Robbar

কনটেন্টের ভিড়ে ক্ষীণ হচ্ছে দর্শকের স্মৃতি– মনোজ বাজপেয়ীর এই আশঙ্কা অমূলক?

Published by: Robbar Digital
  • Posted:November 23, 2025 5:51 pm
  • Updated:November 23, 2025 6:31 pm  

এই এত অডিও-ভিজ্যুয়াল কনটেন্টের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে বহু কণ্ঠস্বর, যাদের থেকে যাওয়ার কথা ছিল। যেমন, ‘হোমবাউন্ড’। ছবিটি যেরকম আলোচিত হওয়ার কথা ছিল, তা তো হয়ইনি, বরং মুক্তি পাওয়ার মাসখানেকের মধ্যে গতজন্মের স্মৃতির মতো আবছা হয়ে গেছে। ‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান ৩’-এর মূল অ্যান্টাগোনিস্ট জয়দীপ আহলাওয়াত, প্রাইমের উত্তর-পূর্ব ভারতে তৈরি হওয়া আরেকটি সিরিজ ‘পাতাল লোক ২’-এর কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে অভিনয় করেছিলেন– এই বছরেরই গোড়ার দিকে মুক্তি পেয়েছিল। অথচ, মানুষের মন থেকে দু’-একটি মুহূর্ত ছাড়া প্রায় সবই মুছে গেছে।

রণদীপ নস্কর

সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে মনোজ বাজপেয়ী বলেছেন, তিনবছর আগে মুক্তি পাওয়া ‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান’-এর দ্বিতীয় মরশুমে কী হয়েছিল, তা মানুষ এতদিনে ভুলে গেছেন। আগের সিজনের ধারাবাহিকতা মাথায় রেখে নতুন সিজনটি দেখা দুরূহ– মাঝে গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। এই মন্তব্যের সপক্ষে মনোজ বাজপেয়ী যে যুক্তিটি খাড়া করেছেন, তা ফেলে দেওয়ার মতো তো নয়ই, বরং খতিয়ে ভেবে দেখার মতো। তিনি বলছেন, আজকাল ইন্টারনেটে অডিও-ভিজ্যুয়ালের এমন ঢালাও সম্ভার, ফি-সপ্তাহে এত নতুন নতুন সিনেমা-সিরিজ মুক্তি পায়; মানুষের পক্ষে আলাদা আলাদা গল্পের ঘটনা মনে রাখা একপ্রকার অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই যে সিরিজ তিন বছর আগে মুক্তি পেয়েছে, তার প্রতিটি প্লট পয়েন্ট, চরিত্রের যাত্রাপথ মনে থাকবে না– সে-ই তো স্বাভাবিক।

একথা মোটামুটি স্বতঃসিদ্ধ যে, আমরা একটা অডিও-ভিজ্যুয়াল কেওসের মধ্যে বেঁচে আছি। চোখের সামনে এতরকম রূপে এতরকমের দৃশ্য-শ্রাব্য ‘কনটেন্ট’ (তুলনামূলকভাবে ভালো শব্দের অভাবে) বর্তমান, একটি আরেকটির ঘাড়ে চড়ে বসলে, একটির অভিঘাত আরেকটিকে ঢেকে দিলে দোষ দেওয়া যায় না কোনও মতেই। ধরুন আপনি স্থির করলেন, কোনও মতেই বাইরে বেরিয়ে মোবাইল ঘাঁটবেন না। তাতেও কি নিস্তার আছে? মেট্রো-স্টেশনে টিভি চলছে, সেখানে নাগাড়ে কোনও ছবির বিজ্ঞাপন অথবা গান, না হলে সংবাদ চলছে। পাশে বসা যাত্রী হেডফোন ছাড়াই পরের পর রিল দেখছেন; অথবা সদ্য-মুক্তি-পাওয়া কোনও সিরিজ। কোনও অফিসের রিসেপশনে বসে অপেক্ষা করছেন, সেখানে নাগাড়ে বেজে চলেছে গান অথবা টেলিভিশনে কিছু-না-কিছু ঘটে চলেছে। আর যদি ‘অনলাইন’ থাকেন, তাহলে তো কথাই নেই। ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ-সহ যে কোনও সামাজিক মাধ্যম থেকে শুরু করে নেটফ্লিক্স, প্রাইম, হটস্টার, সোনি লিভ, জি ফাইভের মতো ওটিটি– সর্বত্র দৃশ্য-শ্রাব্য ‘কনটেন্ট’-এর ঢল। ওটিটি-তে যদি-বা মনোযোগ কিছুটা একটি কাজের প্রতি ধাবিত হয়, যদি জঁর ধরে ধরে যে কাজগুলি সামনে আসে, তাদের মধ্যে কিছুমাত্র বিষয়বস্তুগত সাযুজ্য থাকে; সমাজমাধ্যমে তো এসবের পাটবালাই নেই, সেখানে পরপর পোস্টগুলি পারম্পর্যহীন, যাকে বলে ‘র‌্যান্ডম’। এই হয়তো কারুর পোষ্য কুকুরের ভিডিও এল, পরেই একটি রেস্তোরাঁর বিজ্ঞাপন, তারই পরে রাস্তায় দু’টি গাড়িচালকের তুমুল চিৎকার-চেঁচামেচি, তার পরেই কোনও স্ট্রিট-ফুড বিক্রেতার সিনেমায় নামার তোড়জোড়। মানব-মস্তিষ্কের আর কী দোষ, যদি সে সকালে দেখা সিনেমা বিকেলে ভুলে যায়!

যাঁরা মোটামুটি অ্যালগরিদম নিয়ে পড়াশোনা করেন, তাঁরা জানেন– সমাজমাধ্যমে এখন পোস্ট করতে গেলে সর্বাগ্রে মাথায় রাখতে হয় ধারাবাহিকতার কথা। যে যত ভালো কাজই করুন না কেন, যত যত্ন-পরিশ্রম করেই ভিডিও বানান না কেন; তিনি যদি ধারাবাহিক না হন, তাহলে ক্রমশ তাঁকে একটু নিচের দিকে ঠেলে দেবে যে কোনও সমাজমাধ্যম। কেন? উত্তরটা সহজ। একজন মানুষ তো আর ইন্টারনেটে শুধু একধরনেরই ভিডিও দেখেন না। তাঁর ফিড প্রতিনিয়ত পালটে যায়, কারণ র‌্যান্ডম ভিডিও তাঁর ফিডে আসতে থাকে; ক্লিক করে সেকেন্ড দশেক সময় কাটানোই তাতে আগ্রহী হওয়ার লক্ষণ। কাজেই ধারাবাহিক না হলে তাঁর গ্রাহকদের ক্রমপরিবর্তনশীল ফিডটিতে নির্মাতার ঠাঁই হবে না। একজন মানুষ যদি আজকাল ইন্টারনেট-দুনিয়ায় প্রাসঙ্গিক থাকতে চান, তাঁকে তাঁর কাজ, শৈলী যতটা বুঝতে হবে, ততটাই জানতে হবে অ্যালগরিদমের মন-মর্জি।

এহেন পরিসরে বহুবছর আগে দেখা কোনও কাজ যে মনে থাকবে, এ-ই দস্তুর। বিশেষত যেখানে পরপর দেখতে থাকা ভিডিওগুলোর মধ্যে কোনও মিল নেই, কোনও ধারাবাহিকতা নেই– সেখানে কীভাবেই বা মনে থাকবে একটি ৮-১০ পর্বের সিরিজের প্রতিটা পর্ব, চরিত্রের গ্রাফ? এই অবস্থায় দর্শককে তিনবছর পর কোনও সিরিজের ছকে ফিরিয়ে আনা প্রায় দুঃসাধ্য। তাই প্রতিটি ওটিটি-ই যা করে, তা হল রিক্যাপ করা। লক্ষ করবেন, যাঁরা ‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান’-এর ট্রেলার ইউটিউবে দেখেছেন, তাঁদের প্রায় সকলেরই ফিডে প্রাইম থেকে হালে আপলোড করা এই সিরিজের পুরোনো অংশগুলির ক্লিপিং আসছে। প্রাইম বিভিন্ন চরিত্রের বিভিন্ন ইন্টারেস্টিং মুহূর্তগুলি একত্রিত করে গ্রাহকদের বা আগ্রহীদের ফিডে ঠেলছে, যাতে করে অন্তত তারা নয়া সিজনের আগে একটু ধরতাই পায়। শতকরা কত ভাগ লোকই বা আর তৃতীয় সিজন দেখার চক্করে আগের দু’টি সিজন বসে বসে দেখবে!

৩০ সেকেন্ডব্যাপী ভিন্নধর্মী রিল পরপর দেখতে দেখতে আমাদের মনঃসংযোগের এতটাই বারোটা বেজেছে, সারাক্ষণ সিনেমায় কিছু-না-কিছু ঘটাতে থাকলে দর্শক স্কিপ করে চলে যাবে। আমি কৌতূহলবশত একটা ব্যক্তিগত সমীক্ষা করে দেখছিলাম যে, এখনকার মূল ধারার কমার্শিয়াল ছবিগুলিতে প্রায় প্রতি ১০ মিনিটেই একেকটি বড় ঘটনা পর্যায়ক্রমে আসে। এই প্রতি দশ মিনিটের চেকপয়েন্টই দর্শককে পুরো ছবিটি দেখানোর একেকটি চুম্বক। যেমন, হালে মুক্তি পাওয়া ‘জলি এলএলবি ৩’-র সঙ্গে যদি পূর্বতন দু’টি ছবির তুলনা করেন, সেখানে এই বৈশিষ্ট্যটা আরও বেশি করে চোখে পড়বে। আগের ছবিদু’টির ক্লাইম্যাক্স এতটা অভিঘাতপূর্ণ কেন? কারণ ছবিদু’টি ক্লাইম্যাক্সের দিকে দর্শককে ঠেলে দেয়, সারা ছবি ধরে দর্শককে ক্লাইম্যাক্সের জন্য প্রস্তুত করে। কিন্তু তুলনায় শেষতম ছবিটির ক্লাইম্যাক্স ম্যাড়ম্যাড়ে, কোর্টরুম ড্রামায় যে ক্যাথারসিস প্রয়োজনীয়, তার তুলনায় কিছুটা ভোঁতাই লাগে এই ছবির ক্লাইম্যাক্স। কারণ ছবিটি প্রতি ১০ মিনিটে এমন কিছু চমক রাখতে চেয়েছে, দর্শক মূল ঘটনার তুলনায় বাকিগুলোর চমকে এতটা মজে গেছে, তাতে ক্লাইম্যাক্সটা আর কাঙ্ক্ষিত বা প্রয়োজনীয় অভিঘাতটা তৈরি করতে পারে না। দর্শককে মজিয়ে রাখার এই প্রবণতা কি আসলে গল্প লেখার কৌশলকেই মাটি করছে? এই প্রশ্ন ভেবে দেখার। এর পাশাপাশি স্পেকট্যাকল-সর্বস্বতা হওয়ার প্রবণতা তো আছেই।

এই এত অডিও-ভিজ্যুয়াল কনটেন্টের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে বহু কণ্ঠস্বর, যাদের থেকে যাওয়ার কথা ছিল। যেমন, ‘হোমবাউন্ড’। ছবিটি যেরকম আলোচিত হওয়ার কথা ছিল, তা তো হয়ইনি, বরং মুক্তি পাওয়ার মাসখানেকের মধ্যে গতজন্মের স্মৃতির মতো আবছা হয়ে গেছে। ‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান ৩’-এর মূল অ্যান্টাগোনিস্ট জয়দীপ আহলাওয়াত, প্রাইমের উত্তর-পূর্ব ভারতে তৈরি হওয়া আরেকটি সিরিজ ‘পাতাল লোক ২’-এর কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে অভিনয় করেছিলেন– এই বছরেরই গোড়ার দিকে মুক্তি পেয়েছিল। অথচ, মানুষের মন থেকে দু’-একটি মুহূর্ত ছাড়া প্রায় সবই মুছে গেছে। যাঁরা একাধিকবার দেখেছেন, তাঁরা হয়তো মনে রাখতে পারেন। ‘দেখা’ বা ‘দর্শন’ শব্দটির মধ্যে যে গভীর ছানবিনের দ্যোতনাটি আছে, নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের প্রয়াসের বিষয়টি আছে; তা এই ক্রমাগত বিঞ্জ-ওয়াচে হারিয়ে যাচ্ছে না কি? তাৎক্ষণিক কিছু অ্যাড্রিনালিন রাশ আর ধাক্কা মারার মতো দু’-একটি মুহূর্তই কি আমাদের শিল্প থেকে পাওয়ার কথা ছিল? এর দায় কার, দর্শকের না নির্মাতার না উভয়পক্ষের?

প্রশ্নগুলো হাওয়ায় ভাসে দু’-এক পল। তারপর ভেসে যায় হাওয়ায়, যেমন ভেসে যায় গতকাল মুক্তি পাওয়া সিনেমা, আজকে মুক্তি পাওয়া নয়া সিরিজটির তোড়ে।