ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত আইনভঙ্গের অভিযোগে কলকাতা পুলিশ শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ৭,৩৮৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এর মধ্যে হেলমেট না পরে বাইক চালাতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন প্রায় ৩,৪২৩ জন। বেপরোয়া গাড়ি চালানোর অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছে কমপক্ষে ৪০৪ জন। মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানোর অভিযোগে ৬৭৭ জন। অভব্য আচরণের অভিযোগে ৮৭৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও ২৮৮৫ জনকে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। যা সচেতন বাঙালির অর্জিত গৌরবময় পরিসংখ্যান!
ঢাকের বাদ্যিতে ভেসে পুজো ব্যাপারটা প্রতিবারই আসে। প্রকৃতির অ্যালার্ম সেট করা। কাশফুল আর শিউলির শোভায় হরেক কিসিমের কাব্য-কবিতা ঝরে পড়ে। ইদানীং আবার মেঘের সঙ্গে ভাবাবেগ মেলানো ফেসবুকীয় ছড়াও চোখে পড়ে। আকাশবাণী, চণ্ডীপাঠ, নতুন জামাকাপড়, ছুটিছাটা, ঠাকুর দেখা, এগরোলে কামড়, প্রেমিকার হাত ধরে পায়ের ফোসকার জন্ম– এগুলো বাঙালি জীবনে অবিচ্ছেদ্য ঘটনা, তবে তা নিতান্তই সামান্য ব্যাপার। উৎসব মোচ্ছবের আকার না নিলে বাঙালির আসল পরিচয় পাওয়া যায় না কি?
মোচ্ছব হবে আর ঢুকুঢুকু থাকবে না? সেই মহালয়ার আগে থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় মিম ঘুরছে– ‘স্টক তুলে নিয়েছেন তো?’ কীসের স্টক তা বোঝার জন্য মনীষী হওয়ার কোনও দরকার নেই। একদিকে সুরাভক্তের কাছে মদ্যপান পুণ্যকাজ, অন্যদিকে তা রাজকোষের জন্যও লাভজনক, কিন্তু তারও একটা তহজিব আছে সুস্থ প্রক্রিয়া আছে। না না, আমি মদ্যপান বিরোধী নই, কিন্তু বে-আক্কেলে ফুর্তির বিপক্ষে তো বটেই!
একটা প্রজাতির জলে-জঙ্গলে-ঝোপেঝাড়ে-মণ্ডপের পিছনে একটু সুবিধাজনক জায়গা পেলেই হল। নেশায় ঢুলু ঢুলু চোখ, মাইকে বাজছে– ‘কথা হয়েছিল।’ পানীয়র সঙ্গে ‘শুধু তুমি এলে না’-র ব্যথা দ্রবীভূত হয়ে রক্তে মিশে গেছে। যাই বলো বাওয়া! বচ্ছরে একবার এমন সর্বজনীন মোচ্ছব আসে, এক-দু’দিন মস্তি না করলে ঠাকুর পাপ দেবে। এ অবস্থায় বাইকে ধাঁ করে যদি না যাই, তালে কবে! এমন মওকা মওকা তো ভারত-পাকিস্তান ম্যাচেও আজকাল মেলে না। আইন ভাঙার এমন নিজস্ব বিধান তৈরি করে নেওয়াই যেন মোচ্ছবের মূলমন্ত্র।
পাপ-পুণ্যর বিচার না হয় হল, সে চিত্রগুপ্তের ডিপার্টমেন্ট। যমরাজের ভারি মনখারাপ। তাঁর ছুটি নেই। সপ্তমী-অষ্টমীতেও নেই৷ বেচারা ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন– ‘তোমার ছুটি আমার নয়।’ তাই দেখে কমেন্টে কে যেন লিখেছে– দাদা ওটা আমাদের বিজ্ঞাপনী লাইন। নাম উল্লেখ করুন, আর নইলে নিদেনপক্ষে ‘সংগৃহীত’ লিখুন। যমরাজ পাত্তা দেননি। মনে মনে বলেছেন– ক্রেডিট দেব না যা। কী করবি করে নে। একে ছুটি নেই, ডিএ বাড়েনি, এদিকে ওভার ডিউটি। নিজস্ব বেদনার কথা লিখেছি, তার আবার কীসের ক্রেডিট? ভাগ!
যমরাজের ওভারটাইমই বটে! ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত আইনভঙ্গের অভিযোগে কলকাতা পুলিশ শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ৭,৩৮৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এর মধ্যে হেলমেট না পরে বাইক চালাতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন প্রায় ৩,৪২৩ জন। বেপরোয়া গাড়ি চালানোর অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছে কমপক্ষে ৪০৪ জন। মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানোর অভিযোগে ৬৭৭ জন। অভব্য আচরণের অভিযোগে ৮৭৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়া আরও ২৮৮৫ জনকে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। যা সচেতন বাঙালির অর্জিত গৌরবময় পরিসংখ্যান!
এ তো শুধু কলকাতার হিসাব, এতেই বোঝা যাচ্ছে বাংলা জুড়ে অগুনতি কেসে যমরাজকে স্পটে যেতে হয়েছে, অ্যাসাইনমেন্ট সফল হয়েছে। কিছুক্ষেত্রে যমবাবাজি অসফল হয়েছেন ডাক্তারবাবুদের বদান্যতায়। যে সুবোধ বালক সারা বছর ‘মেটিয়াবুরুজে হেলমেট পরে না’ সংক্রান্ত চিন্তায় স্থির থাকতে পারে না, সে-ই বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে বেরিয়ে হেলমেট ছাড়া একটা সংক্ষিপ্ত বাইক রেস সেরে নিল।
একদিকে যমরাজ এবং অন্যদিকে উর্দিধারীদের চিরন্তনী খেলা। আশ্চর্য গোথাম সিটি নেমে এসেছে বাংলায়। যমরাজ নিয়ে যাবে, পুলিশ আইনশৃঙ্খলা ঠিক রেখে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাবে। এই সূত্র ধরেই এবারে আইনশৃঙ্খলা হোক বা ট্রাফিক, বেশ নিপুণ হাতেই নিয়ন্ত্রণ করেছেন তাঁরা।
পুলিশ মানে এই, পুলিশ মানে ওই। বিস্তারিত না লিখলেও দিব্যি বোঝা যায় মানুষের কাছে পুলিশের সাধারণ ইমেজ। তা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মতামত থাকবেই। তার মধ্যেও একটা শ্রেণি আছেন যাঁরা উৎসবের দিনে পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে বেরতে পারেননি। ‘ডিউটি’ বড় বিষম বস্তু! ‘পুলিশ খুব খারাপ’ জাতীয় সরলীকরণ করে ফেলার আগে, মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি না চালানো, গতি সীমা লঙ্ঘনের মতো বিষয়গুলি মেনে চলার দায়িত্ব যে আমাদেরও থাকে, সেগুলো ভুলে যাওয়ার নামই হল ‘আমাদের মর্জিই চলবে।’
কোল্ড ড্রিংকে উগ্র পানীয় মেশানো জলপথে ভ্রমণ, ছড়িয়ে লাট, পোস্টে ধাক্কা মেরে রক্তারক্তি। নিরীহ পথচারীদের আক্রান্ত হওয়া। এসব আমাদের উৎসবের উৎশৃঙ্খলতা। যা ক্রমশ বাড়ছে।
উৎসবের রাত, তার মধ্যে অতন্দ্র প্রহরী হয়ে জেগে থাকেন উর্দিধারীররা। যে উর্দিধারীদের ভারতীয় সিনেমা ৯০ ভাগ ক্ষেত্রেই দেখিয়েছে প্রায় ভিলেনরূপে। ইদানীং, পুলিশকে নায়ক করে দেখানোর একটা রীতি জেগে উঠেছে বটে, তবে সেখানেও দেখবেন, বাকি পুলিশরা সেই নায়ক-পুলিশের পাশে এসে মোটেই দাঁড়াচ্ছেন না। বরং, তাকে যত সম্ভব বিপর্যস্ত করে তোলাই উদ্দেশ্য। শেষমেশ দেখা যায়, নায়ক-পুলিশ আইনি পথে না গিয়ে বেআইনেই সমাজকল্যাণের দিকে পা বাড়িয়েছেন। মোটের ওপর, বেআইন সত্য হয়ে ওঠে।
পুজোয় কিন্তু আইনই জিতল। জিতলেন পুলিশরা। শুধু শৃঙ্খলার শৃঙ্গজয় নয়, মানুষের মন। ‘মাতল রে ভুবন’ ভাইবে একটা শহর তাঁদের ভরসাতেই ঘুরল, খেল, আড্ডা মারল। আগলে রাখল নস্টালজিয়া। আপনাদের জন্য, হে পুলিশ, সেলাম রইল।
যমরাজ কিংবা চিত্রগুপ্ত, আপনারা বরং পুজোর ছুটিতে বেড়াতে যান দূরদেশে। সেখানেও মোচ্ছব করবেন? তা করুন, তবে একটু সামলে, কেমন?
জীবনের বাকি শাখা-প্রশাখা থেকে বাদুড়ের মতো ঝুলতে দেখা যায়, ‘অকৃতজ্ঞ’, ‘বিশ্বাসঘাতক’, ‘তঞ্চক’ নামের নানা কুটিল শব্দবন্ধকে। যারা উদর নয়, হৃদয়কে তাক করে। বারবার। যন্ত্রণার ক্ষেপণাস্ত্র চালিয়ে বুকের বাঁ দিকটা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিতে থাকে সুযোগ পেলে।