ইহা আমার বাৎসরিক অভিজ্ঞতা যে, কলিকাতা পুলিশ অত্যন্ত দক্ষতার সহিত পুজো সামাল দিয়া থাকেন। এতদসত্ত্বেও মানুষের প্রবলতর চাপের সৌজন্যে বোধনে রওনা হইয়া ও সন্ধিপুজোয় পৌঁছনো নেহাত বিরল ঘটনা নহে। পথে যদি এহেন সংবাদের উদয় ঘটে, বুর্জ খলিফা এক হপ্তার জন্য শ্রীভূমি হইতে ইচ্ছাপ্রকাশ করিয়াছে এবং তা আপনারই পথমধ্যে অবস্থিত, তাহলে গন্তব্যে পৌঁছাইতে কোজাগরী গড়াইয়া গেলেও বিস্মিত হওয়ার কিছু নাই!
বড় প্রবল এক সময় আসিয়াছে। ইএমআই নিরন্তর কহিতেছে , ‘খোকি, পেস্তা খাবি?’ এমতাবস্থায় আমি যাত্রা ও মেগা উভয়ই করিতেছি। কখনও মেগাতে খল হইয়া নায়কের না-অঙ্কুরিত দাড়ি উপড়াইতেছি। পরমুহূর্তেই সেই অনুত্থিত দাড়ি নিজ গালে লাগাইয়া যাত্রার খলের দাড়ি উপড়াইতেছি। মা পায়েস করিলে কাঁদিতেছি– যাত্রায় তেমনটাই বলিয়াছে। এহেন যাত্রা ও মেগার দৌলতে প্রত্যহ উত্তর-দক্ষিণ করিতে হইতেছে। তাহাতে নানারকম শকট সংকট দেখিয়াছি, এই ক’দিনেই।
আমার যাত্রার মহল হইয়া থাকে গ্যালিফ স্ট্রিটে। ঠিক ধরিয়াছেন, যে অঞ্চলে এককালে সুলভে পেঙ্গুইন খরিদ করা যাইত বলিয়া জনশ্রুতি। যদিচ এই প্রথমবার বুঝিলাম, পূজা কী বস্তু! মহালয়ার প্রভাতে শ্মশ্রু কামাইয়া গাড়িতে উঠিয়াছিলাম। পৌঁছাইতে পৌঁছাইতে দেখিলাম, আমি তো আমি, তদুপরি নায়িকারও দাড়ি গজাইয়া গিয়াছে। উৎসবপ্রীতি কী প্রবল উচ্চতায় পৌঁছাইয়াছে, উক্ত দিনেই বুঝিলাম।
শহর কলিকাতায় এতদকালে মশার তুলনায় ডেঙ্গু রুগীর সংখ্যাই অধিক। তাই দেখিলাম, অনেকে নূতন ধরনের পোশাক পরিতেছে, যা একাদিক্রমে মশারি ও পোশাক উভয়েরই কম্ম করিবে। মশার চাইতে ডেঙ্গু রুগী যেমন বেশি, তাহার চাইতেও অধিক ইউটিউবার শহরে পাক মারিতেছে, এমনটাই আশঙ্কা। তাহারা নির্ঘাত প্যান্ডেলের বাঁশ মুলিবাঁশ না ত্রিপুরার আমদানি– তাহা লইয়া বিস্তর গোল পাকাইতেছে! অনিচ্ছুক খাদ্যবিক্রেতাকে ফুড ব্লগার পারিলে কামড়াইয়া ধরে নূতন স্বাদের সন্ধানে।
একদিন ক্লান্ত হইয়া শকটে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলাম। চক্ষু মোদার পূর্বে দেখিয়াছিলাম আমার বামদিকে প্রিয়াঙ্কা ধুনুচি হস্তে হোর্ডিং হইতে হাসিতেছে। ঘণ্টাখানেক পর ধড়মড় করিয়া জাগিয়া দেখি, যেমন প্রিয়াঙ্কার হাসির নড়চড় হয় নাই, তেমনই ভদ্রলোকের এক কথার ন্যায় বাহনখানাও নড়চড় করে নাই।
ইহা আমার বাৎসরিক অভিজ্ঞতা যে, কলিকাতা পুলিশ অত্যন্ত দক্ষতার সহিত পুজো সামাল দিয়া থাকেন। এতদসত্ত্বেও মানুষের প্রবলতর চাপের সৌজন্যে বোধনে রওনা হইয়া ও সন্ধিপুজোয় পৌঁছনো নেহাত বিরল ঘটনা নহে। পথে যদি এহেন সংবাদের উদয় ঘটে, বুর্জ খলিফা এক হপ্তার জন্য শ্রীভূমি হইতে ইচ্ছাপ্রকাশ করিয়াছে এবং তা আপনারই পথমধ্যে অবস্থিত, তাহলে গন্তব্যে পৌঁছাইতে কোজাগরী গড়াইয়া গেলেও বিস্মিত হওয়ার কিছু নাই!
কথা হইতেছে, আমাদিগকে এই ক্ষণে কার্যোপলক্ষে বহুবিধ স্থানে যাইতে হয়– যাত্রার এই বিলম্ব সত্যই পীড়ার কারণ হইয়া উঠিতে পারে। যদিচ আমার নিকটে কোনও জিজ্ঞাসা আসে, ‘এই বিলম্ব আপনার জন্য বিরক্তসূচক নহে?’, তাহা হইলে আপন বক্ষে হাত রাখিয়া বলিতেছি– বিন্দুমাত্র নয়, কারণ আমি রজতস্পর্শে জন্মগ্রহণ করি নাই। যে ভিড়ের হেতু এই শকটের আচার জমিয়াছে, আমি তো সেই ভিড়ের অংশ সামান্য দেড় দশক পূর্বেই। যে শিশুটি আর পদব্রজে চলিতে না পারিয়া পিতার কোল চাহিতেছে– সে-ও আমি, যে কিশোর বন্ধুদিগের সহিত কোণায় দাঁড়াইয়া আলোচনা করিতেছে– যা টাকা আছে উহাতে এগরোল আর ঠান্ডা ক্রয় করিবে, নচেৎ কেবলমাত্র চিকেন রোলেই উদরপূর্তি ঘটাইবে– সে-ও আমি। এবং যে যুবকটি প্রেমিকার পদযুগলে ফোসকার উপদ্রব বলিয়া তাহার চটি হস্তে হাঁটিতেছে– এবং এই প্রেমটিকেই সারসত্য মনে করিতেছে, তার আদলও কিয়দংশ আমারই ন্যায়।
স্মৃতির আঁতুরঘর একালে অযাচিতভাবেই আবির্ভূত হইয়া পড়ে। প্রতিটি আনন্দময় মুখ ডোডো পক্ষীর ন্যায় উড়িতে উড়িতে স্মৃতি প্রসব করিতে করিতে চলিয়াছে। দুঃখিনী শহরে ভাসিয়া বেড়াইতেছে আনন্দরেণু। সপ্তাহে একদিন মৎস্যের আয়োজন হইলে মা যেরূপ উৎসাহে পাত সাজাইয়া দেন, তেমনই সাজিয়া উঠিয়াছে আমার শহর। আমার মাতার হাঁটু বদল হইয়াছে, তাই কিঞ্চিৎ শ্লথ, কিন্তু যখন সে আমার উপহারের শাড়ি পরিয়া আমার শকটে আসিয়া বসেন, উক্ত মুহূর্তে আলো নিষ্প্রয়োজন হইয়া পড়ে। পুজোয় কলিকাতা শহরটাও আমারই মাতারানির ন্যায়। হয়তো গতির হেরফের হইয়াছে, কিন্তু শহর সুন্দরী হইয়া উঠিয়াছে, আমারই উপহার করা শাড়ি পরিয়া– তা-ই বা কি কম শ্লাঘার? হয়তো বিনিময়ে আশীর্বাদে শহর আমাকে অপেক্ষা দিতেছে কিঞ্চিৎ, কিন্তু শহরের ধান্য, দূর্বা,আমার চুল স্পর্শ করিয়া থাকে সর্বক্ষণ।
তা তো আর ঝেড়ে ফেলা যায় না।