
বিজ্ঞাপনের জগৎ আজ অনেকটাই বদলেছে। আগের মতো স্মরণীয় আইডিয়া বা গল্প আজ আমরা আর বেশি দেখতে পাই না। এখন টেকনোলজির যুগ– অ্যালগরিদম, অ্যানালিটিক্স এখন বিজ্ঞাপনের চালিকাশক্তি। এই নিয়ে আক্ষেপ ছিল পীযূষের। বিভিন্ন ইন্টারভিউতে সেই কথা তিনি বারবার বলেছেন। ব্র্যান্ড এবং বিজ্ঞাপন তার সৃজনশীলতা এবং স্টোরিটেলিং দিয়েই মানুষের মনে জায়গা করে নিতে পারে– প্রযুক্তি দিয়ে নয়।
পীযূষ পাণ্ডে মহাশয়ের সঙ্গে আমার প্রথম মুখোমুখি সাক্ষাৎ ২০০১-এ। আমি তখন ‘ওগিলভি অ্যান্ড মেথার’-এ কাজ করি। পীযূষ অবশ্য তখনই লেজেন্ড। আমি বিজ্ঞাপনের জগতে এসেছি ১৯৯৬ নাগাদ। তার অনেক আগে থেকেই অবশ্য ওঁর কাজ দেখছি। ‘মিলে সুর মেরা তুমহারা’, ‘ফেভিকল’, ক্যাডবেরি-র ‘কুছ খাস হ্যয়’– দেখে দেখেই এক সময়ে বিজ্ঞাপনে আসার ইচ্ছেটা চাগাড় দেয়। তখনও অবশ্য জানতাম না– এই ভাবনাগুলো কার মাথা থেকে এসেছে! কিন্তু পেশাদার জগতে প্রবেশের পরেই শুনলাম, বম্বেতে একজন আছেন যিনি ভারতীয় বিজ্ঞাপনের ধারাটাই বদলে দিয়েছেন। পাশ্চাত্যের প্রভাব কাটিয়ে তিনি তৈরি করেছেন ভারতীয় বিজ্ঞাপনের এক স্বতন্ত্র ‘স্টাইল’। আমাদের চারপাশের মানুষ, জীবন, কথাবার্তা থেকেই তিনি খুঁজে নিয়েছেন এক নতুন ভাষা। তাঁর কাজের ফ্যান তো ছিলামই, মানুষটারও ফ্যান হয়ে গেলাম। কখনও নতুন বিজ্ঞাপনের আইডিয়া ভাবতে বসলে আন্দাজ করার চেষ্টা করতাম, পীযূষ হলে কীভাবে ভাবতেন। সেই মতো আইডিয়া করার চেষ্টা করতাম। এখনও করি।

২০০১- ওগিলভিতে কাজ করার সময়ে প্রথমবার যখন তিনি কলকাতার অফিসে এলেন, আমি তখন বিজ্ঞাপনে সবেমাত্র শৈশব কাটিয়ে কৈশোরের পথে। গুরুদেব আসছেন বলে অফিসে তো হুলস্থুল অবস্থা! সিনিয়ররা তটস্থ! আমরা অবশ্য ততটা উদ্বিগ্ন নই, বরং কৌতূহলটাই বেশি। আইটিসি কোম্পানির নতুন দেশলাই ‘মঙ্গলদীপ’-এর ক্যাম্পেন তৈরি চলছে তখন। উনি আসার আগে কয়েক সপ্তাহ কাজ করে আমরা নানারকম আইডিয়া, ডিজাইন সব করে রেখেছিলাম– উনি এলে দেখাব। উনি এলেন, দেখলেন, মন দিয়ে সবার কথা শুনলেন, এমনকী, আমার কথাও। তারপর বললেন, ‘‘কিচ্ছু হয়নি। ব্যাপারটা হয় বড্ড কঠিন করে ফেলছ, বা বোরিং করে ফেলছ। সহজ করে ভাবো। সাধারণ দেশলাইয়ের মূল সমস্যা কী? জ্বলতেই চায় না। তুমি বাক্সে কাঠি ঘষেই যাচ্ছ, কিন্তু ব্যাটা জ্বলছে না। ধরো, বিয়ে হচ্ছে, পাত্র-পাত্রী বসে আছেন, পুরোহিত যজ্ঞের আগুন জ্বালাবেন, কিন্তু দেশলাই জ্বলছে না! কেমন হবে ব্যাপারটা? ধরো, অফিসের বসের জন্মদিন, সবাই একত্রিত হয়েছে, কেকের ওপর মোমবাতি জ্বালানো হবে, কিন্তু দেশলাই জ্বলছে না! কেলেঙ্কারি, তাই না? সেইখানে মঙ্গলদীপ। ‘ঝটসে জ্বলে’ (চট করে জ্বলে)।’’ আমরা স্তম্ভিত। সত্যিই তো, কী সহজ! আর বিজ্ঞাপনের ছবিগুলোও যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। এই ছিল পীযূষের জাদু। সহজ করে ভাবতে জানতেন। এবং রোজকার জীবনের সাধারণ ঘটনাই তাঁর ভাবনার জাদুতে, কলমের জাদুতে প্রাণ পেত, হয়ে উঠত মানুষের মনে গেঁথে যাওয়া বিজ্ঞাপন।

ক্রিকেট পাগল ছিলেন। নিজে রাজস্থানের হয়ে রনজি খেলেছেন, তাঁর কথায় প্রায়শই উঠে আসত ক্রিকেটীয় উবাচ। ক্লায়েন্টের অফিসে প্রেজেন্টেশনে যাওয়ার আগে টিমকে বলতেন, ‘ফ্রন্টফুটে খেল, বাউন্সার এলেও ঘাবড়ানোর কিছুই নেই।’ সুযোগ পেলে সুনীল গাভাসকরের সঙ্গেও জুড়ে দিতেন খেলার খুঁটিনাটি নিয়ে গভীর আড্ডা। রসে-বশে থাকতেন, মোটা গোঁফের ফাঁকে হাসিটা ছিল অমলিন। মাথায় ছেলেমানুষের মতো দুষ্টু বুদ্ধিও ছিল দেদার! শোনা কথা– একবার এক পাঁচতারা হোটেলে গিয়েছেন সহকর্মীদের সঙ্গে, কিন্তু পার্কিং পাওয়া যাচ্ছে না– পার্কিং ফুল! উনি করলেন কী, পার্কিংয়ে রাখা একটি (অচেনা) গাড়ির নম্বর দেখে নিলেন। তারপর ভ্যালে-তে গিয়ে সেই গাড়ির নম্বরটি ঘোষণা করে ডাকিয়ে নিলেন। গাড়িটি পার্কিং থেকে বেরিয়ে যেতেই কেল্লাফতে! সেই জায়গায় নিশ্চিন্তে ঢুকে গেল নিজের গাড়ি।

গত কয়েক দিন ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় পাঠক দেখে নিয়েছেন তাঁর নানা বিখ্যাত কাজ, তাই আবার নতুন করে সেই আলোচনায় যাচ্ছি না। কিন্তু আমার প্রিয় একটা-দুটো বিজ্ঞাপনের কথা না বললেই নয়। তার মধ্যে একটা হচ্ছে এসবিআই লাইফ ইনসিওরেন্সের ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’। এক প্রবীণ স্বামী তাঁর প্রবীণা স্ত্রী-এর জন্য কিনে এনেছেন হীরের আংটি। স্ত্রী যখন বলেন, এই বয়সে হীরে পরে আমি কোথায় যাব, তখন স্বামী বলেন, ‘আরে, হীরে কো কেয়া পাতা তুমহারি উমর!’ একদম হৃদয়ে গিয়ে ধাক্কা মারে যেন!
অথবা সেই অবিস্মরণীয় এমসিল-এর বিজ্ঞাপন। মৃত্যুশয্যায় শুয়ে বৃদ্ধ বাবা, চারপাশে তাকে ঘিরে আছেন আত্মীয় পরিজন। এমন সময়ে ধান্দাবাজ ছেলে আসে সম্পত্তি লিখিয়ে নিতে। বৃদ্ধ কাঁপা কাঁপা হাতে উইলে দশ হাজার লেখেন, ছেলে আরও গোটা কয়েক শূন্য বসিয়ে সেটাকে লাখ বা কোটিতে নিয়ে যায়। ঠিক তখনই ছাদ থেকে জল চুঁইয়ে পড়ে সেই কাগজে, ঠিক ১ সংখ্যাটার ওপর। ছেলে তড়িঘড়ি জল মুছতে যায়, তাতে মুছে যায় ১ সংখ্যাটাই। পড়ে থাকে বেশ কয়েকটা শূন্য। সেই মোক্ষম সময়ে বাবাও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। হাউ হাউ করে পরিজনরা কেঁদে ওঠেন, কঁকিয়ে ওঠে ছেলেও। ভয়েসওভার আসে– কেবল এক ফোঁটা জল আপনার ভাগ্য বদলে দিতে পারে, তাই এমসিল ব্যবহার করুন। যেমন গল্প, তেমন কাস্টিং, তেমনই অভিনয়; এবং সর্বোপরি শেষের লাইনটিতে যেভাবে তার সমাপ্তি– তা একমাত্র পীযূষের হাতেই সম্ভব।

এমন গল্পের জন্যই তখন টেলিভিশনে অনুষ্ঠানের চেয়ে বিজ্ঞাপন দেখতে বেশি ভালো লাগত। এছাড়াও এশিয়ান পেন্টসের ‘হর ঘর কুছ কেহতা হ্যয়’ বিজ্ঞাপনে পিযূষের নিজের কণ্ঠে সেই অনবদ্য ভাষ্য কি ভোলা যায়! অথবা ফেভিকুইক-এর সেই মাছ ধরার গল্প– চুটকি মে চিপকায়ে। নিজের দীর্ঘ কর্মজীবনে এইভাবেই অসংখ্য মণিমুক্ত ছড়িয়ে রেখে গেছেন তিনি। পেয়েছেন দেশ-বিদেশের অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মান– প্রথম বিজ্ঞাপন ব্যক্তিত্ব হিসেবে পেয়েছেন পদ্মশ্রী, আন্তর্জাতিক মঞ্চে পেয়েছেন সর্বোচ্চ লায়ন অফ সেন্ট মার্ক ও লেজেন্ড অ্যাওয়ার্ড। এবং গর্বের বিষয় হল এই সবই পেয়েছেন ভারতীয় ভাষায়, খাঁটি ভারতীয় কাজের জন্যই।

বিজ্ঞাপনের জগৎ আজ অনেকটাই বদলেছে। আগের মতো স্মরণীয় আইডিয়া বা গল্প আজ আমরা আর বেশি দেখতে পাই না। এখন টেকনোলজির যুগ– অ্যালগরিদম, অ্যানালিটিক্স এখন বিজ্ঞাপনের চালিকাশক্তি। এই নিয়ে আক্ষেপ ছিল পীযূষের। বিভিন্ন ইন্টারভিউতে সেই কথা তিনি বারবার বলেছেন। ব্র্যান্ড এবং বিজ্ঞাপন তার সৃজনশীলতা এবং স্টোরিটেলিং দিয়েই মানুষের মনে জায়গা করে নিতে পারে– প্রযুক্তি দিয়ে নয়। কারণ সবাই একটা ভালো গল্প শুনতে চায়। ভালো বুদ্ধিদীপ্ত আইডিয়াই মানুষের মনে ‘চুটকি মে চিপকে’ যায়।

আজকের এই আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের যুগে পীযূষের সেই কথাগুলোই বিজ্ঞাপন স্রষ্টাদের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকুক।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved