
বাইরে হুবহু কোনও ছবি তৈরি করতে চান না এ নাট্যের নাট্যকার ও নির্দেশক মকরন্দ। না-চাওয়াই তো সম্ভব, কারণ এ নাট্যের কথক মকরন্দের অন্তরে ভিতর-বাহির সমস্ত দিন সেই পিয়াক্কড়ের প্রতিচ্ছবি। স্মৃতির আয়নায় সে-ছবি দেখতে থাকে মকরন্দ, আয়নাটা ধরে দর্শকের সামনে। মাঝে মাঝে সে-আয়নায় মুখ দেখে আমাদের ভব্য অবস্থানটি ফুটপাথ বদল করতে চায় গোপন, নিজস্ব মধ্যরাতে।
নেমে আসছে মকরন্দ। অ্যাম্ফিথিয়েটারের ওপর থেকে। যেন-বা এক অবিকলের উদাস সিঁড়ি বেয়েই। নেমে আসতে আসতে দর্শকদের দিকে ছুড়ে দিচ্ছে প্রশ্ন: বলো তোমার জেহের কী! হোয়টস ইওর পয়জন?
অঘ্রানের এক সন্ধেবেলা, ‘কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি’র অ্যাম্ফিথিয়েটারে অর্ধবৃত্তাকারে বসেছেন সুশীল দর্শকসমাজ, এক পিয়াক্কড়ের গল্প শুনবেন বলে। পিয়াক্কড় মানে কী? নাটক ‘রিভিউ’ করব বলে শব্দটা নিয়ে বিস্তর খাটাখাটনি করেছি সারা দুপুর, নানা রকম অভিধান নিয়ে। শব্দটার বাংলা প্রতিশব্দই বা কী হবে? মাতাল? না, সে তো ‘শরাবি’।

তাকে ‘শরাবি’ বললে খেপে ওঠে মকরন্দ। অথচ তার কথা শুনতে এসেছে যারা তাদের সঙ্গে কথা শুরুই করে শরাব নিয়ে। বিয়ার না ওয়াইন, কিংবা হুইস্কি– কোনটা পছন্দ কোন দর্শকের, জানতে চায়। হালকা হাসির এই আবহেই কখন সে টুক করে ঢুকে পড়ে তিন পিয়াক্কড়ের গল্পে। তিন, কিংবা এক। একে তিন তিনে এক। তিন খাঁটি পিয়াক্কড় এ গল্পের তিন চরিত্র– আসলাম, সোডা নরেশ আর মারিয়া। সেই তিনটি চরিত্রের সন্ধানে আর এক পিয়াক্কড় মকরন্দ বা তার স্মৃতি। মকরন্দ দেশপান্ডে অভিনয় করেন মকরন্দের ভূমিকায়, তাঁর স্মৃতির চরিত্রগুলিকে তিনিই জীবন দেন একক অভিনয়ে। অতি নিরাভরণ নাট্যভূমিতে থাকে অকিঞ্চিৎকর সব উপকরণ– একটি আসব-বোতলের আভাস, ঝুলতে থাকা দুটো দড়ি, বাতিল কিছু প্যাকিং বাক্স আর ছোট উঁচু একটা মঞ্চের মতো– এইমাত্র।

এইটুকুই তো যথেষ্ট! বাইরে হুবহু কোনও ছবি তৈরি করতে চান না এ নাট্যের নাট্যকার ও নির্দেশক মকরন্দ। না-চাওয়াই তো সম্ভব, কারণ এ নাট্যের কথক মকরন্দের অন্তরে ভিতর-বাহির সমস্ত দিন সেই পিয়াক্কড়ের প্রতিচ্ছবি। স্মৃতির আয়নায় সে-ছবি দেখতে থাকে মকরন্দ, আয়নাটা ধরে দর্শকের সামনে। মাঝে মাঝে সে-আয়নায় মুখ দেখে আমাদের ভব্য অবস্থানটি ফুটপাথ বদল করতে চায় গোপন, নিজস্ব মধ্যরাতে।
যেমন পিয়াক্কড় সোডা নরেশের গল্প। পাড়ার গুন্ডা সোডা নরেশ। পাক্কা পিয়াক্কড়। বোতল বোতল সোডা রাখে সে। সুরায় মেশানোর জন্য নয়, খাঁটি পিয়াক্কড় কখনও সোডা মিশিয়ে মদ খায় না। আসলে মস্তানিতে তার আমদানি নতুন অস্ত্র সোডার বোতল। ঝুপড়ি বস্তিতে থাকে। বস্তির পাশে চকচকে পিচের রাস্তা। তার ওধারে ঝাঁ-চকচকে বহুতল। সেই সোডা নরেশ পুলিশের ‘হফতা’ তোলার অত্যাচারের প্রতিবাদ করে চূড়ান্ত মার খায়, লকআপে থার্ড ডিগ্রি পড়ে তার উপর। গল্পটা বলতে থাকেন মকরন্দ, গায়ের ফুলহাতা জামাটা খুলে সেটাকেই করে তোলেন সোডা নরেশের শরীর। হাসপাতালে মৃতপ্রায় সোডা নরেশের স্যালাইন চলতে থাকে, জামার একটা হাতা হয়ে ওঠে স্যালাইনের নল। আর তখনই ডানা মেলে গল্প, এতক্ষণের বীভৎস, রক্তাক্ত বাস্তব থেকে। মদিরাবাবা স্যালাইনকে বদলে দেন সুরায়। স্বচ্ছ তরল হয়ে ওঠে রঙিন, মকরন্দের কথকতায়। সে জানায় পিয়াক্কড় সোডা নরেশ তখন না কি জীবন পায়, দিব্য হেঁটে চলে যায় এক অনন্তের পথ ধরে।

বাস্তব থেকে পরাবাস্তবে, অন্ত থেকে অনন্তে একা অনায়াস যাতায়াত করতে থাকেন মকরন্দ দেশপান্ডে, তাঁর এই ঘণ্টাখানেকের একক অভিনয়ে। সেই যাত্রার সঙ্গীও করে নেন দর্শককে। থার্ড থিয়েটার বা তৃতীয় থিয়েটারের বাদল সরকারের ধরনটাই তাঁর নিজস্ব ধরন হয়ে ওঠে। তিন পিয়াক্কড়ের গল্প বলতে গিয়ে যখন তাদের চরিত্রে অংশত অভিনয় করেন তখনও কথক পিয়াক্কড় মকরন্দকেই দেখি আমরা। অনুকরণাত্মক বা মাইমেটিক রূপসজ্জা একেবারেই এখানে বর্জিত। বাদল সরকার যেমন স্পার্টাকাস-এ সাদা পাজামা-পাঞ্জাবির ওপর একটি হাতকাটা কলারহীন জহর-কোট পরে নিয়ে রোমান সেনেটর হয়ে যেতেন, তেমনই পিয়াক্কড় মারিয়ার গল্প বলতে গিয়ে চট করে একটা হাফপ্যান্ট মতো পরে আসেন আর হাতে একটা লাঠি নিয়ে নেন।
মারিয়ার সে-গল্পে পিয়াক্কড়ের আরেক রকম বর্ণমালা। মারিয়া অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। তার নাকি এক পূর্ব-পরিচয় আছে। তার সন্ধানে নেমে পড়ে এক ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট। সেই মারিয়ার বাড়িতে একদিন যায় পিয়াক্কড় মকরন্দ। গিয়ে দেখে তার দেওয়াল-জোড়া বই। আর, মারিয়া বলে যদি তুমি ঠিক বইটা বেছে নাও তবে তার পিছনে মিলবে বোতল। মকরন্দ বেছে নিতে থাকে… রেডিয়াম গার্লদের নিয়ে একটা বই, বুদ্ধদেব আর আনন্দর কথাবার্তার একটা বই… বোতলও পায়। কিন্তু মারিয়া বোতলগুলো দেন না, বইগুলো দেন, পড়তে বলেন। যদি সে-সব বইয়ের ভেতরের কথাটা ছুঁতে পারে মকরন্দ তবে পাবে বোতলগুলো। তার পরে সারা জীবন খুঁজেও আর মকরন্দ পায়নি মারিয়াকে।

আশ্চর্য! এই গল্পটা বলতে বলতে মারিয়ার জীবন-ইতিহাসে সাংবাদিকের সেই উঁকি-দেওয়ার কথাটা যখন আসে তখন অঙ্গনে ঝুলতে থাকা দড়ি দুটো একটু ফাঁক করে দর্শকদের দিকে তাকান মকরন্দ। সেই মুহূর্তটা বেঁচে থাকে। যেমন বেঁচে থাকে সোডা নরেশের গল্পে উড়ে আসা একটা কাকের মাটিতে বসার মুহূর্তটা। আমার মনে পড়ে যায় জাপানি হাইকু কিংবা বাশোর ছবির কথা।
আর মনে পড়ে বাংলার এক খাঁটি পিয়াক্কড়-এর সেই চিরপ্রণম্য আগুনের মতো কবি-কণ্ঠ:
দিন দুরন্ত, রাত তো মোহর,
আমার মধ্যে বাঁচিয়ে রাখো
অবিকলের উদাস সিঁড়ি, ভিতরে তার একলা থাকো
সব তো আমার চেনাশোনা, অন্তরে তার যথেষ্ট দিন
থাকলে থাকো, এবার বাঁকো, ভিতরে থাক একটা সিঁড়ি৷
সেই সিঁড়িতে বসবে বলে এসেছো ওই দয়ার অধিক
এক চুমুকে পান করো এই বিষের বাঁধন, নিরম্বু বিষ,
এই তো তোমার বয়ঃসন্ধি, পাঞ্জাবিতে ঠিকরে আলো
পড়ছে বুড়োর গায়ের মধ্যে, সেই তোমারি নতুন জহর।।
হোয়টস ইওর পয়জন?
……………………….
ছবিঋণ: লেখক
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved