Robbar

জেমিমা শেখালেন বন্ধুত্বের ‘ছুটি’ নেই

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 2, 2025 3:42 pm
  • Updated:December 2, 2025 5:00 pm  

বন্ধু স্মৃতি মন্ধানার বিবাহ সংক্রান্ত জটিলতার কঠিন সময়ে পাশে থাকতে চান জেমিমা। তাই ছুটি। ব্রিসবেন-এর তরফে মিলেছে অতি সদর্থক উত্তরও। অবাক লাগছে। এই মুহূর্তে উত্তুঙ্গ ফর্মে থাকা এক ক্রিকেটার, পেশাজগতের অন্যতম সেরা সুযোগ ছেড়ে দিচ্ছেন শুধু বন্ধুর পাশে থাকবেন বলে! কঠিন সময়ে একটু উষ্ণ সখ্য আর নির্ভরতার পরশ দিতে চেয়ে! কোনও অবান্তর লুকোছাপা নয়, একেবারে কাগজেকলমেই এই কারণ দেখিয়েছেন তিনি।

অরুন্ধতী দাশ

জেমিমা খেলছেন না। হপ্তা দুয়েক আগে, হোবার্ট হ্যারিকেন বনাম ব্রিসবেন হিট-এর ম্যাচে ব্রিসবেনের হয়ে খেলেছিলেন শেষ। তারপর এসেছিলেন দেশে, অনেকদিন ধরেই ছুটি নেওয়া ছিল, দিনকয়েকের যদিও। ফিরে গিয়েই আবার উইমেনস বিগ ব্যাশ লিগ খেলার কথা তাঁর। কিন্তু ছুটি চেয়ে বসলেন তিনি। আপাতত ম্যাচ বাদ। চোট-আঘাত-অসুস্থতা-ক্লান্তি-দর কষাকষির দ্বিমত কিচ্ছু নেই। তবু ব্রিসবেন হিট তাঁকে ছেড়েও দিল। অথচ, ব্রিসবেন হিট-এর পয়লা পছন্দ ছিলেন জেমিমা!

কী কারণ দেখিয়েছেন জেমিমা? বলেছেন, বন্ধু স্মৃতি মন্ধানার বিবাহ-সংক্রান্ত জটিলতার কঠিন সময়ে পাশে থাকতে চান তাঁর। তাই ছুটি। ব্রিসবেন-এর তরফে মিলেছে অতি সদর্থক উত্তরও। অবাক লাগছে। এই মুহূর্তে উত্তুঙ্গ ফর্মে থাকা এক ক্রিকেটার, পেশাজগতের অন্যতম সেরা সুযোগ ছেড়ে দিচ্ছেন শুধু বন্ধুর পাশে থাকবেন বলে! কঠিন সময়ে একটু উষ্ণ সখ্য আর নির্ভরতার পরশ দিতে চেয়ে! কোনও অবান্তর লুকোছাপা নয়, একেবারে কাগজেকলমেই এই কারণ দেখিয়েছেন তিনি।

বন্ধুত্ব: জেমিমা রডরিগেজ-স্মৃতি মন্ধানা

জেমিমা রডরিগেজ যেদিন বিশ্বকাপ ফাইনাল জিতে ওই বিরাট হারজিতের মাঠের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অসম্ভব প্রত্যয়ের সঙ্গে নিজের ডিপ্রেশনের কথা, ভাঙাচোরা মন নিয়ে লড়াই করার কথা বলছিলেন আর তাঁর দু’-চোখে টলটল করছিল জল, সেদিনই গোটা দেশ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখেছিল। খেলোয়াড়রা সাধারণত এসব পথে হাঁটেন না। তথাকথিত ‘পুরুষালি’ খেলার জগতে চিরকাল ‘স্পোর্টসম্যান স্পিরিট’-ই উদ্‌যাপিত হয়ে এসেছে বরাবর। শরীর ভাঙবে, মন ছিঁড়বে, ব্যক্তিগত জীবন ধূলিসাৎ হয়ে যাবে, তবু তাঁরা অবিচল দাঁড়িয়ে থাকবেন মাঠের ঘাসের ওপরে। খেলায় হারলে, সেসব কথা কোনওদিন কেউ জানতেও পারবে না। কারণ, জানলেই, খারাপ ফর্মের জন্য দায়ী করা হবে ব্যক্তিগত টানাপোড়েনকেই। আর জিতলে, সবাই এতদিন বড় মুখ করে বলে এসেছেন, কীভাবে ব্যক্তিজীবনের অন্ধকার মুহূর্তই না কি আগুনঝরা খেলার রসদ জোগায়, দাঁতে দাঁত চেপা লড়াই-এর মোটিভেশন হয়ে ওঠে। এই ইতিহাস পিছনে রেখেও জেমিমা যখন হৃদয়ের অন্তর্গত কালো বিষণ্ণতার কথা নির্ভয় স্বচ্ছতায় ফোঁটা ফোঁটা শিশিরের মতো ঝরিয়ে দিচ্ছিলেন সবুজ ঘাসে, সেদিন মনেই হচ্ছিল, আসলে মনই যে মগজ, আর মগজেই মন, এই মেয়ে মাত্র ২৪-এ সে-কথা এত নির্ভুল পড়তে পারল কীভাবে?

হৃদয়ের শুশ্রূষাকে যে জেমিমা তাঁর আধুনিক মন আর বোঝাপড়া দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গাতেই রাখেন, তা টের পাওয়া গিয়েছিল আগেই, কিন্তু জেমিমার এই সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত আরও কয়েকটা দিকে চোরাস্রোতের টান মেরে গিয়েছে। ছেলেদের বন্ধুত্ব আর তার খোলামেলা ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে সোচ্চার সেলিব্রেশনের পাশাপাশি, মেয়েদের বন্ধুত্ব বরাবরই ছিল একটু ফিকে, আবছা। তাতে এত ওঠাপড়া কিংবা বন্ধুকৃত্যের নিদর্শন নিয়ে কতটুকু কথা হয়? ‘ইয়ে দোস্তি হম নহি তোড়েঙ্গে’ থেকে শুরু করে ‘দিল চাহতা হ্যায়’, কিংবা ‘জিন্দগি না মিলেগি দোবারা’– জনমোহিনী ভারতের আবেগ-দর্পণ যে বলিউড, সেখানেও যে ‘ফ্ল্যামবয়েন্স’ প্রতিনিয়ত চোখে পড়ে ছেলেদের উড়ন্ত জীবনের দুরন্ত বন্ধুত্ব নিয়ে, মেয়েদের জীবনে তেমন আশকারা কোথায়? খেলাধুলোর ছেলেবেলা, টিফিন ভাগাভাগির স্কুলজীবন, ঈষৎ ডানামেলা ক্যাম্পাস আর টেনশনবহুল কেরিয়ার– এই পর্যন্ত একইরকম চড়াই-উতরাই। পথের বাঁকে বাঁকে বন্ধুও জুটে যায়, ফুটে ওঠে, রয়ে যায়। কিন্তু সেসব পেরতে না পেরতেই ঠিকানা বদলে বিয়ে আর সংসার– আস্ত একটা রদবদলের চাপে মেয়েদের জীবনে যা কিছু অপরিহার্য, তার মধ্যে ‘বন্ধুত্ব’ আর কতটুকু নির্মল হয়ে থাকে?

ঠিক এই ধারণার ভূতই আমরা বয়ে চলেছি বহুদিন। চায়ের দোকানের আড্ডা হোক, কিংবা সকালের পার্কে জগার্স গ্রুপের বৈঠক, মুদির দোকানের বেঞ্চ দখল করে জমায়েত হোক কিংবা পার্টি-অফিসের সান্ধ্য ঠেক, সবই কী প্রচণ্ড গিজগিজে পুরুষ ভিড়াক্রান্ত! সারাদিনের কাজ শেষে বাড়ির পুরুষটি যখন বৈঠকি আড্ডায় নিজের ক্লান্ত বহরখানি আরামে আয়েসে ঢেলে দিয়ে সতেজ সজীব হয়ে ওঠেন, বাড়ির মেয়েদের ২৪ ঘণ্টার গেরস্থপনার তখন সবে কলির সন্ধে! যে জীবনে অবসর নেই, অবসরের উদ্‌যাপন নেই, সেখানে বন্ধুত্বের মতো সময়নিকাশি সম্পর্ক থাকেই বা কী করে! যেটুকু ছিল, অন্তত গল্পে-উপন্যাসে যেটুকু দেখতে পাই, তার রকমও একটু ভিন্ন। বঙ্কিমের ‘ইন্দিরা’, দীনবন্ধু মিত্রর ‘সধবার একাদশী’, রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’, কিংবা বিভূতিভূষণের ‘মৌরীফুল’– মেয়েলি বন্ধুত্ব নিশ্চয় আছে সেখানে, কিন্তু আছে কি মেয়েদের বন্ধুত্ব? প্রত্যেকটি বন্ধুত্বেই এক নারীর সামাজিক অবস্থান অন্যের চেয়ে উচ্চতর এবং এদের সম্পর্কের মধ্যে অনেকখানি জায়গা করে আছে উচ্চতরের প্রতি নির্ভরশীলতা এবং সেই নির্ভরতাজাত একটা বিশ্বস্ত স্বস্তির ভাব। এই সমস্ত বন্ধুত্ব কি আদৌ নির্ভার কিংবা সামাজিক অবস্থান-নিরপেক্ষ?

যে বন্ধুত্ব মাঠের বাইরেও অমলিন

আজকের সময় কিন্তু অর্কেস্ট্রায় ভিন্ন সুর জুড়েছে। ‘ফিমেল বন্ডিং’ এই যুগে দাঁড়িয়ে শুধু ভালোবাসার পরশই নয়, তা বহু যন্ত্রণার সুরাহাও বটে। ‘মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু’ মার্কা চিরন্তন সম্পাতবাক্যের ওপরে কাঁচি চালিয়ে মেয়েরা একে অন্যের দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে যৌথ সহাবস্থানের হাত– ‘মোর পাওয়ার টু ইউ’! সামাজিক মাধ্যমে আস্ত একটা গণ-আন্দোলন তৈরি হয়ে গেছে ‘মি টু মুভমেন্ট’-কে ঘিরে, যেখানে মেয়েরাই মেয়েদের সেফটিপিন! তারা একসঙ্গে হাসে-কাঁদে-গায়, আনন্দে-উদ্‌যাপনে হুল্লোড়ে মাতে, পথচলার হিসেব মিলিয়ে নেয় একান্ত ভাগাভাগিতে, হাতে হাতে চালাচালি করে নেয় দুঃখের বাঁটোয়ারাও। পাশের বাড়ির গিন্নির চালান করা তরকারির বাটি, কিংবা ‘কিটি পার্টি’র গসিপখ্যাত অবকাশটুকুর মধ্যেই শুধু আর মেয়েদের বন্ধুত্বের স্বীকৃতি আটকে নেই, তারা সাংসারিক জোয়াল ঠেলার বাইরেও আশ্চর্য এক সাম্যের দিন দেখার স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছে একসঙ্গে। ম্যাসকুলিন ফ্রেন্ডশিপ-এর তথাকথিত চেতাবনি তাদের চোখ রাঙাল কি না, সেই হিসেব মেলানোর দায় নেই আর। তারা একসঙ্গে লং ট্রিপ প্ল্যান করে, অফিসফেরত কফিশপে আড্ডা মারে, রাত জাগা ‘গার্লস নাইট আউট’-এর নামে নেচে উঠতে পারে নির্দ্বিধায়।

কিছুদিন আগেই আমার এক স্কুলবন্ধু ভারি আতান্তরে পড়েছিল। বাবা অসুস্থ হঠাৎ, লিভারে ইনফেকশন, হ্যামারেজ হয়ে চলেছে ক্রমাগত। রক্ত লাগবে দ্রুত। সেই মেয়ে আকুল ডাক পাঠাল পুরনো বন্ধুদের গ্রুপে। এমন সময় সচরাচর ঝিমিয়ে-থাকা গ্রুপে দেখলাম অদ্ভুত তৎপরতা, আয়ারল্যান্ড থেকে দিল্লি, হায়দরাবাদ থেকে হুগলি পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা বন্ধুরা চটজলদি শামিল হয়ে পড়ল সমস্যার সমাধানে। আমি যখন ঘটনাস্থলে পৌঁছলাম, গিয়ে দেখি সেদিন রক্ত দিতে এসেছে আমারই সঙ্গে আরও একটি মেয়ে, আমারই বয়সি। আমার বন্ধুটিকে সে চেনেও না ভালো করে, বন্ধুর দিদির অফিস কলিগ। অত চিন্তাগ্রস্ত বিপদসংকুল মুহূর্তেও আমার ভিতরটা শীতল আরামে জুড়িয়ে যাচ্ছিল। আমি দু’-চোখ ভরে দেখছিলাম মেয়েটিকে। বন্ধুর বোনের বাবার জন্য অফিস মুলতুবি রেখে সে ছুটে এসেছে, রক্ত দেবে বলে! ‘রক্তের সম্পর্ক’ না কি সবচেয়ে দামি, অপরিত্যাজ্য! এই শান্ত মুখ আর নিরীহ চোখের মেয়েটা সবুজ-সাদা নার্সিংহোমের করিডোরে চুপ করে বসে আছে কোন রক্তের ঋণ শোধবার তাড়নায়!

জীবনে যতবার ‘কষ্ট’ পেয়েছি, ‘খারাপ’ বিকেল নেমে এসেছে অবেলায়, চুপ করে যেতে চেয়েছি যতবার, ততবার আমাকে দুনিয়াদারির আশ্চর্য মায়ালিখন দেখিয়ে দিয়ে গেছে আমার মেয়েবন্ধুরা। ভাঙা প্রেম নিয়ে যখন শীতঘুমে যাওয়ার দরখাস্ত লিখব ভেবেছি, তখনই বিশ্রী মশকরায় খানখান করে দিয়েছে একান্ত একাকীত্ব। অনভ্যস্ত নতুন জামার আড় ভাঙানোর মতো করে প্রতিটি নতুন মেলামেশা সম্পর্কে দিয়ে গেছে বিস্তারিত বিশেষজ্ঞের মতামত। যে লেখার প্রতি পরতে কান্না আর দুর্ভাবনার শেকল গোপনে পরানো ছিল, সেসব ছেপে বেরনোমাত্র ফোনের ওপাশ থেকে ডাক এসেছে, ‘ঠিক আছিস’? হৃদয়-নিংড়ানো সন্ধেবেলায় মাথার মধ্যে জট পাকিয়েছে দুর্বৃত্ত দুশ্চিন্তার খেসারত, ওরা গান গেয়েছে, গাইয়েছে। প্রশম করেছে আমার উত্তাপ, অপার শান্তি ভরে দিয়েছে ক্যাকোফোনি পর্যুদস্ত মগজে। উচ্চকিত সমারোহে নয়, কিন্তু নিরুচ্চার প্রলেপ হয়ে রয়ে গিয়েছে জ্বরের প্যারাসিটামলের মতো।

আসলে বন্ধুত্বের কিছু অবকাশ প্রয়োজন হয়। যে অবকাশ নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলবে না। ‘অকাজ’, ‘অকারণ ব্যয়’ কিংবা ‘অপচয়’ বলে তার বরাদ্দ পলকমুহূর্ত কমিয়ে নিতে চাইবে না জীবনের জাঁতাকল ঠেলার ওয়ার্কিং আওয়ার মেপে। ব্যক্তিগত সময়ের হিসেব দেওয়ার জন্য মাথার ওপরে যতক্ষণ না কড়া নজরদারির প্রহরা এড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছে, ততক্ষণ শুধু বন্ধুত্ব কেন, অন্য কোনও সম্পর্কই মেয়েদের জীবনে স্থায়িত্বের জলবাতাস পায় না। জেমিমা তাই ছুটি চেয়েছেন। নিখাদ বন্ধুত্ব পালনের ছুটি। বন্ধুকৃত্যের অবসর। ফুরসত ছাড়া বন্ধুত্ব যে হয় না! সম্পর্কের গহীনে কোন শুক্তির ভেতর থেকে হারামানিক তুলে আনবে এই ডুবজলের শ্বাসরোধী প্রহর, তা আমরা দেখব দু’-চোখ ভরে। ওপরজলের বুদ্‌বুদটুকুই চোখে পড়বে যদিও, তবুও মেয়েদের বন্ধুত্ব নিয়ে ভুরুতোলা এই সমাজের দৃষ্টির প্রখরতার মুখে লাল পতাকা ওড়াতে, সেটুকুই যথেষ্ট। বন্ধুত্বের সবটাই তো ডুবসাঁতার, অবগাহনে তার যতটুকু মেলে, সেটুকুই আপাতত আমাদের উদাহরণ। বন্ধুরা থাক আমাদের নিভৃত শান্তিতে, ব্যথার সুরাহায়, রাতের বোরোলিন হয়ে।

…………………

রোববার.ইন-এ পড়ুন অরুন্ধতী দাশ-এর লেখা

…………………