেন, তাঁর স্কুলশিক্ষিকা বান্ধবী শুক্লার কথা। পাত্রপক্ষ তাঁকে দেখতে এসে বলেছিলেন, একটি রবীন্দ্রসংগীত বা নজরুলগীতি গেয়ে শোনাতে। পঁচিশ বছরের শুক্লা বলেছিলেন, ‘নিয়ে গিয়ে রাঁধাবেন তো মশাই আপিসের ভাত। এখন এত রবীন্দ্রনজরুল আউড়ে কী হবে?’ বলাই বাহুল্য, সে বিয়ে হয়নি। শুক্লা যথাসময়ে তাঁর পছন্দের পাত্রকেই বিয়ে করেন। আপিসের ভাত রেঁধে ইশকুলে ছোটেন আজীবন।

তথ্যসূত্র

  1. Mitra. Report, Part 1A, Volume VI – Census 1951.

P.C. Mahalanobis. A technical note on age grouping, The National Sample Survey, Number 12, 1958

Rochona Majumdar. Marriage and Modernity: Family Values in Colonial Bengal. Durham: Duke University Press, 2009.