পুজো মানেই অল্প জিরিয়ে নেওয়া। আর অল্পের হাত ধরেই আসে গল্প। জীবনের ফাঁকফোকরে কয়েক মিনিট একটু অন্য জীবনের ডেরায় ঘুরে আসা। একটু চক্কর মেরে আসা আরেকটা জীবনে। সে জীবন, নিজের জীবন থেকে খুব দূরের নয়। আসুন পড়ে নিই, রোববার.ইন-এর পাতায় সপ্তমীর গল্প। লিখেছেন সুমন ধারা শর্মা।
রাসবিহারীর মোড়ে ফুচকা বিক্রি হয়, এটা সবাই জানে। পথচলতি আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। দেখলাম, রাজীব ফুচকা খাচ্ছে। রাজীব আর রনজয়। এরা আমার থেকে বয়সে অনেক ছোট হলেও আমার বন্ধু। তাদের পাশে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ফুচকা খেলাম কম্পিটিশন করে। রাজীবই বেশি খেল। তারপর, তিনজনে তিনটে কিং সাইজ সিগারেট ধরিয়ে একসঙ্গে চিৎকার করে উঠি– ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমাদের দেশ না’। তারপর সিগারেট খেতে খেতে হাঁটা দিই লেকের দিকে। রাজীবের মুখে মাউথ অর্গ্যান। রনজয়ের গলায় জর্জ মাইকেল। কিছুক্ষণের জন্য আমরা ‘কেয়ারলেস হুইস্পার’। লেকের দিকে বিকেলে বরাবরই ভিড় থাকে।
এক বাদামওয়ালা আমাদের পথ আটকে দাঁড়াল, ‘বাদাম খাবেন?’
বললাম, ‘খাব। বিয়ার এনে দিবি?’
সে বলল, ‘টাকা দাও। আর বাদামের ঝুড়িটা দেখো। যাব আর আসব। এক্সট্রা দেবে তো কিছু?’
বললাম, ‘যা না!’
সে সরল বিশ্বাসে চলে গেল।
বাদামের ঝুড়ি দেখে দু’-একজন জিজ্ঞেস করল, ‘বাদাম কত করে?’
রাজীব কিছুক্ষণ বাদামওলার প্রক্সি দিল। বাদামওয়ালা ততক্ষণে দু’-বোতল ঠান্ডা বিয়ার নিয়ে হাজির। সন্ধে নেমেছে। ভিড় একটু হলেও হালকা। একটু হলেও গাঢ়।
যথাসম্ভব সম্ভ্রম রক্ষা করে দু’-বোতল বিয়ার পেঁদিয়ে দিয়েছি। ভাল লাগল। ফুচকা আর বিয়ারের কম্বিনেশনে বাদামের চাট। আহা!
রনজয় বলল, ‘এবার উঠতে হবে।’
বললাম, ‘ধুর বাল! বোস না একটু।’
সে বসল। কিন্তু বুঝলাম, তার কোনও কাজ আছে।
বললাম, ‘যা তাহলে। রাতে ফোন করব।’
সে চলে গেল। রাজীবকে বললাম, ‘কাজকর্ম কেমন চলছে?’
সে বলল, ‘কিচ্ছু না। কাজ করালেও পয়সা দেয় না।’
বললাম, ‘গান্ডু!’
বুঝলাম রাজীব বেশ ডিপ্রেস্ড।
বললাম, ‘একটা সিগারেট খাবি?’
সে কিছু না বলে উঠে পড়ল। আমিও উঠে পড়লাম। বাড়িতে তাড়াতাড়ি যাওয়াই ভালো। পাড়ায় পৌঁছে দেখি, সারা পাড়া অন্ধকার।
অগত্যা, জিতেনের দোকানে বসে বললাম, ‘একটা চা দে জিতেন।’
হ্যাজাকের আলোয় দেখলাম, একটা মেয়ে সামনের বেঞ্চে বসে লম্বা সিগারেট ফুঁকছে। টাইট জিন্স আর রাউন্ড নেক টি-শার্ট। দেখলাম, মানে চোখ পড়ে গেল। চা খেতে খেতে দেখলাম, মেয়েটা সিগারেট শেষ করে আমাকে নমস্কার করে বলল, ‘স্যর, আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। আমি পারিজাত।’
আমি চা খেতে খেতে বললাম, ‘কেন?’
–স্যর, একটু কথা ছিল।
–বলো না। অসুবিধে নেই।
–আপনার একটা বই অনুবাদ করব। ইংলিশে। ওই ‘ডগবাবু’…
–সে কী! পারবে? মানে, কনফিডেন্ট?’
–একদম। মানে, কিছুটা শুরু করে দিয়েছি অলরেডি।
পারিজাতকে বললাম, ‘একটা সিগারেট দে। ওই লম্বা মালটা।’
সে আমাকে সিগারেট দেয়। সিগারেট ধরিয়ে উঠে পড়ি। বললাম, ‘চল, পার্কের দিকটা যাই। এখানে যত ডিস্টার্বেন্স।’
পার্কের বেঞ্চে বসে তাকে বললাম, ‘আমার একটা পত্রিকা আছে। জানিস?’
–হ্যাঁ। জানি। অনুবাদ পত্রিকা তো?
–তুই কী করতে পারিস তার জন্য? অ্যাড-ট্যাড্? আচ্ছা, তুই কী করিস?
–আমি যাদবপুরে পড়ছি। ফিলোজফি। আমার বাড়ি বিজয়গড়ে।
–তাই নাকি? আচ্ছা। আশা করছি, ক্যারেক্টারগুলো বুঝতে পারবি। না পারলে ফোন করিস। মনে হয়, অসুবিধা হবে না। শুধু মালতীর প্রতি অবিচার করিস না। ওই জায়গাটা একটু ধরে করিস।
–আপনি চিন্তা করবেন না। আমি জানি, আপনি আপনার ক্যারেক্টারদের কত ভালোবাসেন।
–ঠিক আছে। কাট তাহলে।
আমি ঝোলা কাঁধে নিয়ে উঠলাম। সে-ও চলে গেল। ডগবাবুর একটা হিল্লে হল, মনে হয়। বাড়ি ফেরার পথে প্রচুর বৃষ্টি। একটা দোকানঘরে দাঁড়ালাম। বেশ কিছুক্ষণ। আমার পাশে এক ভদ্রলোক– গায়ে আলোয়ান, হাতে ব্যান্ডেজ। বললেন, ‘একটু সরে দাঁড়াবেন। হাতে ব্যথা!’
ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, তাঁর মুখে গুজরাতি চানার গন্ধ। আমি স্মিত হাসলাম।
সে ঘরঘরে গলায় আমাকে বলল, ‘আচ্ছা, শুভাশিসের বাড়িটা কোন দিকে? তাকে কয়েকটা কথা বলার ছিল।’
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘কে শুভাশিস? আশপাশে কোথাও একটা হবে। আমি ঠিক জানি না।’
লোকটা আরও একটু কাছে এসে আমার কানে কানে বলল, ‘বাপ্পাটা একেবারে যাচ্ছেতাই লোক, মশাই। আমার হাতটা কে কাটতে বলেছিল, বলুন তো? ইনফেকশন হয়ে গেছে। অসম্ভব যন্ত্রণা। ভালো ডাক্তার আছে সন্ধানে?’
আমি সে যাত্রায় ‘ভাস্কর জানে’ বলে কোনওমতে কাটি।
লোকটা বলে, ‘ও মশাই, যাচ্ছেন কেন? শুনুন না। ও দাদা!’
আমি ভিড়ে মিশে যাওয়ার একটা মরিয়া চেষ্টা করি। ওদিকে, রাস্তায় ব্যাপক যানজট। একটা পাগল একটা সুতো নিয়ে রাস্তা পেরচ্ছে। সবাই ‘গেল গেল’ করে উঠল। তীব্র শব্দে ব্রেক কষল কিছু গাড়ি। পাগলটা রাস্তা পেরোতে পেরোতে গুনগুন করে বলছে, ‘গঙ্গা আমার মা। পদ্মা আমার মা। আমার দুই চোখে দুই জলের ধারা…’
বাসস্ট্যান্ডের বেলুনওলা, লজেন্সওলা, ট্রাফিক পুলিশ, মোবাইল হকারদের পেছনে ফেলে বাড়ির দিকে রওনা দিচ্ছি, এমন সময়ে সেই হাতে ব্যান্ডেজ ভদ্রলোক, প্রায় থাবা মেরে আমাকে আটকালেন, ‘তখন থেকে ডাকছি। শুনতে পান না, না কি?’
–কেন কী হল আবার?
–বললাম না, বাপ্পাটা মহা হারামি তো! শালা, হাতটা বোধহয় গেল।
ভদ্রলোককে আশ্বস্ত করার জন্য বললাম, ‘না না, কিচ্ছু হবে না। ভাবছেন কেন? একটা ডাক্তার দেখালেই তো হয়। একটা অ্যান্টি-বায়োটিক ঝেড়ে দিলেই ঠিক হয়ে যাবে।’
সে আবার ঘ্যানঘ্যান করতে থাকে, ‘শালা, মহা হারামি লোক তো! আমার হাতটা শেষ করে দিল।’
এবার আমার বেশ রাগও হয়ে গেল, ‘অন্যের কথা শুনে ব্লেড মারতে গেলেন কেন বলুন তো? এবার বুঝুন!’
লোকটা এবার একটু হতাশ, ‘‘ঠিক বলেছেন। তখন বাড়িতে ডেকে, মিষ্টি খাইয়ে বলল, ‘কিচ্ছু হবে না। আমি তো আছি!’ মাল তো এখন পগার পার। আঃ! শুভাশিসের ফোন নম্বরটা দিন না। ওর কাছ থেকে কিছু পয়সা পাই। আপনার কাছে নেই?’’
আমি চমকে উঠে বলে ফেললাম, ‘কী? পয়সা?’
–না। না। শুভাশিসের ফোন নম্বর! নেই?
–বললাম তো নেই। টালিগঞ্জ পাড়ায় কারও কাছ থেকে ঠিক পেয়ে যাবেন।
–আপনি যাবেন আমার সঙ্গে?
–কোথায়? মহা ঝামেলা তো!
–বাপ্পার বাড়ি।
–সে তো মারা গেছে।
–আপনি বাল জানেন। মারা যায়নি। আত্মগোপন করে আছে। আমি জানি।
–ছাই জানেন। তখন কোথায় ছিলেন আপনি?
–কেন? বইয়ের তাকে!
ঘুম ভেঙে গেল। বাইরে জোর বৃষ্টি হচ্ছে। দরজায় কেউ জোরে জোরে কড়া নাড়ছে। মনে হচ্ছে, ভেঙেই ফেলবে দরজাটা। তড়িঘড়ি এসে দরজা খুলতে এক অচেনা ভদ্রলোক ঢুকে এলেন। রোগা চেহারা। বৃষ্টিতে ভেজা লম্বা লম্বা চুল। কাঁধে ঝোলা ব্যাগ। ঝোলা গোঁফ দিয়ে দিব্যি জল ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছে। হাসি হাসি মুখে বললেন,
–বুম্বা তো?
–কে বুম্বা?
–বুম্বা? মানে, সম্বরণ? তুই সম্বরণ না?
–কে সম্বরণ? আমি খামোকা সম্বরণ হতে যাব কেন? না না, এখানে ওই নামের কেউ থাকে না।
–থাকে না? কিন্তু, তাতে কী? বাইরে তো জোরে বৃষ্টি হচ্ছে। পুরো ভিজে গেছি মাইরি। একটু চা হবে?
–না হবে না। কাটুন তো।
–ব্যস। এই একটু চা আর একটা সিগারেট। খেয়েই পালাব।
–কিচ্ছু হবে না। বিরক্তিকর ব্যাপার তো!
–ব্যস একটা বিস্কিট। আর, কিচ্ছু চাই না।
অতঃপর চা হল। সিগারেট হল। বিস্কিট হল। বৃষ্টি কিন্তু তাও থামল না। একহাত দাবা। তাস। ক্যারম। ক্রিকেটের গল্প। সব হল। রাত হল। বৃষ্টি কিন্তু তাও থামল না।
আগন্তুক লোকটা হঠাৎ বলে বসল, ‘জানেন, আমি কবি?’
আমি যন্ত্রচালিতের মতো বললাম, ‘কী করে জানব? আমি তো আপনার নামও জানি না।’
সে বলল, ‘সে কী। আমার নাম জানেন না? আমি পি. ভাট। আমার একটা কবিতা শুনবেন?’
হতাশ হয়ে বলি, ‘এত কিছুই যখন সহ্য করছি। এটাও না হয়…’
সে শুরু করল,
‘তোমাকে দিচ্ছি নিয়নের আলো
উড়ে যাওয়া মেঘ গতিবেগ ভালো
মেঘমল্লারে বেওয়ারিশ কালো
আজ সে তর্ক থাক
তোমাকে চাইছি দু’আঙুল ফাঁকে
মলাট জড়ানো নভেলের তাকে
সান্ধ্যকালীন পাখিদের ঝাঁকে
আজ সে তর্ক থাক
তোমাকে দেখছি রাস্তার মোড়ে
যাকেই চাইছি, যায় সরে সরে
চার কাপ চায়ে চামচেরা ঘোরে
আজ সে তর্ক থাক
তোমাকে দেখেছি যখন নগরে
আগুনের মতো ফ্যাতারুরা ওড়ে
অথবা, বেবি-কে পেট্রল ফুঁকে
বাজিয়ে চলেছে ঢাক।
আজ সে তর্ক থাক থাক,
আজ সে তর্ক থাক।’
শোনার পর থেকে শরীরে কেমন অস্বস্তি হতে শুরু হয়। কোথায় শুনেছি? কোথায় শুনেছি? তাই থাকতে না পেরে বলেই ফেললাম, ‘ছন্দটা কেমন চেনা চেনা মনে হচ্ছে।’
সে চুপিচুপি কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলল, ‘মশাই, এখন কারখানা বন্ধ। এখন এটাও হচ্ছে না। যা পাচ্ছেন, চেপে যান।’
লোকটাকে কেমন যেন ভালো লেগে গেল।
বললাম, ‘আজ দুর্যোগের রাত। না হয়, থেকেই যান আজকের রাতটা। তা, আপনার বাড়ি কোথা?’
–বাড়ি নেই তো। আজকের রাতটা আপনার বাড়ি। কাল খুঁজব।
–মানে?
–মানে এটা চক্রান্ত। আজ বিকেলে হাতে ব্যান্ডেজবাঁধা একটা লোক এই বাড়িটা দেখিয়ে আমায় বলল, এই বাড়ির লোকটা মহা হারামি। তুই ওর কাছ থেকে এক কাপ চা খেয়ে এলে একশো টাকা পাবি। কিন্তু, অনেকক্ষণ চেষ্টা করছি। মালটা ফোন তুলছে না তো?
কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। এরকম একটা ইলেকট্রিক শক খেয়ে সেটা ভেঙে গেল। তৎক্ষণাৎ, লোকটাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে শোবার ঘরে এসে দেখি, আমার ওয়ালেটে কেউ একশো টাকার একটা ভিজে নোট গুঁজে দিয়ে গেছে।
অলংকরণ: শান্তনু দে
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved