Robbar

শান্তির বিনিময়ে কী? প্রাকৃতিক গ্যাস ও খনিজ তেল?

Published by: Robbar Digital
  • Posted:October 15, 2025 7:35 pm
  • Updated:October 15, 2025 7:35 pm  

ভেনেজুয়েলার রাজনীতিবিদ মারিও করেনা মাচাদো-র নোবেল পুরস্কার পাওয়া নিয়ে অবাক হওয়ার কিছু নেই। মারিও মাচাদো সরাসরি ইসরায়েলের সমর্থক, তিনি নেতানিয়াহুর বন্ধু, সোজাসাপ্টা ভাষায় ইসরায়েল ও তাদের গণহত্যাকে সমর্থন জানিয়েছেন, কিন্তু তার থেকেও ভয়ংকর হল তিনি ট্রাম্পেরও বন্ধু এবং সোজাসুজি তাঁকে আমন্ত্রণ পাঠিয়েছিলেন তাঁর নিজের দেশ ভেনেজুয়েলার ওপর স্যাংশন বা নিষেধাজ্ঞা লাগু করার জন্য। অর্থাৎ, একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়ে তিনি সরাসরি আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে, যে গণতান্ত্রিকভাবে নিকোলাস মাদুরোর সমাজতান্ত্রিক সরকারকে আমি হারাতে অক্ষম, অতএব হে পিতা, দেশের মধ্যে অগণতান্ত্রিক ভাবে সরকার ফেলে দিয়ে আমাদের ফ্যাসিবাদী সরকার কায়েম করায় আমাদের সাহায্য করো, এবং বিনিময়ে ভেনেজুয়েলার তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস, সব তোমার! প্রমিস! 

বনজ্যোৎস্না লাহিড়ী

স্বর্গের দুয়ারে বসে, দুনিয়ার ঠিক-ভুলের হিসেব রাখতে রাখতে চিত্রগুপ্ত হয়তো মাথা নেড়ে বলবে– না না, এটা ঠিক হল না! যে পুঁচকে মেয়েটার নেতৃত্বে প্রায় ৪০০ শান্তিকামী মানুষ, অন্ধকার সমুদ্রের বুক চিরে এই সেদিন ৪০টা ডিঙা নিয়ে ভেসে পড়েছিল, যারা জানত ওই আঁধারে ঘাপটি মেরে বসে থাকা দানব বাহিনী তাদের আটকাবে, গ্রেফতার করবে, বা ২০১০-এ যেভাবে খুন হয়েছিল ন’জনফ্রিডম ফ্লোটিলা’র সদস্য ইজরায়েলি বাহিনীর হাতে, সেভাবে খুনও হতে পারে। কিন্তু তাতেও দমেনি একরত্তি মেয়ে গ্রেটা থুনবার্গ, থিয়াগো অভিলা আর অন্যান্য ফ্লোটিলার সদস্য। যেভাবে ১৭ বছরের পুরনো ইজরায়েলি অবরোধ ভেঙে এই সেদিন যারা সম্পূর্ণ নিরস্ত্রভাবে ভেসে গিয়েছিল গাজার উদ্দেশ্যে, সেখানে আটক ২৩ লক্ষ যুদ্ধ বিধ্বস্ত মানুষকে ত্রাণ পৌঁছে দিতে, সেই অসম সাহসী শান্তিকামী মানুষই বিশ্ব শান্তির প্রতীক!

গ্রেটা থুনবার্গ

এই মুহূর্তে চলমান একতরফা গণহত্যার সামনে দাঁড়িয়ে যারা শান্তির কথা বলে চলেছে, যারা অস্ত্র ব্যবসা খতম করতে চাইছে, যারা সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে গিয়ে গণহত্যার খবর পৌঁছে দিচ্ছে দুনিয়ার কাছে, যে সমস্ত ডাক্তার নার্স নিজেদের জান বাজি রেখে নিরলস যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষের চিকিৎসা করে চলেছে, তাদের চেয়ে বড় শান্তির দূত কে এই মুহূর্তে? চিত্রগুপ্ত ঠিক-ভুলের হিসেবে করতে করতে এসব ভাবতেই পারে! কিন্তু মজার বিষয় হল, চিত্রগুপ্তের হিসেবে দুনিয়ায় সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় না! নোবেল শান্তি পুরস্কারের মতো সিদ্ধান্ত তো কখনওই নয়।

থিয়াগো অভিলা, গ্রেটা থুনবার্গ ও রিমা হাসান

অতএব, ভেনেজুয়েলার রাজনীতিবিদ মারিও করেনা মাচাদো- নোবেল পুরস্কার পাওয়া নিয়ে চিত্রগুপ্ত আপত্তি জানাতেই পারে, কিন্তু অবাক হওয়ার কিছু নেই। মারিও মাচাদো সরাসরি ইজরায়েলের সমর্থক, তিনি নেতানিয়াহুর বন্ধু, সোজাসাপ্টা ভাষায় ইজরায়েল তাদের গণহত্যাকে সমর্থন জানিয়েছেন, কিন্তু তার থেকেও ভয়ংকর হল, তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পেরও বন্ধু এবং সোজাসুজি তাঁকে আমন্ত্রণ পাঠিয়েছিলেন তাঁর নিজের দেশ ভেনেজুয়েলার ওপর স্যাংশন বা নিষেধাজ্ঞা লাগু করার জন্য। অর্থাৎ, একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়ে তিনি সরাসরি আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে যে, গণতান্ত্রিক ভাবে নিকোলাস মাদুরো-র সমাজতান্ত্রিক সরকারকে আমি হারাতে অক্ষম, অতএব হে পিতা, দেশের মধ্যে অগণতান্ত্রিক ভাবে সরকার ফেলে দিয়ে ফ্যাসিবাদী সরকার কায়েম করায় আমাদের সাহায্য করো, এবং বিনিময়ে ভেনেজুয়েলার তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস– সব তোমার! প্রমিস!

মারিও করেনা মাচাদো

মারিও মাচাদো ২০০২- হুগো চাভেসের সরকার ফেলে দেওয়ার প্রচেষ্টাকেও স্বাগত জানিয়েছিলেন, এবং তারপর থেকেই তিনি সাম্রাজ্যবাদের নয়নের মণি। লাতিন আমেরিকায় তাঁর বন্ধু আর্জেন্টিনার জাভিয়ের মেলেই আর এল সালভাদরের নায়িব বুকেল। এঁরা দু’জনেই শুধুমাত্র চরম দক্ষিণপন্থী নন, এঁরা লাতিন আমেরিকার ভূ জঙ্গল মাফিয়ার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। এই মাফিয়া অক্ষ-র হাত ধরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বারবার থাবা বসিয়েছে লাতিন আমেরিকায়। চূর্ণ করেছে গণতন্ত্র, লুঠ চালিয়েছে লাতিন আমেরিকার প্রাকৃতিক সম্পদে। মাচাদো সরাসরি ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রায়াত্ত তেল সংস্থা PDVSA-এর বেসরকারিকরণ চান। অর্থাৎ, দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ বিদেশি পুঁজির হাতে তুলে দিতে চান। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ফলে ভেনেজুয়েলাতে ওষুধ সংকটের সৃষ্টি হয়, এবং বিশেষ করে শিশু মৃত্যুর হার বৃহৎ গুণে বৃদ্ধি পায়। মাচাদো দু’হাত তুলে এই নিষেধাজ্ঞা সমর্থন করেন। 

File photo of Nobel Peace laureate Maria Corina Machado and US President Donald Trump.(Agencies)

 

এরপর চিত্রগুপ্ত তাঁর নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপ্তির খবর শুনে ঘাড় নেড়ে আপত্তি জানাতেই পারেন, কিন্তু সেটা সঠিক হবে না। ইতিহাসবোধ নিয়ে যাঁরা এই খবর শুনবেন, তাঁরা বড় জোর মুচকি হাসবেন, কিন্তু অবাক হবেন না।

কারণ নোবেল শান্তি পুরস্কারের এটাই তো ইতিহাস। ১৯৭৩ সালে হেনরি কিসিঞ্জার পান নোবেল শান্তি পুরস্কার! সেইবার নিশ্চয়ই চিত্রগুপ্ত হেঁচে-কেশে বিষম খেয়ে একশা করেছিলেন। কম্বোডিয়ার মতো দেশকে বোমাবর্ষণ করে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া কিসিঞ্জার, চিলি-সহ একাধিক লাতিন আমেরিকার দেশে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার গায়ের জোরে ফেলে দিয়ে স্বৈরাচারি পুতুল সরকার চাপিয়ে দেওয়া কিসিঞ্জার সেবার নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন। 

Henry Kissinger, Who Shaped U.S. Cold War History, Dies at 100 - The New York Times
হেনরি কিসিঞ্জার

বা ২০০৯ সালের প্রাইজ সোজাসুজি গেল সদ্য ক্ষমতায় আসা মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার কাছে। বলা হল, তাঁর পূর্বসূরি যুদ্ধবাজ জর্জ বুশের শুরু করা পৃথিবীব্যাপী যুদ্ধ তিনি বন্ধ করবেন। চিত্রগুপ্ত হেঁচকি তুলতে তুলতে দেখতে থাকলেন, কীভাবে আফগানিস্তানে মার্কিন সেনা মোতায়েন বেড়েই চলল এবং লিবিয়া সিরিয়ার মতো কত শতাব্দী প্রাচীন দেশগুলি মুখ থুবড়ে পড়ল মার্কিন যুদ্ধ হানা এবং অভ্যন্তরীণ হিংসার কারণে, যার পিছনেও মার্কিন উসকানি ছিল সর্বজনবিদিত।

Obama's cancer challenge and the audacity of hope
বারাক ওবামা

তা এইসব জাঁহাবাজ যুদ্ধবাজের সামনে মারিয়া করেনা মাচাদো তো নেহাত শিশু।

আসলে তৃতীয় বিশ্বের কিছু আন্দোলনকারী, বিশেষত সে যদি পুঁজির দালাল হয়, তাকে এই ধরনের শান্তি পুরস্কারের মাধ্যমে মহিমামণ্ডিত করে তার হাত ধরে তৃতীয় বিশ্বে পুঁজির অনুপ্রবেশ ঘটানো বা সাম্রাজ্যবাদের হাত শক্ত করার প্রচেষ্টাও আমরা এর আগে দেখেছি. এবং বেশ কিছু ক্ষেত্রে এই পুরস্কার বিশেষ করে দেওয়া হয়েছে মহিলাদের। 

Aung San Suu Kyi, the Ignoble Laureate | The New Yorker
আংস্যাং সু কি

বার্মার আংস্যাং সু কি-কে নোবেল দেওয়া হয়েছিল ১৯৯১ সালে, বার্মার মিলিটারি জুন্টার বিরুদ্ধে তাঁর দীর্ঘ অহিংস আন্দোলনের জন্য। কিন্তু পরবর্তীতে ক্ষমতায় আসার পরেই বার্মার রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ওপর ইতিহাসের অন্যতম জঘন্য জাতিগত হিংসা বা এথনিক ক্লেনসিং সংঘটিত হয় তাঁর নেতৃত্বে। ২০১৪-তে শান্তি পুরস্কার পান পাকিস্তানের মালালা ইউসুফজাই, তালিবানি শাসনে শিশুদের শিক্ষার অধিকার রক্ষা করার লড়াইয়ের জন্য। সেই বছরই যৌথভাবে এই সম্মান পান ভারতের কৈলাশ সত্যার্থী, তিনিও পুরস্কার পান শিশু শ্রমিকদের অধিকারের জন্য লড়াই করে। এই গত দু’বছরের গাজার চলমান গণহত্যায় যখন প্রায়,০০০ শিশু সরাসরি যুদ্ধের ফলে বা অনাহারে মারা গেল, তখন এই দুই শিশু অধিকারের জন্য লড়াই করা আন্দোলনকারী মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছেন, কারণ নোবেল শান্তি পুরস্কার আসলে তো সাম্রাজ্যবাদীদের দেওয়া ঘুষ! হিংসা ছড়ানোর ঘুষ, সাম্রাজ্যবাদকে মহিমান্বিত করার, তাদের হাত শক্ত করার, পুঁজির আগ্রাসন নিশ্চিত করার জন্য দেওয়া ঘুষ। 

Kailash Satyarthi, Malala Yousafzai to Receive the Nobel Peace Prize Today
মালালা ইউসুফজাই ও কৈলাশ সত্যার্থী

অতএব চিত্রগুপ্তর অবাক হওয়ার কারণ নেই।  শান্তি পুরস্কার পুঁজির শান্তি পুরস্কার। সাম্রাজ্যবাদের শান্তি পুরস্কার। সেই বহু বহু যুগ আগে, রোমান ইতিহাসবিদ ট্যাসিটাস লিপিবদ্ধ করেন স্কটিশ গোষ্ঠীপতি ক্যালগাকাসের জবানবন্দি। সেখানে রোমান আগ্রাসন সম্পর্কে তিনি বলেন: They make a desolation and call it peace, (তারা জনশূন্যতা সৃষ্টি করে আর তার নাম দেয় শান্তি)। এই নোবেল শান্তি পুরস্কারও সেই শ্মশানের শান্তির পুরস্কার।