Robbar

হ্যালো, তুমি শুনতে পাচ্ছ কি?

Published by: Robbar Digital
  • Posted:November 17, 2025 10:41 am
  • Updated:November 17, 2025 10:43 am  

মনে পড়ছে, খুব ছোটবেলায় প্রথমবার যখন ফোন করেছিলাম, এক ধনী বন্ধুর বাড়ি থেকে পোস্ট অফিসে আমাদের পাড়াতুতো জেঠুকে। রিং হওয়ার পর যখন ‘হ্যালো’ শব্দটা যখন কানে এল তখনই সব গুলিয়ে, ঘাবড়ে গিয়ে বলেছিলাম, ‘জেঠু, আপনি আমার প্রণাম নেবেন। আশা করি, সবাই কুশলে আছেন, আমি সমীর বলছি।’ দূরে কারও সঙ্গে কথা বলার একটাই মাধ্যম ছিল তখন, চিঠি লেখা। মুখোমুখি কথা বলার ভাষার ধরন আর চিঠিতে লেখা ভাষা আলাদা। টেলিফোনে বহু দূরের কারও সঙ্গে কথা বলার ভাষাটা কি আর এক রকমের? তাই গুলিয়ে গিয়েছিল টেলিফোন আর চিঠির মধ্যে।

সমীর মণ্ডল

১২.

আগের পর্বে কথা হচ্ছিল শব্দ নিয়ে। সত্যি, শব্দের খেলা সেই কবে থেকে! ছোটবেলায় দেশলাই বাক্সে সুতো লাগিয়ে দূরে আর একটা বন্ধুর হাতের দেশলাই বাক্সে। টেলিফোন টেলিফোন খেলা। ফেলে এসেছি সেসব দিন। ধানখেতের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে টেলিফোনের তার। টেলিফোনের খুঁটির গায়ে কান পেতে শোনার চেষ্টা করতাম, ভেতরে যে সমস্ত কথা যাচ্ছে সে কথার কিছু কিছু শোনা যায় কি না।

শিল্পী: সমীর মণ্ডল

না, কখনও টেলিফোনের খুঁটির মধ্যে কান পেতে কারওর কথা শুনতে পাইনি। অস্পষ্ট কথাও নয়, একটা পোঁ পোঁ কিংবা ভোঁ ভোঁ– একটানা আওয়াজ শুনতে পেয়েছি। সেগুলো ওইসব কথার সমষ্টিগত একটা শব্দ হয়তো। উপরে চলে যাওয়া তারে হাওয়া লেগে কম্পনের আওয়াজ। এখন আর ওই তার বেয়ে বেয়ে শব্দ যায় না। সবই বেতার।

আজও ভীষণ অবাক হই, ফোনের শব্দ কত দূরেই না যায়। মনে পড়ছে, খুব ছোটবেলায় প্রথমবার যখন ফোন করেছিলাম, এক ধনী বন্ধুর বাড়ি থেকে পোস্ট অফিসে আমাদের পাড়াতুতো জেঠুকে। রিং হওয়ার পর যখন ‘হ্যালো’ শব্দটা যখন কানে এল তখনই সব গুলিয়ে, ঘাবড়ে গিয়ে বলেছিলাম, ‘জেঠু, আপনি আমার প্রণাম নেবেন। আশা করি, সবাই কুশলে আছেন, আমি সমীর বলছি।’ দূরে কারও সঙ্গে কথা বলার একটাই মাধ্যম ছিল তখন, চিঠি লেখা। মুখোমুখি কথা বলার ভাষার ধরন আর চিঠিতে লেখা ভাষা আলাদা। টেলিফোনে বহু দূরের কারও সঙ্গে কথা বলার ভাষাটা কি আর এক রকমের? তাই গুলিয়ে গিয়েছিল টেলিফোন আর চিঠির মধ্যে।

এ বছর কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ছিল আস্ত একটি ‘নকল’ টেলিফোন বুথ

আমরা বড়দের জন্য ‘শ্রীচরণকমলেষু’ কিংবা ‘আশা করি সবাই কুশলে আছেন’ এই জাতীয় চিঠির পুরনো দিনের ভাষা ব্যবহার করতাম। মানুষটাকে যেহেতু দেখতে পাচ্ছি না তাই দূরের মানুষের সঙ্গে কথা বলার সময়ে আরও একটা জিনিস বোধহয় মগজে কাজ করে, মানুষটি যখন এইটা পড়বে তখন সে কী মুডে থাকবে, তার মানসিক অবস্থা কেমন হবে– সেই অনুযায়ী একটি ভাষার দরকার হয়। সামনে থাকলে আমরা একটা শব্দ বলেই তার মুখের অভিব্যক্তি দেখে বুঝতে পারি, পছন্দ হচ্ছে কি হচ্ছে না। চিঠিতে তা হয় না। তাই চিঠির ভাষা সবসময়ে খুব মার্জিত, বিনীত, সন্তর্পণ এবং সতর্ক।

সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘চারুলতা’ (১৯৬৪) সিনেমার দৃশ্য

কত অল্প সময়ের মধ্যেই টেলিফোনের প্রযুক্তি নানাভাবে বদলাতে বদলাতে একটা ছোট্ট মিনি কম্পিউটারের মতো মোবাইল ফোন হয়ে হাতে হাতে ঘুরছে সবার। ছোটদের হাতেও ঘুরছে। মা-বাবারা খুব বকছেন ছোটদের। মোবাইল নিয়ে খেলা নয়। আশ্চর্য, আমরাও কিন্তু ছোটদের মতো মোবাইল নিয়ে খেলি। দেশলাই বাক্স আর সুতো দিয়ে যে টেলিফোন টেলিফোন খেলেছি ছোটবেলায়, সেটা দেখে আমাদের অভিভাবকরা তো কখনও বকেনি। বুঝতে পারছি না, এখনকার খেলায় যদি সত্যিকারের ফোন হাতে থাকে, তাহলে বকার কি কোনও যুক্তি আছে? আমার তো মনে হয় না।

ছেলেমানুষি আর কৌতূহল আমার এখনও যায়নি। মাঝে মাঝেই ভাবি এই যে বেতারে শব্দ যাচ্ছে, ফোনে আমি কথা বলছি, সেই শব্দটা কি কোনও নির্দিষ্ট পথ ধরে যায়? আমি যদি ভারত থেকে আমেরিকায় কারও সঙ্গে কথা বলি তখন সেই শব্দগুলো কোন পথে যায়? সে কি আমাদের মুম্বইয়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে, আরব সাগর পেরিয়ে, দুবাইয়ের উপর দিয়ে ইউরোপ হয়ে আমেরিকায় যায়, নাকি পুবদিকে চিন-জাপান ঘুরে অ্যামেরিকায় পৌঁছয়? এমনও তো হতে পারে, সে রাশিয়ার দিকে চলে গেল প্রথমে, তারপর ঘুরে ঘুরে আমেরিকায়। কিংবা অস্ট্রেলিয়া হয়ে কখনও সখনও!

যে চিঠি আসার কথা, সচরাচর আসে না

চিঠির মতো সে কি ছোট ডাকঘর, বড় ডাকঘর হয়ে, কখনও রেলগাড়ি কখনও প্লেনে চেপে তারপরে পাড়ার ডাকঘরে এসে পিয়নের হাত দিয়ে আমার বাড়িতে পৌঁছে যায়? ভাবি, শব্দগুলো কীভাবে যায়? শব্দ যাওয়ার পথে বাধাবিঘ্ন নেই?  ট্রাফিক জ্যাম হয়ে গেলে শব্দ কি তার গতিপথ পাল্টায়? সে কি ডাইনে-বাঁয়ে চলে যায় কখনও কখনও? এমনও মনে হয় যে ‘আপনি কেমন আছেন?’ বাক্যটার তিনটে শব্দ কি একসঙ্গে গায়ে গায়ে যেতে পারে! হয়তো ‘আপনি’ চলে গেল পশ্চিম দিকে আর ‘কেমন’ চলে গেল উত্তরে। ‘আছেন’ বেচারা পুবে গিয়ে পথ হারিয়ে দক্ষিণে হাওয়া খেতে খেতে পশ্চিমে গিয়ে আমেরিকায় হাজির শেষমেশ।

ব্যাপারটা কীভাবে হয়, সেটার একটা প্রযুক্তিগত দিক ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু আমার মনে হয় সেটা ভয়ানক বিজ্ঞানসম্মত ঘটনা। অক্ষর দিয়ে না বুঝে মনে মনে বুঝে নিলেই তো হয়। যার কাজ সেই করুক। আমাদের কাজ, মনের খেলা, মগজের খেলা, সেটাই থাক না।

খুব যদি জানতে ইচ্ছে করে তাহলে অলীকবাবুকে জিজ্ঞেস করুন। এই অলীকবাবুকে মনে আছে তো? আমি এই সিরিজের শুরুতে এই অলীকবাবুর একটা পরিচয় দিয়েছিলাম। তারপরে কয়েকটি পর্ব লেখা হয়ে গিয়েছে। মাঝে অলীকবাবুর নাম নেওয়া হয়নি এই অলীকবাবু হচ্ছেন, অলীক ইজারাদার। সবজান্তা, সংক্ষেপে ‘এ আই’।

এই মোবাইল ফোনের শব্দ কীভাবে যাতায়াত করছে, তা নিয়ে অলীকবাবু কী বলছে শুনুন। আমি ওর থেকে যা পেয়েছি আপনাকে জানাচ্ছি, পছন্দ হলে নেবেন না হলে সময় নষ্ট করবেন না।

শব্দ তরঙ্গকে প্রথমে ইলেকট্রনিক সংকেতে রূপান্তর করা হয়। তারপর সেই সংকেত রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে মোবাইল টাওয়ার, স্যাটেলাইট ও ইন্টারনেট ব্যবহার করে অনেক দূরে পাঠানো হয়। এখানে একটা ব্যাপার বুঝতে হবে, শব্দতরঙ্গ নয়, বরং ডিজিটাল সংকেত (ইলেকট্রনিক ডেটা) ভারত থেকে আমেরিকায় যায়, এবং সেটাও পৃথিবীর গোলাকৃতির কারণে পুব বা পশ্চিম– যে কোনও দিক দিয়ে যেতে পারে।

শব্দ তরঙ্গ

তাহলে ভারত থেকে আমেরিকার ফোন কলের সংকেত কোন দিকে যায়? সাধারণত, আন্তর্জাতিক সাবমেরিন ফাইবার অপটিক কেবল দিয়ে অথবা স্যাটেলাইটের মাধ্যম আপনার প্রাপক দেশ পর্যন্ত এই ডেটা পাঠানো হয়। পূর্ব দিকে (প্যাসিফিক রুট, যেমন, জাপান হয়ে) এবং পশ্চিমে (আটলান্টিক রুট, মানে ইউরোপ বা মধ্যপ্রাচ্য হয়ে) কেবলগুলো উভয় দিকেই থাকে।

না, আমাদের কথার সবটাই আবার একসঙ্গে এক পথেও যায় না। কথাবার্তা বা ভয়েস কল ছোট ছোট ডেটা প্যাকেট আকারে ভেঙে যায়। প্রতিটি প্যাকেট স্বাধীনভাবে তার সবচেয়ে দ্রুত, ফাঁকা বা কার্যকর রুটে গন্তব্যে পৌঁছয়। আর অদ্ভুতভাবে শব্দগুলো ঠিক ঠিক জায়গায় জুড়ে আমাদের কানে পৌঁছে যায়। তবে এই পুরো কাজটা এত দ্রুত ঘটে (মিলিসেকেন্ডে), যে আপনি সাধারণত বুঝতেই পারবেন না সেসব ডেটা প্যাকেট ভিন্ন ভিন্ন পথে গিয়েছে।

ছোট করে এবার পশুপাখিদের শব্দ এবং শোনার জগতে আসি। অনেকদিন আগে একটা অদ্ভুত এলপি রেকর্ড দেখেছিলাম, যেটাতে নানা ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ রেকর্ড করা হয়েছে। সেখানেই শুনেছিলাম মানুষদের মধ্যে পুরুষরা যা শোনে, তার চেয়ে হাই ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ শুনতে পায় মহিলারা। কুকুর, মানুষের চেয়ে অনেক উচ্চ কম্পাঙ্কের আওয়াজ শুনতে পারে। হাতি আবার কয়েক কিলোমিটার দূর থেকেও শুনতে পারে গভীর, কম ফ্রিকোয়েন্সির, ইনফ্রাসাউন্ড। জলহস্তীর ডাক কেউ শোনেনি, তবে শুনেছি তারাও নাকি ডাকে আর অদ্ভুতভাবে সে ডাক শুনতে পায় একমাত্র জিরাফ। অর্থাৎ শব্দের বিশাল জগতে মানুষ কেবল একটি সীমিত পরিসরের শ্রোতা মাত্র।

জলহস্তী ও জিরাফ

এক পাড়ার পশুপাখির ডাক কখনও অন্য পাড়ার থেকে আলাদা। যেন গ্রামে আর শহরে তাদের নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষা। শহরের কুকুররা গাড়ির আওয়াজ, মানুষের পায়ের আওয়াজ, এমনকী, নির্দিষ্ট মোটরবাইকের শব্দ চিনে ফেলে। বিড়ালরা আবার ক্ষীণতম খসখসানিও শুনতে পারে। ইঁদুরেরা মানুষের শ্রবণসীমার বাইরের শব্দে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে। পাহাড়ের গুহায়, জঙ্গলে, বাদুড় এবং দু’-একটা প্রজাতির পাখি প্রতিধ্বনির সাহায্যে অন্ধকারে চলাফেরা করে, শব্দই তাদের চোখ। এমনকী, শহরের বাদুড় প্রতিধ্বনির সাহায্যে অন্ধকারে বিল্ডিং আর বৈদ্যুতিক তারের ফাঁকে পথ খুঁজে নেয়। সমুদ্রের গভীরে জলের মধ্যে প্রতিধ্বনির সাহায্যে যোগাযোগ রাখতে পারে ডলফিন এবং তিমিরাও।

বাদুরদল

শৈশবে বাদুড়ের নাম শুনলেই কেমন ভয় করত। একটা ভয়ের প্রতীক। গোয়েন্দা গল্পে বলুন কিংবা ভূতের, রক্তচোষা ইত্যাদি নানারকমের নাম। গল্পে বাদুড়ের এই যে রূপ তা হয়তো বাদুড় কালো বলে, হয়তো বা শুধুমাত্র রাতে দেখা যায় বলে কিংবা সচরাচর দেখা যায় না, তাই তাকে নিয়ে নানারকম গল্প তৈরি করা সহজ। তবে বাদুড় সম্পর্কে আমার ধারণা অনেক বদলে গিয়েছে। তার কারণ পরবর্তীকালে বাদুড়কে কাছ থেকে দেখেছি। খেলার ছলে বাদুড়, চামচিকে ধরেছি এবং দেখেছি যে ওদের গায়ের রং কালো নয়, দারুণ সুন্দর বাদামি, পাখার দিকটায় কালচে। অন্ধকারে কালো দেখায়। বাদুড়কে পুষতেও দেখেছি। আর সবচেয়ে অদ্ভুত লাগে, বাদুড় কী করে পায়ের আঙুলে গাছের ডাল ধরে মাথা নিচু করে ঘুমায়! পড়ে যায় না কেন?

বাদুড়ের আঙুলের গঠন এবং ব্যবহার কিন্তু আমাদের মতো নয়। আমাদের আঙুল যেমন সাধারণত খোলা থাকে আমরা শক্তি দিয়ে সেটাকে গোল করে বন্ধ করে কিছু একটা ধরি আর বাদুড়ের ক্ষেত্রে ওদের আঙুলগুলো বা পেশির অবস্থান এমনই যেটা গুটিয়ে থাকাটাই স্বাভাবিক। কোনও দরকার হলে ওরা ওটাকে শক্তি দিয়ে খুলে তারপরে উড়ে যায়। বরং ঘুমন্ত অবস্থায় ওদের শরীরের ওজন নিচের দিকে থাকায় আঙুলগুলো আরও বেশি শক্ত হয়ে কোন জিনিসকে আঁকড়ে ধরে থাকতে পারে।

এই তো কিছুদিন আগে পর্যন্ত জেনে এসেছি, বাদুড় অন্ধ। এখন জানলাম যে বাদুড় অন্ধ নয়, বেশ ভালোই দেখতে পায়। বরং অন্ধকারে যা দেখা যায় তার থেকে অনেক বেশি ভালো দেখতে পায়। শিকার করার ব্যাপারে মানে ফল, পোকামাকড় ইত্যাদি খোঁজার ব্যাপারে তার দৃষ্টিশক্তি বরং প্রখর। আর শোনার ব্যাপারে, সে যেন শব্দের মাস্টার!

প্রাকৃতিক গুহায় লেখক

আমাদের হাতের কাছে মুম্বইয়ের বোরিভেলিতে, সঞ্জয় গান্ধী ন্যাশনাল পার্কের ভিতরে বৌদ্ধদের ‘কানহেরি’ গুহা ছাড়াও আলাদা দু’-একটা দেশে বিশাল বড় পাহাড়ের গুহাতে ঢুকেছিলাম। অস্ট্রেলিয়ার কোনও কোনও জায়গায় আবার পাতালে বিশাল এলাকা জুড়ে ফাঁকা, ফাঁপা গুহা দেখেছি। একবার তো একটা বড় গুহার মধ্যে হাজার হাজার ঝুলন্ত বাদুড় হঠাৎ একসঙ্গে অন্ধকার গুহার মধ্যে ওড়াউড়ি শুরু করে দিল। অদ্ভুত, ধাক্কা তো লাগছিল না কিন্তু হাতে, নাকে, কানে কখনও তাদের শরীর ঘষে যাচ্ছিল। ভয় লাগছিল, কামড়ে না দেয়! ওই অন্ধকার গুহার মধ্যে তারা অনায়াসে ওড়াউড়ি করে এবং একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষে করা, সংকেত পাঠানো, সঙ্গীকে ডাকাডাকি, গল্পগুজব যা কিছু, তা ওরা শব্দ দিয়ে করে।

বাদুড় পরিবেশ উপলব্ধি করার জন্য তাদের স্বাভাবিক, সামাজিক ডাক এবং প্রতিফলিত শব্দ (প্রতিধ্বনি) উভয়ই ব্যবহার করে। বাদুড়ের ঝাঁকের মধ্যে নানারকম কিচিরমিচির শব্দ আমরাও শুনতে পাই। তার মানে ওরা প্রয়োজনে ফ্রিকোয়েন্সি বদল করে। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, চিকিৎসা ক্ষেত্রে সোনোগ্রাফি বা সমুদ্রের উপর থেকে তলদেশের দূরত্ব এবং চেহারার মাপজোক ইত্যাদি করা হয় এমনই এক সিস্টেমে, যাকে বলা হয়, ‘সোনার সিস্টেম’। প্রাণীদের এই জৈবিক সোনার সিস্টেমকে বলা হয়, ‘ইকোলোকেশন’। কী সুন্দর সুরেলা একটা নাম।

ঝুলন্ত বাদুড়

যোগাযোগ ব্যাপারটাকে আমাদের মানুষের মধ্যে প্রয়োগ করা কিংবা মানুষের ব্যবহারের মধ্যে ওটাকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করা যাক। বাদুড় যখন প্রতিধ্বনি পাওয়ার জন্য হাই ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ ছুড়ে দেয় সামনে, সেটাকে প্রাণীবিজ্ঞানীরা বলছেন ‘ক্লিক’। সেই ক্লিকের প্রতিধ্বনি ফিরে এসে তথ্য দেবে সামনে কী আছে, কেমন চেহারার জিনিস আছে, কত দূরে আছে ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, একটা বাদুড়ের ক্লিকের সঙ্গে অন্যান্য বাদুড়ের ক্লিকের শব্দ মিশে গিয়ে, জড়িয়ে গিয়ে একটা গোলমাল ঘটাবে না? কারণ একটা বড় গুহায় অন্ধকারে শত শত, হাজার হাজার বাদুড় একসঙ্গে ক্লিক দিচ্ছে তো। কিন্তু কোনও গোলমাল হয় না। কেন বলুন তো? প্রতিটি বাদুড়ের ক্লিক তার নিজস্ব ফ্রিকোয়েন্সির, আর মনোযোগ ১০০ ভাগ ওই ক্লিকের প্রতিধ্বনি ফিরে আসার ওপর। অন্যগুলো ওদের কাছে কেবল পারিপার্শ্বিক শব্দ মাত্র।

মানুষ কেমন করে শব্দ ছুড়ছে, সেই ব্যাপারে আসি। মানুষ যখন একে-অপরের সঙ্গে কথা বলে, সে একজন, দু’জন, কিংবা বড় জনসমাগমের মধ্যে, তখন তারও মুখ থেকে যে শব্দ বের হয়, অর্থাৎ তার ক্লিক, সেটাও কিন্তু একটা নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সির। তারও একটা নির্দিষ্ট চরিত্র থাকে। বাদুড়ের কাণ্ডকারখানার সঙ্গে তার বেশ মিল আছে কিন্তু। আপনার কী মনে হয়?

জমাটি ভিড়ের আড়ালে কথা। কফি হাউস, কলেজ স্ট্রিট

অনেক ভিড়ের মধ্যে, যেমন বিয়ে বাড়িতে কিংবা খেলার মাঠে অথবা পুজো প্যান্ডেলে– এ সমস্ত জায়গায় কথোপকথন চলার সময়, আপনি বেশিরভাগ সময়, আপনার কথোপকথনের উপর মনোযোগ দিয়ে থাকেন। আপনি অন্যরা কী বলছে, তা স্পষ্টভাবে শুনতে পাচ্ছেন না। অথচ আপনি নিজের এবং আপনার সঙ্গে যারা কথা বলছে তাদের কথা কিন্তু ঠিক শুনতে পান।

ককটেল পার্টি

অন্য শব্দগুলো আপনার মাথায় ঢোকে না এমন নয়। কেবল আপনার মাথা সেগুলোকে নিতে চায় না। সেগুলোকে এড়িয়ে যাওয়াটাই আমাদের অভ্যেস। আজকাল বিয়েবাড়ি, মিটিং-মিছিল– এ সমস্ত জনসমাগম ছাড়াও শহরের একটি আধুনিক মিলনক্ষেত্র হচ্ছে ‘ককটেল পার্টি’, সেখানে যে ঘটনাটা ঘটে সেটা আরও মজার। আমরা যার সঙ্গে কথা বলছি সেটা তো বলছিই,  দূরে কেউ আছে, চার-পাঁচ জনের দূরত্বে তার নাম ধরে যদি ডাকি, সেও সাড়া দেয়। কী করে? ওর নামটা বলাতে অন্যদের কথোপকথন থেকে বেছে নিল এই নামের চেনা শব্দটা। আমার কণ্ঠস্বরও হয়তো চেনা লাগতে পারে, সেই অর্থেও। এই ককটেল পার্টিতে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল অনেক লোক থাকা সত্ত্বেও এখানে কিন্তু নির্দিষ্ট জায়গায় আর সিটে বসে নেই কেউ। সবাই প্রায় পরিচিত, একে-অপরের সঙ্গে দেখা করার জন্য ঘুরে ঘুরে কথা বলছে। ব্যাপারটা কিন্তু খেলার মাঠেও নেই, বিয়েবাড়িতে নেই।

সবশেষে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? ককটেল পার্টিতে সবার সঙ্গে দেখা হওয়া, কথা হওয়া, ভাব প্রকাশের আদান-প্রদান করার কোনও অসুবিধেই হল না কারও। এইখানে আমি জোর গলায় বলতে পারি, মানুষের সঙ্গে বাদুড়ের বোধহয় এই একটা বিষয়ে দারুণ মিল।

…পড়ুন অল্পবিজ্ঞান-এর অন্যান্য পর্ব…

পর্ব ১১: ‘শব্দ’ শুধুই আওয়াজ নয়

পর্ব ১০: শিল্পকলায় বিষ্ঠা মানে ব‍্যঙ্গ, বিদ্রুপ অথবা প্রতিবাদ

পর্ব ৯: বাস্তব আর ভার্চুয়ালের সীমান্তে দাঁড়িয়ে হাইব্রিড আর্ট প্রশ্ন করতে শেখায়– শিল্প কী?

পর্ব ৮: মগজে না ঢুকলে শিল্পও আবর্জনা

পর্ব ৭: ছবির অসুখ-বিসুখ, ছবির ডাক্তার

পর্ব ৬: বিসর্জনের মতোই একটু একটু করে ফিকে হয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর রং ও রূপ

পর্ব ৫: জীবন আসলে ক্যালাইডোস্কোপ, সামান্য ঘোরালেই বদলে যায় একঘেয়ে নকশা

পর্ব ৪: কুকুরেরই জাত ভাই, অথচ শিয়াল সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি?

পর্ব ৩: অন্ধকারে অল্প আলোর মায়া, ফুরয় না কোনওদিন!

পর্ব ২: বজ্রবিদ্যুৎ ভর্তি আকাশে ঘুড়ি উড়িয়ে আমাদের চিরকালের নায়ক হয়ে আছেন বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন

পর্ব ১: বস্তু নাকি ভাবনা, শিল্পকলায় কী খোঁজেন?