
২০০৬ সালে জাতিপুঞ্জের প্রতিবন্ধকতা অধিকার বিষয়ক ‘সনদ’-কে মান্যতা দিয়ে ২০১৬ সালে অধিকার নির্ভর ‘প্রতিবন্ধী মানুষ অধিকার আইন’ পাশ হয়, যেখানে অধিকার রক্ষার পাশাপাশি সুগম্যতা বৃদ্ধি এবং কোনও ধরনের বিভাজন এবং বৈষম্যের বিরূদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। উচ্চশিক্ষা ও কর্মসংস্থানে সংরক্ষণের পাশাপাশি প্রতিবন্ধকতার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নির্মাণ ও ন্যায্য বন্দোবস্তের কথা স্থান পেয়েছে। তবে সেখানে অধিকার চেতনা অপেক্ষা কল্যাণমূলক চেতনা অধিক লক্ষ করা যায়। কারণ সংসদের উভয় কক্ষে ‘নিজেদের কথা’ বলার প্রতিনিধিত্ব তেমনভাবে দেখা যায় না।
আজ আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস। এ বছরের প্রতিবন্ধকতা দিবসের মূল সুর সামাজিক প্রগতির মাধ্যমে প্রতিবন্ধী মানুষদের সামাজিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিতকরণ। সামাজিক অন্তর্ভুক্তির সাফল্যের ক্ষেত্রটিতে রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তি সমানভাবে জরুরি।
‘অভিনন্দন নয়, প্রশংসা নয়, নয় কোনও সংবর্ধনা, মানুষের ভালোবাসা পেতে চাই আমি’– জনপ্রিয় এই বাংলা গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উদ্যোগী ও সফল প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষেরাও যেন বলতে থাকে ‘বিশেষভাবে সক্ষম নয়’, ‘অন্যভাবে সক্ষম নয়’, ‘দিব্যাঞ্জন নয়’– সমস্ত স্তরের শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য চাই শুধু বাধামুক্ত পরিবেশ নির্মাণ ও ‘মানুষের প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা’। আর সেই সম্মান লাভের অন্যতম মাধ্যম হল সামাজিক অন্তর্ভুক্তি এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বৃদ্ধি।

১৯৯০-এর দশকে জেমস চার্লটনের ‘Nothing About Us Without Us’ শ্লোগানকে আশ্রয় করে বিশ্বব্যাপী প্রতিবন্ধকতার অধিকার আন্দোলন নতুন ধারায় প্রবাহিত হয়েছিল। ভারতেও তার প্রভাব মৃদুস্বরে হলেও তরঙ্গায়িত হয়েছিল। যার ফলে ১৯৯৫ সালে ভারতের ‘প্রতিবন্ধী মানুষ আইন’-এর প্রতিপাদনা, যেখানে ‘সমান সুযোগ’, ‘অধিকার রক্ষা’ এবং ‘সম্পূর্ণ অংশগ্রহণ’ গুরুত্ব লাভ করে। প্রায় এক দশকের মধ্যে সেই আইনের কার্যকারিতা ও বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন দেখা যায়।

২০০৬ সালে জাতিপুঞ্জের প্রতিবন্ধকতা অধিকার বিষয়ক ‘সনদ’-কে মান্যতা দিয়ে ২০১৬ সালে অধিকার নির্ভর ‘প্রতিবন্ধী মানুষ অধিকার আইন’ পাশ হয়, যেখানে অধিকার রক্ষার পাশাপাশি সুগম্যতা বৃদ্ধি এবং কোনও ধরনের বিভাজন এবং বৈষম্যের বিরূদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। উচ্চশিক্ষা ও কর্মসংস্থানে সংরক্ষণের পাশাপাশি প্রতিবন্ধকতার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নির্মাণ ও ন্যায্য বন্দোবস্তের কথা স্থান পেয়েছে। তবে সেখানে অধিকার চেতনা অপেক্ষা কল্যাণমূলক চেতনা অধিক লক্ষ করা যায়। কারণ সংসদের উভয় কক্ষে ‘নিজেদের কথা’ বলার প্রতিনিধিত্ব তেমনভাবে দেখা যায় না।
সেই অভাব দূর করতে এবং প্রতিবন্ধী মানুষদের ধারাবাহিক আন্দোলনের চাপে স্বাধীনতার ৭৮ বছর পর রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৮০/১ ধারাকে মান্যতা দিয়ে সমাজের বিশিষ্ট মানুষ হিসেবে কেরলের শিক্ষক-নেতা, চলন-প্রতিবন্ধী সদানন্দ সি. মাস্টারকে উচ্চকক্ষের (রাজ্যসভায়) সাংসদ হিসেবে মনোনীত করেছেন। এই প্রথম সংসদের উচ্চকক্ষে প্রতিবন্ধী মানুষদের প্রতিনিধি বা কণ্ঠস্বর সরাসরি শোনার সুযোগ পাওয়া গেল। এই ঘটনা, ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের পাশাপাশি প্রতিবন্ধকতার অধিকার আন্দোলনের ইতিহাসেও নিঃসন্দেহে নতুন ভাবনার উদ্রেক ঘটায়। প্রতিবন্ধী অধিকার কর্মী থেকে শুরু করে অধিকার রক্ষা সংগঠনসমূহ স্বাভাবিকভাবে উচ্ছ্বসিত। কারণ তাঁদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফসল অবশেষে পাওয়া গেল।

তবে সদানন্দ মাস্টারের জীবন ও রাজনৈতিক পরিচয় এতই বেশি উজ্জ্বল যে তাঁর অন্যান্য গুণাবলি এবং প্রতিবন্ধকতার অধিকার রক্ষাকর্মীর চেতনা গুরুত্বহীন হয়ে উঠেছে। তাছাড়া জীবনের মধ্যবয়সে প্রতিবন্ধকতার জগতে প্রবেশ করা সদানন্দ মাস্টার প্রতিবন্ধকতার সমস্যার কণ্ঠস্বর আদৌ কতটা সংসদে পৌঁছে দেবেন– তা নিয়ে স্বাভাবিক আশঙ্কা থাকে। তাই অনেকে তাঁর মনোনয়নের মধ্যে দিয়ে শাসক দলের রাজ্যসভায় আসন বৃদ্ধির বাইরে বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে প্রতিবন্ধকতার প্রতিনিধিত্ব বলতে খুব একটা আগ্রহী নয়। কারণ তাঁর সংসদে প্রবেশ ঘটেছে সম্পূর্ণভাবে দলীয় বৃত্তের মধ্যে থেকে। একথা সত্যি যে, এর আগেও সংসদের নিম্নকক্ষে (লোকসভায়) মাঝেমধ্যে (সংখ্যায় নগণ্য হলেও) প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের প্রতিনিধিত্ব দেখা গিয়েছে। তাঁরাও অধিকাংশ ক্ষেত্রে দলীয় বৃত্তের বাইরে গিয়ে প্রতিবন্ধকতার অধিকার রক্ষা বিষয়ে আওয়াজ তুলতে ‘বিশেষভাবে সক্ষম’ হননি। যার ফলে গত পাঁচটি আর্থিক বছরে (২০২০ থেকে ২০২৫) প্রতিবন্ধকতার জন্য বরাদ্দ তহবিলের ২৫০ কোটি টাকার মধ্যে মাত্র ১৭ কোটি টাকা (সাত শতাংশ) প্রতিবন্ধকতার উন্নতিতে ব্যয় করা হয়েছে বলে সামাজিক ন্যায়বিচার মন্ত্রক সংসদে জানায়। এবং তার দ্বারা উপকৃত হয়েছেন মাত্র ১৬৮৪ জন।

তাই সময় এসেছে ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কাঠামোগত পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে প্রতিবন্ধকতার বিষয়কে সরাসরি রাজনৈতিক পরিসরে আরও অধিক অন্তর্ভুক্তির। সাধারণভাবে রাজনৈতিক দলগুলির জাতিগত, ধর্মগত, লিঙ্গগত চেতনার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে দলীয় শাখা-সংগঠন তৈরি করলেও, প্রতিবন্ধকতার ক্ষেত্রে তেমন আগ্রহ দেখা যায় না। এমনকী, দলীয় কর্মসূচিতেও প্রতিবন্ধকতা অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ দেখা যায় না। তাই তফসিলি জাতি, উপজাতি, অন্যান্য অনগ্রসর সম্প্রদায়, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং অন্যান্য প্রান্তিক সম্প্রদায়ের পাশাপাশি প্রতিবন্ধকতাকেও ধারাবাহিকভাবে দলীয় কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্তির রীতি অভ্যাসে পরিণত করলেই প্রতিবন্ধী মানুষেরা ‘নিজেদের কথা’ বলার অধিক সুযোগ লাভ করতে পারে। তার মধ্যে দিয়ে আট দশকের ভারতীয় গণতন্ত্রের বৃত্তায়ণ সম্পূর্ণতা পেতে পারে।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved