Robbar

সাম্যই প্রকৃতির অন্তরের কথা, সলিল চৌধুরীর এই বিশ্বাস ডায়েরির পাতায় পাতায়

Published by: Robbar Digital
  • Posted:November 21, 2025 8:59 pm
  • Updated:November 21, 2025 8:59 pm  

সলিলের গণনাট্য-সুহৃদ জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র পাঁচের দশকে একটি গীতি-আলেখ্য রচনা করেছিলেন– ‘সংক্রান্তির গান’, যা ছিল ব্যাপ্ত বিশ্ববোধে অঞ্চলকথার অভিব্যক্তি। প্রায় এক দশক আগে নোটবইতে পাচ্ছি সলিল-ভাষ্যে সমজাতীয় চেতনারই অনুরণন। সংস্কৃতির বিবর্তন প্রসঙ্গে নিজেদের ‘জাতিগত বৈশিষ্ট্যের মৃত্যু না ঘটিয়ে’ তাকে ‘উন্নতিশীল পৃথিবীর এক পর্য্যায়ে স্থান পাবার উপযোগী’ করে তোলার প্রয়োজনীয়তাকে অগ্রাধিকার দিতে চাওয়া।

প্রিয়দর্শী চক্রবর্তী

৪.

১৯৪৩-এ সলিল চৌধুরীর প্রথম যৌবনের যে দিনলিপি, তা ঠিক যেন ডায়েরি-সুলভ নয়। বরং ‘খেরোর খাতা’ গোত্রীয় একটি ছোট্ট নোটবুক। আদপে তা পারিপার্শ্বিক সময়-সমাজ-মানুষ নিরীক্ষণে নৈর্ব্যক্তিক ভাবনাচিন্তায় নিজেকে গড়েপিটে নেওয়ারই অনুশীলন। বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন শিরোনামে পৃথক বিষয় বা আঙ্গিকে একান্ত লেখালেখির মাধ্যমে নিজেরই মত ও পথটুকু ধার্য করে নেওয়ার অভীপ্সা। এমনই একটি শিরোনাম– ‘এলোমেলো’।

ভাবনাচিন্তাগুলো যেখানে বিবিধ আলপথ বেয়ে গড়িয়ে এসে মিশে যেতে চাইছে সামগ্রিক কোনও চেতনার আধারে। যেমন, ‘১’ আর ‘২’-এর অধীনে কয়েকটি লাইন– গভীর ইতিহাসবোধে নিজেকে আপাদমস্তক সম্পৃক্ত করে তোলা। সাম্যবাদে অপার আস্থা আর মার্কসীয় দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের ভেতর দিয়ে নিজের অভ্যন্তরেই প্রগতি চেতনার উন্মেষ ঘটানোর যা বার্তাবাহক। মানবজন্মের জাত্যর্থ নির্ধারণে বুর্জোয়া-ধনতান্ত্রিক প্রভাব থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে জীবন-সংগ্রামে জিইয়ে থাকার কোনও সংকল্পে ১৯৪০-এর দশকের শুরুতে এভাবেই তিনি যেন বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপনে এবং নিজেই তার যুক্তিগ্রাহ্য সমাধানে উন্মুখ। যে সংকল্পের বোধনেই পরবর্তীকালে গীতিকার সলিল জোরালো প্রত্যয়ে তৈরি করে ফেলতে পারেন গান–

অধিকার কে কাকে দেয়?
পৃথিবীর ইতিহাসে কবে কোন্‌ অধিকার
বিনা সংগ্রামে
শুধু চেয়ে পাওয়া যায়?
কখনোই নয়, কোনোদিনও নয়
অধিকার কেড়ে নিতে হয়!
অধিকার লড়ে নিতে হয়!…

‘৩’ শীর্ষক লেখনীটুকু সলিলের তৎকালীন অগ্রজ বুদ্ধিজীবী গোপাল হালদারের উদ্ধৃতির অংশ, যা প্রচলিত সংস্কারের টানাপোড়েন থেকে মুক্ত যুগধর্মী সংস্কৃতিবোধের বিবর্তনের গুরুত্ব অনুধাবনের মাধ্যম যেন। ক্রমশ দেশজ সংস্কৃতি থেকে বিশ্ব-সংস্কৃতির বিস্তৃতির স্তরে মানস উত্তরণের আকাঙ্ক্ষা। চিন্তাচেতনায় রবীন্দ্রনাথকে ধ্রুব মেনে নেওয়া যুবক সলিলের তরফে সে-সময়ে যা ছিল নিতান্তই স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। আর তেমন উপলব্ধির সূত্র ধরেই যেন ‘৪’ শীর্ষক তুলনায় দীর্ঘ অংশটুকুর অবতারণা। সলিলের গণনাট্য-সুহৃদ জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র পাঁচের দশকে একটি গীতি-আলেখ্য রচনা করেছিলেন– ‘সংক্রান্তির গান’, যা ছিল ব্যাপ্ত বিশ্ববোধে অঞ্চলকথার অভিব্যক্তি। প্রায় এক দশক আগে নোটবইতে পাচ্ছি সলিল-ভাষ্যে সমজাতীয় চেতনারই অনুরণন। সংস্কৃতির বিবর্তন প্রসঙ্গে নিজেদের ‘জাতিগত বৈশিষ্ট্যের মৃত্যু না ঘটিয়ে’ তাকে ‘উন্নতিশীল পৃথিবীর এক পর্য্যায়ে স্থান পাবার উপযোগী’ করে তোলার প্রয়োজনীয়তাকে অগ্রাধিকার দিতে চাওয়া। পরবর্তী জীবনে সঙ্গীতকার সলিল চৌধুরী সুরের অবয়ব বা কাঠামো নির্মাণে প্রথম জীবনের এই উপলব্ধিকে ব্যবহার করতে চেয়েছেন বারে বারেই, লোকায়ত আর পাশ্চাত্য সুর-সংশ্লেষের মাধ্যমে।

………………..

বিশেষ কৃতজ্ঞতা: অন্তরা চৌধুরী, শুভঙ্কর দে

………………..

ডায়েরির ৯টি পাতা, পড়ুন এক ক্লিকে

প্রথম পর্ব সলিল চৌধুরী নোটবইয়ে এঁকেছিলেন রবীন্দ্রনাথের স্কেচ

 দ্বিতীয় পর্ব জাপানি খাতায় লিখতে গিয়ে সলিল চৌধুরীর প্রথম মনে পড়েছিল জাপানি বোমার কথা

তৃতীয় পর্ব ফ্যাসিজম কাব্যের মৃত্যু ঘটাতে পারে, ডায়েরিতে লিখে রেখেছিলেন সলিল