Robbar

আগ্রাসন আর হুমকির বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া মিশেল, জোহরানদের আমরা পাব কবে?

Published by: Robbar Digital
  • Posted:November 16, 2025 7:59 pm
  • Updated:November 16, 2025 7:59 pm  

ভারতে অনেক সময় দেখেছি, একজন প্রার্থী, যিনি কোনও জায়গাতে কখনও থাকেননি, সেখানকার মানুষ, পরিবেশ, সমস্যার সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও অনায়াসে নির্বাচনের টিকিট পেয়ে যান। জন প্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার পরও সেখানে ফিরে যান খুব কম। নির্বাচনী প্রচারের সময়ে করা প্রতিশ্রুতি বাষ্পের মতো মিলিয়ে যায় হাওয়ায়। তাই মিশেল, জোহরানের মতো মানুষগুলোকে যখন দেখি, কীভাবে চেনেন নিজের শহর, তাঁদের নির্বাচনী ক্ষেত্র নিজের হাতের পাতার মতো, শ্রদ্ধা-মেশানো বিস্ময় কাটে না।

মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায়

আমেরিকার একটা শহরের মেয়র নির্বাচন। মানলাম শহরটা নিউ ইয়র্ক। তবুও মেয়র নির্বাচন তো সেখানে কম হয়নি। ইদানীং আমেরিকার বড় শহরের মেয়ররা হঠাৎ বিশেষ কারণে আমেরিকার রাজনীতি মঞ্চে বেশ খানিকটা প্রচারের আলোর কেন্দ্রে দাঁড়াচ্ছেন, সেটা সত্যি। কিন্তু আমেরিকার, এমনকী বিশ্বের চোখ ছিল নিউ ইয়র্কের মেয়র নির্বাচনের দিকে। প্রাথমিক নির্বাচনেই সমস্ত প্রচলিত ধ্যান-ধারণা, ভবিষ্যদ্বাণী উল্টেপাল্টে, ঘাঘু রাজনীতিবিদদের পিছনে ফেলে উঠে এলেন হাসিমুখ, উদ্দীপনায় জ্বলজ্বলে যুবক– জোহরান মামদানি। তাঁর বক্তৃতা স্পষ্ট, সোজা, সরল। তাঁর বক্তৃতায় নিজের শহরের, শহরবাসীর রোজকার জীবনের মূল সমস্যার কথা।

জোহরান মামদানি

অভিবাসীদের শহর নিউ ইয়র্ক। ছিল, আছে, থাকবে। অনেকক্ষেত্রেই এই শহরের অভিবাসীরা প্রথম থেকে তাদের নিজের দেশের মানুষের সঙ্গে একত্র-বাসে স্বচ্ছন্দ। ইতালি থেকে চিন, কলম্বিয়া থেকে বাংলাদেশ– নানা দেশের মানুষ নিউ ইয়র্ক শহরের এক-এক অঞ্চলে এক টুকরো নিজেদের দেশ বানিয়ে ফেলেছেন। জোহরান মামদানি তাঁর প্রচারের ভিডিওগুলো থেকেই ভীষণ গতানুগতিক ঠান্ডা, কালচে, স্যাঁতস্যাঁতে দিনে হঠাৎ যেন ঝকঝকে নীল আকাশে সাদা মেঘ এঁকে, তাজা বসন্তের হওয়া বইয়ে দিলেন। ভিন্ন ভিন্ন এথনিক কমিউনিটির সঙ্গে, তাদের ভাষার বা সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে, হাসি-মজা করতে করতে সহজ দ্বিধাহীন ভাষায় বলতে শুরু করলেন, তিনি নিউ ইয়র্কবাসীর দৈনন্দিন সমস্যাগুলোর কীভাবে মোকাবিলা করবেন। বলিউডের সিনেমার ডায়লগের নকল থেকে শুরু করে, বয়স্ক চাইনিজদের সাথে তাইচি– সবেতেই তিনি সমান স্বচ্ছন্দ। আর তাঁর সঙ্গে যোগ দিলেন জোহরানের সমর্থকরা, তাঁর বিশাল স্বেচ্ছাসেবকবৃন্দ। যাঁরা এসে দাঁড়িয়েছিলেন প্রায় নাম না-জানা এই প্রার্থীর নেপথ্যে, ডিসেম্বর থেকে, মূলত অল্পবয়স্ক নিউ ইয়র্কবাসীরা। যাঁরা মামদানির আকাশছোঁয়া অ্যাপার্টমেন্ট রেন্টের সীমা বেঁধে দেওয়ার, সাধারণ মানুষের জন্য সাশ্রয়কারী সরকারী গ্রোসারি, বিনামূল্যে বাস বা পরিবহণ, বিনামূল্যে বাচ্চাদের ডে-কেয়ার আরও অনেক কিছু– যা নিউ ইয়র্কের শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের রোজকার জীবন খানিকটা সহজ করে দেবে– সেই বার্তা পৌঁছে নিয়ে যেতে শুরু করলেন সাধারণ মানুষের বাড়ির দরজায় দরজায়। তারপরে একটা ইতিহাস রচনা হল।

প্রচারের সময় মামদানি

এখন প্রশ্ন আসে আমি বা আমার মতো সাধারণ মানুষ, যারা নিউইয়র্কে থাকি না, তারা কেন এইভাবে আকৃষ্ট হলাম একটি মানুষের ক্যাম্পেনে? নিউ ইয়র্কের সঙ্গে তো আমাদের ভবিষ্যৎ সরাসরি জড়িত নেই। আমার মনে হয় কারণটা হল এই যে, প্রত্যেকদিনই ‘আজ আবার কী হতে চলেছে’ দিনের সঙ্গে আমার মতোই আমেরিকাবাসীর আগে পরিচয় ছিল না। কখনও সম্পূর্ণভাবে সরকারের কোনও সংস্থা বন্ধ করে ছাঁটাই করে দেওয়া হচ্ছে কর্মচারীদের, কোনও সময়ে শহরে এসে পৌঁছচ্ছে রাষ্ট্রীয় বাহিনী, হানা দিচ্ছে বাড়িতে, দোকানে, শপিং মলে– তুলে নিয়ে যাচ্ছে বেআইনি অভিবাসীদের, কখনও বা তারা বেআইনিও নয়, কখনও কলেজ ইউনিভার্সিটি থেকে গ্রেফতার করা হচ্ছে বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের– রাষ্ট্র-বিরোধিতার অভিযোগ এনে, কখনও অন্য দেশের ওপর ইচ্ছেমতো ট্যারিফ বসানো হচ্ছে আর এর বিরোধিতা শুধুমাত্র আসছে, বলতে গেলে, বিচার বিভাগ থেকে।

রাষ্ট্রনায়কের আচার-আচরণ থেকে, যে কোনও বিষয়ে তার সিদ্ধান্ত কী হতে চলেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষ যেন একটা অবিরাম শক-ট্রিটমেন্টের মধ্যে দিয়ে চলেছে। সেই সময়ে জোহরান মামদানি সোজা দাঁড়িয়ে সত্যি কথা বলার, বিশেষ করে নীতিগতভাবে যা ঠিক, তা বলার আস্পর্ধা দেখাচ্ছেন! নিজের ইসলাম ধর্মের বিষয়ে যেমন খোলা, তেমন ডেমোক্র্যাটিক, রিপাবলিকান পার্টি নির্বিশেষে আমেরিকার রাজনীতিবিদরা যখন ইজরায়েলপন্থী, তখন প্যালেস্টাইনে ‘গণহত্যা’ হচ্ছে বলতে তিনি নিঃসংশয়। তিনি তাঁর প্রচারের জন্য কোনও কর্পোরেশনের থেকে কোনও অনুদান নেননি। তিনি বিলিনেয়ার নিউ ইয়র্কবাসীদের থেকে কর আদায়ের কথা বলছেন। আকৃষ্ট হবে না মানুষ?

এই সমস্ত কিছুই আশ্চর্যজনক ভাবে জিতিয়ে দিল জোরহানকে, নিউ ইয়র্কের মেয়র নির্বাচনে। সে যেন এক ম্যাজিক মুহূর্ত! উগান্ডায় জন্ম হওয়া, ইসলাম ধর্মাবলম্বী, স্বঘোষিত ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্ট একজন মানুষ সমস্ত প্রচলিত ধারণাকে উল্টেপাল্টে বহু মানুষের আশা-আশঙ্কা মেশানো আলোর মাঝখানের দাঁড়িয়ে শপথ নিলেন।

প্রচারের আলো ছিল না সেইরকম, নিউইয়র্ক থেকে কয়েকশো মাইল দূরে পুনর্নির্বাচিত হয়ে দ্বিতীয় টার্মের জন্য শপথ নিলেন বস্টনের মেয়র মিশেল উ। তিনিও এই ৪০ হলেন, রাজনীতিক হিসাবে তরুণ, তিনটি ছোট সন্তানের মা। তাইওয়ান থেকে আসা অভিবাসিত বাবা-মার সন্তান, শিকাগো থেকে হার্ভার্ডে পড়তে আসা, থেকে যাওয়া, শহরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে প্রথমে সিটি কাউন্সিলে নির্বাচিত হওয়া, তারপর বস্টনের প্রথম সংখ্যালঘু, মহিলা মেয়র হিসাবে নির্বাচিত হন। বস্টনের ২০০ বছরের ইতিহাসে প্রথম মহিলা মেয়র, প্রথম অশ্বেতাঙ্গ মেয়র। অনেকখানি পথ, অনেকগুলো যুদ্ধ জয়। পরিবার থেকে সেইরকম কিছু সহায় ছিল না, উলটে বেশ অল্প বয়স থেকে ছোট ভাইবোনদের দেখাশোনার দায়িত্ব নেন।

বস্টনের মেয়র মিশেল উ

শহর হিসেবে বস্টনে অনেক সম্প্রদায়ের, অনেক দেশ থেকে আসা অভিবাসী মানুষের বাস– দারিদ্র্য, বাসস্থানের সমস্যা, বড় স্কুল সিস্টেম, পরিবহণ সব কিছু নিয়েই বহু সমস্যা। এর মধ্যে সাধারণ মানুষের জন্য সরকারি আবাসন প্রকল্প বাড়ানো, বস্টনের বিরাট পাবলিক স্কুলের উন্নতি, একদম ছোট বাচ্চাদের জন্য বিনামূল্যে প্রি-স্কুল, বিনামূল্যে আংশিক পরিবহণ ব্যবস্থা– এ সমস্ত কিছুর জন্য লড়েন। প্রথম টার্মে যথেষ্ট ভালো কাজ করেন মিশেল। উদাহরণ স্বরূপ, তিনি বস্টনের পাবলিক হাই স্কুলগুলোর সমস্ত ছাত্রছাত্রীদের জন্য গত গরমের ছুটিতে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছিলেন, যদি তারা কাজ করতে চায়। আমেরিকায় ১৬ বছর বয়স থেকে আইনগত ভাবে কাজ করা যায় এবং হাই স্কুলে পড়াকালীন ছোট খাটো কাজ করা খুবই প্রচলিত একটা বিষয়। কাজ করলে ছুটিতে ছাত্রছাত্রীরা যেমন অর্থ উপার্জন করবে, তেমন ব্যস্ত থাকবে। ব্যস্ত থাকলে ওই বয়সে অপরাধপ্রবণতার দিকে মন যায় না। কী সুচিন্তিত একটা ভালো পদক্ষেপ!

তবে একটা শহরের মেয়র নিজের কাজ কী করছেন, তা জাতীয় স্তরে গুরুত্ব পায় না যতক্ষণ না তিনি কোনও বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। বেআইনি অভিবাসীদের স্যাংচুয়ারি শহর হিসেবে এমনিতেই বস্টন বর্তমান সরকারের নজরে খারাপ শহরের তালিকায় ছিল। তাই এই বছরের মার্চ মাসে আরও চারটি বড় শহরের মেয়রের সঙ্গে ‘বেআইনি অভিবাসী অপরাধীদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগের জবাবদিহি করার জন্য’ ওয়াশিংটন ডিসিতে কংগ্রেসনাল কমিটির সামনে জবাবদিহি করতে যেতে হয় মিশেলকে। ছোটখাটো শান্ত চেহারার মিশেলের, বর্তমান সরকারের আক্রমণের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের অভিযোগ নস্যাৎ করার ওই শুরু। তিনি সমস্ত অভিযোগ নস্যাৎ করে দিয়ে প্রমাণ করেন, বস্টনের অপরাধের সংখ্যা গত পাঁচ বছরে উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে গিয়েছে, পুলিশ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে। তিনি বলেন, আমেরিকায় মানুষ কীভাবে অনুপ্রবেশ করছে আর তারপর কোথায় যাচ্ছে, সে-বিষয়ে তার কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। বস্টন অভিবাসীদের শহর। বস্টনে আসা যে কোনও মানুষের খাদ্য, সুস্থতা আর নিরাপত্তার দায়িত্ব শহর প্রশাসনের। যে সময়ে ট্রাম্প সরকার অভিবাসীদের সমূলে উৎখাত করার জন্য বিভিন্ন শহরে ন্যাশনাল গার্ড পাঠাচ্ছেন, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে মিশেল উ কমিটির সামনে বলেন, অভিবাসীদের অপরাধী বলে দাগিয়ে দেওয়া বন্ধ করা হোক। অপরাধ বন্ধ করতে হলে বন্দুকজনিত আইনে পরিবর্তন আনা হোক, মেডিকেল রিসার্চে অনুদান ফিরিয়ে দেওয়া হোক, বয়স্ক, আর্থিকভাবে অনগ্রসর, বিশেষ ভাবে সক্ষম মানুষদের জন্য ইনসিয়োরেন্স মেডিকেল ফিরিয়ে আনা হোক। এরপর শুরু হয় ডিসি থেকে যে কোনও বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক অনুদান বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি, আগামী বছর বস্টন থেকে বিশ্বকাপ ফুটবলের খেলাগুলি স্থানান্তরিত করার হুমকি, বস্টন পুলিশের থেকে ডিপার্টমেন্ট অফ জাস্টিস-এর ফান্ডিং তুলে নেওয়ার হুমকি। এই বছরের প্রাথমিক নির্বাচনে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর থেকে প্রায় ৫০ শতাংশ ভোটে এগিয়ে ছিলেন মিশেল। তাই তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী মূল নির্বাচন থেকে প্রার্থীপদ তুলে নেন। মিশেল মূল নির্বাচনে অপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যান।

বস্টনে প্রচারসভায় মিশেল উ

ভারতে অনেক সময় দেখেছি, একজন প্রার্থী, যিনি কোনও জায়গাতে কখনও থাকেননি, সেখানকার মানুষ, পরিবেশ, সমস্যার সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও অনায়াসে নির্বাচনের টিকিট পেয়ে যান। জন প্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার পরও সেখানে ফিরে যান খুব কম। নির্বাচনী প্রচারের সময়ে করা প্রতিশ্রুতি বাষ্পের মতো মিলিয়ে যায় হাওয়ায়। তাই মিশেল, জোহরানের মতো মানুষগুলোকে যখন দেখি, কীভাবে চেনেন নিজের শহর, তাঁদের নির্বাচনী ক্ষেত্র নিজের হাতের পাতার মতো, শ্রদ্ধা-মেশানো বিস্ময় কাটে না।

আর? অবশ্যই সাহস। সৎ সাহস। যখন আগ্রাসন আর হুমকির সামনে বিরোধী দলের পোড়খাওয়া নেতারা প্রায় অস্তিত্বহীন, নিজের বিশ্বাসের মাটিতে ঋজু নিঃশঙ্ক দাঁড়িয়ে থাকা মানুষই খুঁজছি আমরা। নেতৃত্ব দেওয়ার মতো মানুষ। যাঁদের দেখে আমরা জানব, ভীষণ আগ্রাসন, মিথ্যা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিজেদের বিশ্বাসে অটল থাকা যায়।

………………………….

রোববার.ইন-এ পড়ুন মহুয়া সেন মুখোপাধ্যা-এর অন্যান্য লেখা

………………………….