ঠিক কী আমি বলতে চাইছি মহাশ্বেতার সর্বজন পরিচিত জীবন নিয়ে এইসব টুকরো টুকরো কথা উল্লেখ করে? হয়তো এই অসামান্য লেখককে নিয়ে নিজের অকূল বিহ্বলতার কথা। একজন মানুষ কী করে একই সঙ্গে নিজকে এভাবে রাখতে পারেন লেখায়, অধ্যয়নে ও চর্যায়? অনেক বছর কাছ থেকে দেখে দেখে মনে হয়েছে মহাশ্বেতা দেবীর সমস্ত শক্তির, অকল্পনীয় উদ্যম আর ক্ষমতার মূলে ছিল তাঁর ভালোবাসার ক্ষমতা। কবে থেকে শুরু হয়েছিল, জানি না। একেবারে বালিকা বয়সে নিজের ছোট ভাইবোনদের পালন করার মধ্য দিয়ে?
বালিগঞ্জ স্টেশন রোড। মৌচাকের দিক থেকে খানিক অলিগলি এসে ডান হাতে নিচু দেওয়াল ঘেরা কম্পাউন্ডের মধ্যে একখানা পুরনো বাড়ি। এটা তার পিছন দিক। দোতলায় থাকেন। সিঁড়ি নেই ওঠার। একটা পাছ-দরজার লোহার ঘোরানো সিঁড়ি, তার মাথায় দরজা। সেই সিঁড়ির রেলিঙের মাঝপথে আবার আরেকটা ঘরের দরজা, কিন্তু ঢোকার পথ নেই, ভেতরটা দেখা যায় কেবল।
সঙ্গে যিনি এসেছিলেন দেখিয়ে দেওয়ার জন্য, তিনি ভেতরে এলেন না। গেট থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, ‘ভয়ানক রাগী। খুব মুখ খারাপ করেন, কোনও মানামানি নেই। আপনি যান, তবে সাবধানে। আমি এখানে রইলাম।’ খাস কলকাতার লোকের এহেন সাবধানবাণীর পর, স্বভাবতই ভয়ে ভয়ে, সিঁড়ি দিয়ে উঠলাম। ছোট একটা ঘর, খালি। বাঁদিকের দরজার ভেতর থেকে আওয়াজ এল–
–কে?
–আমি। মানে…
–আমি আবার কী? আমিটা কে?
কুঁইকুঁই করে নিজের নামটা কোনও রকমে।
–কী!
বেরিয়ে এসেছেন। দু’হাতে একেবারে বুকে জড়িয়ে ধরা। ‘তুই? কী লিখেছিস! কী করে লিখেছিস? আয় আয়!’ টেনে ভেতরের ঘরে।
আধখানা ঘরজোড়া সেই বিখ্যাত লেখার টেবিল আর বাকিটুকুতে একটা যেমন-তেমন বিছানা। তার পিছনে জানলা আড়াল করে আরও বই-কাগজ-ফাইল। খবরের কাগজের কাটিং। আদরে-স্নেহে অভিভূত আধঘণ্টা পর যখন সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম, তার আগেই কথা হয়েছে এরপরে কলকাতা এলে অবশ্যই আসব এখানে। সারাদিনের জন্য। কথা বলব কী? চোখের সামনে ‘ঝাঁসির রাণী’, ‘অরণ্যের অধিকার’ ‘কবি বন্দ্যঘটি গাঞী’, ‘আর্মানি চাঁপার গাছ’, ‘হাজার চুরাশির মা’-র লেখক। শুধু হাতগুলো দেখেছি সমস্ত সময়টা ধরে। শক্ত, শিরা-ওঠা এই হাত ওই সকল লেখা লেখে! এই বাংলায়, আমার রোজকার কথা বলার ভাষায় বিরসা মুন্ডার কথা লিখেছে, যা আমাদের বুকের ভিতর থেকে টেনে বের করেছে আগুন আর জল। ওই হাত এই টেবিলে বসে লিখেছে ব্রতীর কথা, ব্রতীদের কথা, আমার মায়ের, আমার ছোটবোনের কথা। সেই শুরু।
যতবার গিয়েছি কলকাতায়, কতসব মানুষকে যে দেখেছি ওই ঘোরানো সিঁড়ির বাড়িতে। আমি তো পৌঁছেছি অনেক দেরিতে, ততদিনে শুরু হয়ে গেছে শবর কল্যাণ সমিতির কাজ। মহা উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে এ কথাটি যে, শবররা কৃষিজীবী নয়, বনবাসী পশুপালক জীবনই তাদের নিজস্ব। বন নেই, তাই বনবাসী মানুষ সরকারের কাছে আপদ। তাদের তাহলে কোন জীবিকা শেখানো যায়, যাতে না খেয়ে না মরে? দেখা গেল, কাশিঘাসের শুকনো খড়ের মতো শীষ দিয়ে বুনে নানা বস্তু তৈরি করতে পারে তারা। ডালা, ঢাকনি, নরম ঝুড়ি, টেবিল ম্যাট, ছোট ব্যাগ। ট্রেনিং দাও আর বিক্রির ব্যবস্থা করো। কে করবে? কেন শবরদের মা। অ্যাকাডেমি পুরস্কার বিজয়িনী, বুক কাঁপানো অসংখ্য গল্প-উপন্যাসের স্রষ্টা মহাশ্বেতা দেবী নিজে শুরু করলেন সে কাজ। বিভিন্ন সরকারি অফিস। বেসরকারি বিভাগ, ব্যাঙ্ক, বইমেলা। মহাশ্বেতা দেবী গাড়ি ভাড়া করে, দু’হাত ভরে সেই সব জিনিস নিয়ে নিজে যাচ্ছেন–
‘এদের বহুকাল ধরে ক্রিমিনাল ট্রাইব বলা হয়েছে। তাদের হাতে তৈরি এত সুন্দর সব জিনিস কেন আপনারা নেবেন না? অফিসে প্লাস্টিকের ফাইল ট্রের বদলে এই কাশিঘাসের জিনিস কত সুন্দর। তাছাড়া, ওই মানুষদের হাতে তৈরি ওদের জীবিকার অবলম্বন…’। আধিকারিকরা, প্রশাসকেরা প্রথমে হতভম্ব, তারপর অভিভূত, আগ্রহী। সেই আপাদমস্তক ভিন্ন অভিজ্ঞতায় তাঁরা অনেকেই বোল্ড আউট! ক্রমশ তাঁদের অনেকেই সমর্থক, উদ্যোগী, কর্মসহায়ক।
দেখি তুষার তালুকদার, কলকাতা পুলিশের তৎকালীন কমিশনার, এসেছেন কোন একটা হস্তশিল্প মেলায় শবরদের তৈরি জিনিস নেওয়ার ব্যবস্থা করতে। মহাশ্বেতা, তখন তাঁর বয়স সত্তরের বেশি, অক্লেশে ঘোরানো সিঁড়ির সেই মাঝখান দিয়ে শাড়ি গুটিয়ে রেলিং টপকে চলে গেলেন ওপাশের সেই ঘরে, যেখানে শবরদের কাজ জড়ো করে রাখা আছে। তুষারবাবুর স্ট্রোক হওয়ার জোগাড়! ‘কী করছেন কী! বলছেন না কেন?’ ওই ঘোরানো সিঁড়ির ঘরে সুগার ফল করে মেঝেতে পড়ে থেকেছেন জুভেনাইল ডায়াবিটিসের রোগিণীটি। সে কথা হয়তো কিছু ছড়িয়েছিল। আমার সামনে একবার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীকে তাঁর সান্ধ্য প্রিয়স্থান পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমিতে বসে বলতে শুনেছিলাম, ‘আমাদের হাতে কিছু বাড়ি তো আছে আমাদের লেখক শিল্পীদের যাঁদের নিজেদের বাড়ি নেই তাঁদের দেওয়ার জন্য, প্রথম মহাশ্বেতা দি-কে দিতে হবে। উনি নাকি এই বয়সেও সিঁড়ির রেলিং টপকে যাতায়াত করেন! এটা আমাদেরই লজ্জার কথা।’
মহাশ্বেতা কোনও বাড়ি পাননি এরকম। চানওনি বোধহয়। কিন্তু অবিশ্রান্ত চেয়ে গিয়েছেন, কার কাছে নয়? কী নয়? পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন জেলখানায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বন্দিরা পড়ে আছেন তাঁদের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার অনেক পরও, দু’বছর তিন বছর, সাত-আট বছর পেরিয়ে গেছে কিন্তু রাইটার্স থেকে তাঁদের রিলিজ অর্ডার সই হয়ে আসেনি। আই জি, সচিব, কারামন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী। বিহারের পালামৌ জেলায় আটের দশকেও ভূমিদাসদের ক্রীতদাসত্ব প্রচল ছিল। বিহারের সচিব, আইনমন্ত্রী থেকে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব পর্যন্ত চিঠির পর চিঠি লিখেছেন, ফোন করেছেন। তাঁর বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তার মোড়ে গাড়ির ধাক্কা খেয়ে পড়ে থাকা মানুষের পকেটে ছিল মায়ের দেওয়া চাল কেনার টাকা আর ফোন নম্বর। সেই অজ্ঞাতকুশলী মানুষটির শুশ্রূষার ব্যবস্থা করার পরও কাঁদছেন উৎকণ্ঠায়– ওর যদি কিছু হয়ে যায়, আমি ওর স্ত্রীকে কী বলব? ঘরে চাল ছিল না, কতদূর সেই দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা থেকে এসেছিল।
এই চোখের জল দেখা যেত না লেখায়। আগুন ফুটে পড়েছে সেখানে। নিজের সম সময়কে লিখেছেন, অতীতকে লিখেছেন। বানিয়ে নয়, পরম যত্নে, কঠিন পরিশ্রমে তার পুঙ্খানুপুঙ্ক্ষ জোগাড় করে বিবরণের বাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন পাঠকের সামনে। তুলে ধরেছেন অন্যায়কে, অমানুষিকতাকে, একই সঙ্গে আপ্রাণ চেষ্টা করে গিয়েছেন বাস্তবে সেই ঘায়ের অপনোদন করার। লোধা শবর নামের অরণ্যচারী আদিবাসী গোষ্ঠীর লোকেদের ইংরেজ শাসক নাম দিয়েছিল ‘অপরাধী জনজাতি’, Denotified Tribe. এমনকী শহরেও যে কোনও অভিযোগে, প্রমাণে নয় শুধু সন্দেহ হলে, এদের পিটিয়ে মেরে ফেললেও কারও শাস্তি হত না। পুরুলিয়ার বুধন শবর বলে এক শান্ত স্বভাবের তরুণকে কাছাকাছি অঞ্চলে একটা বাসন হারিয়ে যাওয়ায় থানায় নিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে পুলিশ বলে অভিযোগ ওঠে। প্রায় বাহাত্তর/ তিয়াত্তরের অসুস্থ শরীর নিয়ে সেই গ্রামে চলে গেলেন মহাশ্বেতা। কথা বললেন, পরামর্শ দিলেন, পাল্টা কেস হল পুলিশের নামে। মহাশ্বেতা বসে রইলেন না, চলে গেলেন মহারাষ্ট্র। সেখানে দলিত জাতির মানুষদের মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে লড়ছেন শ্রী গণেশ দেবী। যোগাযোগ করলেন তাঁর সঙ্গে। বুধনের লুকিয়ে রাখা মৃতদেহ প্রমাণ করল মাথায় পিঠে-সারা শরীরে মরণান্তিক আঘাতের চিহ্ন। লোধাশবর জীবনে বিনা বিচারে পিটিয়ে মারা ‘অন্যায়’ বলে রায় দিলেন হাইকোর্ট। অন্যায় মৃত্যুর ক্ষতিপূরণের মর্যাদা পেল শবরজীবন। উদ্বুদ্ধ গণেশ দেবী দলিত অধিকার দাবি করার সংগঠনের মুখপত্র প্রকাশ করলেন, নাম দেওয়া হল ‘বুধন’।
সেই ঘোরানো সিঁড়ির বাড়ি থেকে গলফ গ্রিনের পিছন দিকে এক অসাধারণ বাড়ি, যার বাড়িওয়ালা ‘কে এক মহাশ্বেতা দেবী’র লেটারবক্স খুলে গলিতে ফেলে দিয়েছিলেন। সেখান থেকে গলফ গ্রিনের বাড়ি, প্রথম একটা আলাদা লেখার ঘরের আরাম। আর বাইরের সব কিছুর সঙ্গে চলেছে এই সংসারগুলোতে যে যখন থেকেছে তাদের যত্ন। সেই মেয়েদের কাউকে মহাশ্বেতা কাজে নিয়োগ করেননি। নানা দুর্যোগে, বিপদে পড়ে তারা এসেছে। যতদিন অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা না থাকে, থেকেছে। ‘সারাজন্ম তো তুমি আমার বাড়িতে বাসনমাজা রান্না করবে না মা, নিজের কিছু উপায় শেখো’ বলে তাদের অধিকাংশ জনকে ভর্তি করে এসেছেন সরোজনলিনীতে কিংবা অন্য কোনও শিক্ষালয়ে। বাচ্চার মায়েরা স্বস্তিতে থেকেছে সন্তানের ভার ‘মা’ নেওয়ায়। ঘরে-বাইরে এই বিপুল ভরসা দিয়ে চলেছেন একলা একটি মানুষ যাঁর বয়স, রোগ, নিজ জীবনের জটিলতা কোনওটাই অনুকূল ছিল না।
ঠিক কী আমি বলতে চাইছি মহাশ্বেতার সর্বজন পরিচিত জীবন নিয়ে এইসব টুকরো টুকরো কথা উল্লেখ করে? হয়তো এই অসামান্য লেখককে নিয়ে নিজের অকূল বিহ্বলতার কথা। একজন মানুষ কী করে একই সঙ্গে নিজকে এভাবে রাখতে পারেন লেখায়, অধ্যয়নে ও চর্যায়? অনেক বছর কাছ থেকে দেখে দেখে মনে হয়েছে মহাশ্বেতা দেবীর সমস্ত শক্তির, অকল্পনীয় উদ্যম আর ক্ষমতার মূলে ছিল তাঁর ভালোবাসার ক্ষমতা। কবে থেকে শুরু হয়েছিল, জানি না। একেবারে বালিকা বয়সে নিজের ছোট ভাইবোনদের পালন করার মধ্য দিয়ে? প্রায় কিশোরী বয়সে ‘বেঙ্গল ফেমিন’-এর মানুষদের মুখ কি সারাজীবন রয়ে গিয়েছিল তাঁর মনে? নিজের জীবনে মেয়েদের স্থান আর মেয়েদের শক্তির বোধ থেকে? তাই যখন যেখানে মানুষকে অপমানিত লাঞ্ছিত হতে দেখেছেন, অমন তীব্রভাবে গর্জে উঠেছে তাঁর কলম? ভালোবাসায়? হ্যাঁ, তার মূলে ছিল আপ্রাণ ভালোবাসা। যেরকম ভালোবাসায় ভয়ংকরী হয়ে ওঠে বাঘিনী মা। রক্ষাকল্পে।
তবে কেন তাঁর নামে ওরকম ভীতি ছড়িয়েছিল সমাজের একশ্রেণির মধ্যে? থাবায় কাঁটা ফুটে ঘা হলে সিংহিনীরও যন্ত্রণা হয় না কি? সেই বিরানব্বইয়েই, অল্প আলাপের পরই একদিন জিজ্ঞেস করলেন আমায়,
–তুমি জানতে চাইলে না তো আমি ক’বার বিয়ে করেছি?
বললাম, আমি কী করব জেনে? আমার ছেলের সঙ্গে তোমার বিয়ে যে দেব না, সে তো জানাই কথা।
–তোমাকে কেউ জিজ্ঞেস করেনি আমি দিনে ক’টা করে বিড়ি খাই? হুইস্কির গ্লাস ছাড়া আমাকে কখনও দেখেছ কি না?
কত কাঁটা বিদ্ধ হলে অই অগ্নিজলময়ী লেখিকার ভিতর থেকে এই জ্বালা উৎসারিত হয়?
এইসব নিন্দা সত্ত্বেও কী করে তবে ‘দেবী’ হলেন মহাশ্বেতা, স্নেহে কিংবা কৌতুকছলেও যাচ্ছেতাই সব কুকথা যিনি অনায়াসে উচ্চারণ করতেন, সর্বজন সমক্ষেই? সে কি নয় কোথাও তাঁর মেয়েলিপনার মূর্তিকে আঘাত করা? জ্ঞানপীঠ পেয়েছেন। খুব ভারী মূর্তিটি। আহ্লাদ করে সেই ভার সম্পর্কে বললেন ওরকমই একটি শব্দ। আমি বলেছি–
–আবার ওরকম বলেছ? যাও মুখ ধুয়ে এসো শিগগির।
তার উত্তরটাও এল ওরকমই। হয়তো কোথাও ভদ্রসমাজের বেদনাহীন ভানকে আঘাত করারই ওই ভঙ্গি। তার কারণও সেই ভালোবাসা, অধিকারহীনের জন্য, লাঞ্ছিতের জন্য, অসম্মানিতের জন্য যারা সমাজকে পৃথিবীকে চালনা করে, তাদের জন্য জীবনজোড়া বুকফেটে যাওয়া ভালোবাসাই তাঁকে দেবী করে তুলেছিল, যারা বলত ওই নাম, তাদের কাছে।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved