
উদয়নের বাগানটির পরিকল্পনা করেছিলেন কিমতারা কাসাহারা। জাপানের বাগান রবীন্দ্রনাথের ভালো লেগেছিল ‘জাপান যাত্রী’ পড়লে তা বোঝা যায়। কৃত্রিম সরোবর, তার মধ্যে দ্বীপ, সেখানে ভাস্কর্য– সবই তার উদাহরণ ল্যান্ডস্কেপ গার্ডনের উদাহরণ। উদয়নের জাপানি বাগানে ফোয়ারা বাতিদান ইত্যাদিও আছে। মনে পড়বে, পাঁচ নম্বর জোড়াসাঁকো বাড়িতে অবনীন্দ্রনাথরা কাসাহারাকে দিয়ে জাপানি শৈলীতে বাগান নির্মাণ করেছিলেন। বাঙালির দুর্ভাগ্য যে সেই বাড়িটি তার বিপুল ঐশ্বর্য-সহ বিনষ্ট হয়ে গিয়েছে।
১০.
উদয়ন বাড়ির পাশাপাশি এর বাগান এবং পাশের অন্য স্থাপত্যর কথা না বললে উদয়নের আলোচনা সম্পূর্ণ হয় না। উদয়নের বাগান প্রায় সবটাই রথীন্দ্রনাথের পরিকল্পনা ও এক্সপেরিমেন্টের ফল। তিনি নিজে ছিলেন কৃষিবিজ্ঞানী, তার উপরে রসিক। বহু ফুলের ছবি এঁকেছেন তিনি, তার রং আর রেখার নৈপুণ্য ফোটোগ্রাফকে হার মানায়। তাঁর প্রদর্শনীর ক্যাটালগের ভূমিকায় স্টেলা ক্রামরিশ তাঁর আঁকা ছবিগুলিকে তাই ‘ফুলের পোট্রেট’ বলেছেন। বিভিন্ন জায়গা থেকে নানা গাছপালা সংগ্রহ করে আনতেন তিনি। গাছের চারা কলাম থেকে শুরু করে ভারতীয় অরণ্যের অখ্যাত লতাগুল্ম কিছুই তাঁর নজর এড়ায়নি। আম-পেয়ারা-লেবু-আতা গাছের ডালগুলি বেঁধে বেঁধে তাদের লতা তৈরি করেছিলেন রথীন্দ্রনাথ। আম ও পেয়ারার লতা এখনও উদয়নের পাশের বাগানে লোহার গ্রিলের পথের উপর, চোখে পড়ে। উদ্ভিদবিদ্যা নিয়ে তাঁর দু’টি প্রবন্ধও ‘নব পর্যায় বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ‘ফলের বাগান’ ও ‘বৃক্ষের আকার বিধান’। এই বাগানে দু’টি ময়ুর-ময়ূরী, সারস-সারসী ও কিছু সাদা পায়রাও ছিল।
শান্তিনেকতনের মূল ভূ-প্রকৃতি সম্পর্কে আমরা আগে আলোচনা করেছি। সে মাটিতে গোলাপ বাগান হওয়ার কথা নয়। কিন্তু রথীন্দ্রনাথ উদীচির সামনের জমিতে গোলাপও ফুটিয়েছিলেন। শেষ জীবন দেরাদুনে নিজের ডিজাইনে তৈরি মিতালি বাড়িতে কেটেছে তাঁর। সেই পরিপাটি বাগানের বিবরণ দিয়েছেন ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। বাগানের এই নেশা রবীন্দ্রনাথ ছোট মেয়ে মীরা দেবীরও ছিল। তাঁর সারাটি দিন কাটত মালঞ্চ বাড়ির বাগানে।
বাগানের একপাশে রয়েছে কিডনি আকারের পম্পা সরোবর। উদয়ন বাড়ির পিছনে। এই বাগান জাপানি শৈলীতে তৈরি। পম্পার জলে ছিল রাজহাঁস। পম্পার একপাশে রামকিঙ্কর বেজের করা মাছের ভাস্কর্য। ডিজাইনার গার্ডেন বা ল্যান্ডস্কেপিং বলতে অধুনা যেরকম বাগান বোঝায় তা এখানে পাওয়া যাবে। বাগানটির পরিকল্পনা করেছিলেন কিমতারা কাসাহারা। জাপানের বাগান রবীন্দ্রনাথের ভালো লেগেছিল ‘জাপান যাত্রী’ পড়লে তা বোঝা যায়। কৃত্রিম সরোবর, তার মধ্যে দ্বীপ, সেখানে ভাস্কর্য– সবই তার উদাহরণ ল্যান্ডস্কেপ গার্ডনের উদাহরণ। উদয়নের জাপানি বাগানে ফোয়ারা বাতিদান ইত্যাদিও আছে। মনে পড়বে, পাঁচ নম্বর জোড়াসাঁকো বাড়িতে অবনীন্দ্রনাথরা কাসাহারাকে দিয়ে জাপানি শৈলীতে বাগান নির্মাণ করেছিলেন। বাঙালির দুর্ভাগ্য যে সেই বাড়িটি তার বিপুল ঐশ্বর্য-সহ বিনষ্ট হয়ে গিয়েছে।

উদয়নের বাগানে রামকিঙ্করের কংক্রিটের কাজটিতে একটি বড় মাছের মুখে একটি ছোট মাছ। বড় মাছ ছোটকে গিলে খাচ্ছে– মাৎস্যন্যায়। উদয়নের শান্ত পরিবেশে এই ভাস্কর্য কেন? রামকিঙ্করকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। রামকিঙ্কর তার যা ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন তা একমাত্র তাঁর পক্ষেই সম্ভব।
‘রবীন্দ্রনাথের বাড়ির এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়াই আর মনে হয় এই লোকটাকে সারা জীবন চেঁচাতে হয়েছে চারদিকের ব্যাপারস্যাপার দেখে। জালিয়ানওয়ালাবাগ, হিজলি– তারপর দেখো, বাইরেও কত অঘটন– আফ্রিকায়– এখানে ওখানে। শেষে মরার সময়ও নিস্তার নেই। ট্যাঙ্ক, গোলাগুলি, আকাশ থেকে বোমা– ছাতু হয়ে যাচ্ছে এক একটা দেশ। ইশকুল বাড়ি, হাসপাতাল, মিউজিয়াম, খেতখামার বাছবিচার নেই। উনি চেঁচিয়েই যাচ্ছেন। কে শোনে সেই চ্যাঁচানি ? হুঁঃ, সভ্যদেশ। সভ্যদেশের মুখোশের দড়িগুলো সব খুলে যাচ্ছে। বেরিয়ে পড়ছে আসল পোর্ট্রেট৷

পম্পার জলের ধারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিড়ি খাই আর ঐ চ্যাঁচানি কানে আসে। একদিন মনে হলো– সত্যি বলছি তোমাকে–ঠিক মনে হলো যেন উনি দোতলার জানালা দিয়ে দেখছেন– ওঁর চোখের চাওনিটা আমার মাথায় পিঠে এসে বিঁধছে। তাড়াতাড়ি ফেলে দিই মুখের বিড়িটা।
তারপরই ওই কাজ। বড় গিলে খাচ্ছে ছোটকে। উনি এখনও দেখছেন। ওঁর কথায় কান দিচ্ছে না কেউ।’
উদয়নের একপাশে দোতলায় প্রতিমা দেবীর স্টুডিও তৈরি হয়। তার নাম ‘চিত্রভানু’। রবীন্দ্রনাথ কখনও কখনও থেকেছেন সে বাড়িতে। রাণী চন্দ লিখছেন,
‘একদিন, তাঁর রোগশয্যার কালেরই কথা– শান্তিনিকেতনে গুরুদেব তখন একটু ভালোর দিকে, উদয়নে থাকেন, একঘেঁয়ে দিন; বাগানের কোণে বৌঠানের একটা স্টুডিয়ো ছিল দোতলার উপর একখানি ঘর কাঁচে-ঘেরা; গুরুদেব নাম দিয়েছিলেন চন্দ্রভানু। সেই চন্দ্রভানুতে গুরুদেবকে আনা হল, একটু তো পরিবর্তন হবে তাঁর৷

চন্দ্রভানুতে আছেন গুরুদেব, মাঝে মাঝে ধরে বসিয়ে দেওয়া হয় কৌচে। কাঁচে-ঘেরা ঘর, শুয়ে-বসে সব সময়েই তিনি দেখতে পান বাইরেটা। বেশ খুশিতে আছেন।’
‘চন্দ্রভানু’ বলে রাণী চন্দ উল্লেখ করেছেন কেন বলা কঠিন। এ কি তাঁর ভুল না কি কোনও এক সময়ে নাম রাখা হয়েছিল চন্দ্রভানু? যাই হোক, এ বাড়িতে একসময় ডাক পড়ল রাণী চন্দের। রবীন্দ্রনাথের তখন নিজে লিখতে কষ্ট হয়। বলে যান, রাণী চন্দ লিখে নেন। তাই তাঁকে ডাকতেন ‘দ্বিতীয়া’ বলে। রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘কলমটা পাওয়া যাচ্ছে না।’ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘খোঁজ পড়ে গেল মশারির চাল পর্যন্ত।’ সকলেই হতবাক। তারপর বললেন, ‘আচ্ছা এই কলমটা নাও।’ তারপর বললেন, ‘দেখছ কী? লিখে ফেলো’। এইভাবে শুরু হল ‘গল্পসল্প’র ‘বিজ্ঞানী’ গল্পটি লেখা। অন্য গল্পগুলিও এইরকম হঠাৎ বলে ওঠা। হঠাৎ থেমে যাওয়া। এভাবেই হয়ে গেল গল্পসল্প।

একতলায় রথীন্দ্রনাথের কাজের ঘর গুহাঘর। সে ঘরটি বাইরে থেকে দেখলে গুহার মতো এবড়ো খেবড়ো পাথরের তৈরি বলে মনে হয়। রথীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর অনেকসময় এ ঘর থেকেই বিশ্বভারতীর কাজ পরিচালনা করতেন। কাঠের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন তিনি এই ঘরেই। ছোট আর নিচু এই ঘরের দেওয়ালে লতা জড়ানো, পাথর বসানো বলে আরও বেশি গুহার মতো লাগে দেখতে।
এত যে আয়োজন উদয়ন চত্বরে, রবীন্দ্রনাথ কি খুশি হয়েছিলেন এই রাজকীয় আয়োজনে? উদীচির সামনে গোলাপ ফুটেছে দেখে সকলেই খুশি। মৈত্রেয়ী দেবী লিখছেন,
‘কবি তো আনন্দিত কিন্তু সে আনন্দ একেবারে ক্ষোভশূন্য নয়– এই গোলাপ বাগান এখানে কেন? এ কেন লাইব্রেরীর সামনে নয়, এ তো হতে পারত সকলের । নিজের হাতার চৌহদ্দীর মধ্যে এর সীমা দেওয়া কেন? আমার যা কিছু আছে তা সকলের, এ তাঁর সব সময়ের কথা।’
রথীন্দ্রনাথের তাস খেলার শখ। রোজ তাসের সভা বসে উদয়ন বাড়িতে। রবীন্দ্রনাথের ভালো লাগে না। খবর নেন– ‘ঐ হো হো সভা জমেছে নাকি?’ মৈত্রেয়ী দেবী, রাণী চন্দ দু’জনেই এই তাসের আড্ডার কথা লিখেছেন। খোদ রবীন্দ্রনাথের পাশের ঘরে তাসের আড্ডা– রাবীন্দ্রিক রুচির সঙ্গে মানানসই নয় মোটেই। উদয়নের প্রাসাদ তাঁর ভালো লাগে না। প্রতিমা দেবী এ নিয়ে অনুযোগ করেন মৈত্রেয়ী দেবীর কাছে।

রবীন্দ্রনাথ ‘উত্তরায়ণ’-এ থাকলেও রথীন্দ্রনাথের ঠান্ডা সুন্দর প্রাসাদোপম ‘উদয়ন’-এ থাকতে চান না। শ্যামলীর মতো গরম বাসের অযোগ্য বাড়িতে থাকবেন, এমনকী, ওঁর রান্না পর্যন্ত পৃথক করতে বলেন, ওঁর নিজের ভৃত্যরা ওঁর জন্য সামান্য কিছু রেঁধে দেবে। উনি ফ্রিজিডিয়ারের ফল থাবেন না। কোনও মহার্ঘ দ্রব্য খাবেন না– এ বাড়ির রান্নাও খাবেন না।
উদয়ন বাড়ির প্রাসাদত্ব রবীন্দ্রনাথকে স্বস্তি দেয়নি। মৈত্রেয়ী দেবী আরও লিখছেন–
‘উদয়ন গৃহ দিনে দিনে একটি মিউজিয়ামের মতো সুন্দর হয়ে উঠেছিল– উদীচীর সামনে গোলাপ বাগানে বসেরার গোলাপ ফুটছিল– আর উদয়নের ফুলের বাগান জাপানী-বাগান ও মোগল-বাগানের ঐশ্বর্যের মেশামেশি। আমরা অল্পদিনের জন্য যেতাম, এখানকার শ্রী সৌন্দর্যের প্রভাবে আনন্দিত হয়ে ফিরে আসতাম।’
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ক্রমেই যেন নিঃসঙ্গ বোধ করছেন। উদয়নগৃহ তাঁর কাছে ‘রাজপ্রাসাদ’।
কিন্তু এই ‘নিঃসঙ্গ’ রবীন্দ্রনাথকে শেষ জীবনে বারেবারে থাকতে হয়েছে উদয়নেই। তাঁর আশ্রমের আদর্শ আর উদয়ন বাড়ির চত্বর– দুইয়ে কি তাহলে মিল হয়নি? এসব আলোচনা আসবে পরের কিস্তি দু’টিতে।
গ্রন্থঋণ:
১. শান্তিনিকেতন স্থাপত্য পরিবেশ এবং রবীন্দ্রনাথ, অরুণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
২. গুরুদেব, রাণী চন্দ
৩. স্বর্গের কাছাকাছি, মৈত্রেয়ী দেবী
৪. রথীন্দ্রনাথ, সম্পা. অনাথ দাস
আলোকচিত্র: রবীন্দ্রভবন আর্কাইভ, শ্রী শুদ্ধসত্ব ভট্টাচার্য ও লেখক
…………… পড়ুন কবির নীড় কলামের অন্যান্য পর্ব ……………
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved