
শীতের বেনারস যেন বিপুল মানুষের একজোট হওয়ার গল্প। গঙ্গার ঘাটে সকাল-দুপুর আড্ডা, মাঝিমল্লার হাসিঠাট্টা, ছোট মেয়েদের সাইকেল আর ছেলের দলের ক্রিকেট খেলায় আমরাও বাইরে থেকে এসে শামিল হই কিছুদিনের জন্য। নদী কাউকে ফেরায় না, গালিব যেভাবে দিল্লি থেকে এসে বেনারসে দেখেছিল চিরবসন্তের রেশ, আমরাও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে খোঁজ পাই সেই বিশ্বজনীনতার। না, এখনও বারাণসীর নদী, ঘাট আর মানুষকে ছুঁতে আলাদা করে কোনও রং, পতাকা বা ধর্মীয় পুঁথি লাগে না।
প্রচ্ছদের ছবি রবিকান্ত কুর্মা
Magar goi banāras shāhide hast ze
-gańgash subh-o-shām āīna dar dast
(Banaras is a beloved Beautiful,
Busy morning and evening
Doing make-up
Using the Ganges
for a mirror
In her hands)
Mirza Ghalib on Banaras

বেনারসের সকাল-বিকেল যেন সেজেই চলেছে; গঙ্গা নদী তার আয়না, তাকে সম্বল করেই প্রাচীন শহর হয়ে উঠছে প্রিয়দর্শিনী– এমন উপমা বোধ হয় গালিবের পক্ষেই লেখা সম্ভব। ১৮২৭ সালে দিল্লি থেকে কলকাতা আসার পথে কিছুদিনের জন্য বেনারসে থেকে গিয়েছিলেন গালিব। সেখানেই লেখেন তাঁর বিখ্যাত ফার্সি মসনবী (দীর্ঘ কবিতা) ‘চিরাগ এ দ্যয়র’। ১০৮ পংক্তির এই কবিতায় বারাণসীর চিরবসন্তের কথা লিখছেন গালিব। প্রবল শীত পড়লেও গঙ্গার পারে ঠান্ডা বাতাস দিল্লির মতো হুল ফোটায় না সর্বক্ষণ। আবার খুব গরমের দিনেও অপেক্ষা করা যায় শীতল সান্ধ্যনদী তীরের। এমন মনোরম আবহাওয়া, তাও আবার দিল্লি থেকে এসেই, নিশ্চয়ই গালিবের মনে ধরেছিল খুব। সম্ভবত ১৮২৭-এর সেপ্টেম্বর মাসে তিনি পৌঁছেছিলেন বারাণসী, ছিলেন নভেম্বর-ডিসেম্বরও (মতান্তর আছে), আর এই পুরো শীতকাল জুড়েই লিখেছেন বেনারসের নদী, নদীপারে মানুষ, তাদের রীতি-রেওয়াজ এবং এক অদ্ভুত বিশ্বজনীনতা (cosmopolitanism) নিয়ে। ২০০ বছর আগের সেই শীতের কাশীর কথা পড়তে পড়তে চলে এলাম বেনারস। গালিবের ‘চিরাগ এ দ্যয়র’ এর কয়েকটা লাইন এখানে এসেই আরও বেশি করে মনে পড়ে গেল, বাংলায় অনুবাদ করলে যা দাঁড়ায়:
পরিবর্তনই প্রকৃতির একমাত্র নিয়ম,
পরিবর্তনই চিরন্তন, কিন্তু এই শাশ্বত নিয়ম
কোনও এক যাদুবলে,
বারাণসীর জন্য প্রযোজ্য নয়…
……………………………………
শক্তি চট্টোপাধ্যায় নিয়ে সদ্য নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে ‘আ-শক্তি’, কেমন হল? জেনে নিন ক্লিক করে: তবু কিছু মায়া রয়ে গেল
……………………………………
গালিব বারাণসীতে এসে বলেছিলেন, এ যেন এক চিরবসন্তের দেশ। সময় এখানে থমকে দাঁড়ায়, পাল্টায় না কিছুই। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বেনারসে পা রেখে এমনই খানিকটা হেমন্তের আঁচ পেলাম। বসন্তের মতোই হালকা ঠান্ডা হাওয়া, গড়িমসি করে থাকা, একটা শাল বা নিতান্ত মোটা একখানা জামা পরেই কাটিয়ে দেওয়া সারাদিন, এমন ফুরফুরে দিনের খোঁজ মিলল। এখনও জাঁকিয়ে ঠান্ডা পরেনি বেনারসে, গঙ্গা বইছে অনেকটা নীচে, ধীর-স্থির, একমনে। ১৬-১৭ বছরের এক মাঝির সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা গেল এই গঙ্গাই গত দু’-তিন মাস আগে ঘোর তাণ্ডব দেখিয়েছে সর্বত্র। উত্তরাখণ্ড বা পার্শ্ববর্তী এলাকার বন্যার প্রভাব এখানেও পড়েছে, নদীর জলে ডুবে গিয়েছে ৮৪টা ঘাট, মন্দির সংলগ্ন সিঁড়ি আর কেল্লার একাংশ। সেই নদীই এখন আবার রাগ-অভিমানের পালা সাঙ্গ করে শান্ত সুশ্রী বালকের মতো ফিরে গিয়েছে তার নিজের প্রবাহে। নগরসভ্যতাকে ছেড়ে দিয়েছে তার জায়গা, শীতের আগমনে তাই ঘাট সংলগ্ন বাড়ি, মন্দির, উঠোন আর শতাধিক সিঁড়িতে আজ মানুষের ঢল। দুর্দিন পেরিয়ে এবার সোনা রোদ্দুরে গা-সেঁকার সময়।

আমরা বসলাম ব্রহ্মাঘাটে, চারিদিকে কুয়াশা, নদীর ওপার একেবারেই অদৃশ্য ঠেকছে। এই ঘাটে দশাশ্বমেধ আর মণিকর্নিকার মতো ভিড় হয় না, টুরিস্টদের আনাগোনা কম, স্থানীয় মানুষজনের আধিক্য। ঘড়িতে সকাল আটটা, একে একে লোকজন আসছে গঙ্গায় স্নান করতে; সাধু, মাঝি, দলবদ্ধ যুবকের ভিড়, কোনও খানে মধ্যবয়স্কা মহিলা স্নান সেরে ভেজা শাড়ি জড়িয়ে নিচ্ছে গায়ে, কোথাও একমনে ধ্যান করছে সাদা ধুতি পরা অশীতিপর বৃদ্ধ। ঠান্ডা জলে ডুব দিয়েও কারও কোনও তাপ-উত্তাপ নেই। তাড়াহুড়োর বালাই কম, দু’-মুঠো ভাত খেয়ে কোনও ক্রমে অফিস যাওয়ার হঠকারিতা নেই। অনেকটা সময় ধরে স্নান, তারপর সূর্যপ্রণাম, কেউ কেউ স্নান সেরে বসে আছে ঘাটে, একমনে তাকিয়ে আছে জলের দিকে, পঞ্চাশোর্ধ্ব এক পুরুষ গত আধঘণ্টা ধরে তেল মাখছে জলে নামবে বলে– এই সবই যেন শুধু নিয়মনিষ্ঠার ব্যাপার নয়, গতে বাঁধা আচার নয়, বরং নদীর সঙ্গে নিরন্তর কথা বলে চলা। মাঝি ফিরে যাবে নৌকা বাইতে, কচুরিওয়ালা তার ঝাঁপ খুলবে স্নান সেরে, ভিজে শাড়ি পরা মহিলা ঘরে গিয়ে উনুন জ্বেলে রান্না চাপাবে, কিন্তু সকলের দিনের শুরুটা হতে হবে গঙ্গার তীরে, ধীরে-সুস্থে নির্বিঘ্নে। প্রাচীন প্রথার আড়ালে এ যেন প্রতি সকালে নিয়ম করে নিজের সঙ্গে কিছুক্ষণ সময় কাটানো।

কুয়াশা ঘেরা শহরে একটু একটু করে রোদ বাড়ছে, সূর্যের আলো নদীর জলে পড়ে চিকচিক করছে। অল্প দূরেই দেখা গেল একটা বালির চর, গঙ্গার ঠিক মাঝখানে, কিছুক্ষণ আগে যা কুয়াশায় ঢাকা ছিল। উট আর ঘোড়া চড়ে বেড়াচ্ছে সেখানে। গঙ্গার মাঝে উট দেখতে পাব– এই প্রত্যাশা নিয়ে সত্যিই আসিনি। নিজের মনেই খানিক হেসে নিলাম; এ তো ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ আর ‘সোনার কেল্লা’ মিলে মিশে একাকার। যুবক মাঝি জানাল এই চর তারাও ছোটবেলা থেকে দেখে আসছে। শীতে জল কমলে দেখা যায়, বর্ষায় আর খোঁজ মেলে না। ঘাট ধরে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে দেখি সামনেই ছোট ছেলের দল সিঁড়িতে ক্রিকেট খেলছে। প্রায়শই বল চলে যাচ্ছে গঙ্গার জলে, কোনও মাঝি হয়তো সেই বল ফিরিয়ে দিতে তৎপর। খেলোয়াড়দের পাশ কাটিয়ে হেঁটে চললাম ব্রহ্মা ঘাট থেকে দুর্গা ঘাট, পঞ্চগঙ্গা, গণেশ, সিন্ধিয়া ঘাট– আরও কত নাম-না-জানা ছোট ছোট এলাকা। শীতের মেলামেশা এক আলাদা উদ্দীপনা তৈরি করে, অনেক দুপুর অবধি ঘাটে বসে থাকা যায় নিশ্চিন্তে। কেউ ক্রিকেট খেলায় মত্ত, কেউ বা পড়ছে শাস্ত্র, কোনও এক বাবাকে ঘিরে বসে আছে ১৯-২০ ছেলেরা, বাবাজির কথা সন্তর্পণে ভিডিও করে নিচ্ছে মোবাইলে, দু’টি দশ বছরের মেয়ে শীতের দুপুরে ট্রাই সাইকেল চালাচ্ছে ঘাটে, চতুর্দিকে ছোট ছোট জটলা। যে সকাল শুরু হয়েছিল নীরবে, নিভৃতে, নদীর সঙ্গে কথা বলে, এবার সেই নদীপারেই যূথবদ্ধ জীবনের গল্প, রসিকতা, আড্ডা আর একসঙ্গে আগুন পোহানোর সময় আসন্ন।

ঘাট পেরিয়ে এবার চললাম বেনারসের সরু সরু গলির দিকে। শীতে এখানে ‘মালাইয়ো’ পাওয়া যায়। আমাদের চেনা মাঝিভাই বলছিল মালাইয়ো তৈরি করতে নাকি আট ঘণ্টা সময় লাগে। দুধটাকে জ্বাল দিতে দিতে সেটা ঘন হয়ে এলে, শীতের রাতে খোলা আকাশের নিচে রেখে দিতে হয় অনেকক্ষণ। সারারাত শিশির পড়বে ঘন দুধে, তারপর সকালে আবার দু’-তিন ঘণ্টা জ্বাল দিয়ে তাতে চিনি আর দারুচিনি গুঁড়ো মেশানো হয়। ছোটবেলায় ক্যান্ডি ফ্লস বা বুড়ির চুল খেলে মুখে যেমন পেঁজা তুলোর মতো গলে যেত, অনেকটা সেরকম লাগল মালাইয়ো খেয়ে। তবে এখানে দুধ, কেশর আর দারুচিনির গন্ধটা উপরি পাওনা। পেট হয়তো ভরবে না এই মাখন মালাই খেয়ে, হালকা স্বাদের দুধের ফেনা বলা যায় একে, কিন্তু শীতের বেনারসের বিশেষ খাবার বলতে এই মালাইয়ো একবার অন্তত চেখে দেখা উচিত। পেট ভরানোর ইচ্ছে থাকলে ‘কাচৌরী’, জিলিপি, রাবড়ি বা পেড়া তো আছেই। শীতকালে মটরশুঁটির তরকারি আর মেথি বহুল প্রচলিত উত্তর ভারতে। মোটামুটি সব তরকারিতেই মেথির ব্যবহার হয় বেনারসে। আসার আগে মনে হচ্ছিল এত জিলিপি, দুধ আর ডুবো তেলে ভাজা কচুরি পেটে সহ্য হবে তো! আসার পরে দ্বিধা কাটতে বেশি সময় লাগল না। প্রতিদিন শতাধিক সিঁড়ি ভাঙা, উঁচু-নিচু রাস্তায় চলাফেরা আর ঘাট বরাবর প্রায় ৫-৬ কিলোমিটার হাঁটা, অনায়াসে দু’বেলার মালাই, রাবড়ি হজম করিয়ে দেয়। এই গুরুপাক গরমকালে কতটা সহ্য হত সন্দেহ আছে, তবে শীতের রোদে পাঁচবার রাবড়ি আর জিলিপিও কোনওরকম অস্বস্তিতে ফেলে না।

হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গিয়েছিলাম দশাশ্বমেধের পাশে বাঙালি টোলাতেও। সেখানে প্রায় ১০০ বছর পুরনো বাঙালি দোকান বিশুর জর্দ্দা পেরিয়ে পৌঁছে যেতে হয় বাজারে। শীতকালীন বাজারে হরেকরকম তাজা সবজি; বেগুন, টম্যাটো, মটরশুঁটি বিকোচ্ছে এদিক-ওদিক, কাশীর আমজনতার ভিড় এখানে। অনেকগুলো দোকানেই বাংলা হরফে বড় বড় করে লেখা ‘অন্নপূর্ণা হোটেল’, ‘দশাশ্বমেধ লজ’ বা ‘এখানে বাঙালি খাবার পাওয়া যায়’। ঘাটের কথা, খাওয়াদাওয়া আর বাজারের বিকিকিনি শেষ করে এবার শীতের চিড়িয়াখানায় যাওয়া যাক। মনে আছে, ছোটবেলায় শীত পড়লেই আলিপুরে লুচি-তরকারি নিয়ে পিকনিক করা ছিল প্রতি বছরের অলিখিত নিয়ম। বেনারসে এসেও যে শীতের মরশুমে পশুপাখির খাঁচার সামনে দাঁড়াব, সেটা আগে জানতাম না। আসলে বেনারস বললেই কাশী বিশ্বনাথ বা কালভৈরবের কথা যেভাবে আসে সর্বসমক্ষে, সারনাথের প্রসঙ্গ তেমন আসে না। বেনারসের সঙ্গে যে জনপ্রিয় অবয়বটি যুক্ত করা হয় সেখানে সারনাথ, ডিয়ার পার্ক বা পেল্লাই অশোক স্তম্ভের প্রত্নতাত্ত্বিক খোঁজ, উহ্য থেকে যায়। যদিও ঘাট থেকে এর দূরত্ব কিন্তু মেরে-কেটে নয়-দশ কিলোমিটার। অনেকে জানেই না যে, শীতের সারনাথ সত্যিই অপূর্ব; বিশেষ করে ডিয়ার পার্ক যেখানে অভয়ারণ্য তৈরি করা হয়েছে হরিণ, কুমির, ঘড়িয়াল, কৃষ্ণমৃগ আরও নানা পশুপাখিকে নিয়ে। খোলা জায়গায় ময়ূর ঘুরে বেড়াচ্ছে ইতস্তত, কুমির রোদ পোহাচ্ছে তার ডেরায়, নানারকম পাখি আর হরিণের সমাহারে তৈরি এই ডিয়ার পার্কের উৎপত্তির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বুদ্ধ জাতকের গল্প।

শীতের দিনে গল্প শোনার রেওয়াজও তো বহুল প্রচলিত, সারনাথের অভয়ারণ্যে ঘুরতে ঘুরতে বুদ্ধজাতকের কিংবদন্তি গল্প শুনতে তাই মন্দ লাগছিল না। আমরা জানি যে, জাতকের গল্প আসলে বুদ্ধের পূর্বজন্মের কাহিনি। বোধিসত্ত্ব পশু বা পাখিরূপে জন্মেছেন, কখনও টিয়া, বাঁদর বা হাতিদের রাজা হয়ে। তাঁর দয়া, আত্মত্যাগ বা করুণার গাঁথাই জাতকের গল্পরূপে ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। সারনাথের ডিয়ার পার্কের গল্পটিও বোধিসত্ত্বের মৃগরাজা হওয়ার কাহিনি। (সারনাথ এসেছে ‘সরঙ্গনাথ’ শব্দটি থেকে, সরঙ্গ অর্থাৎ ব্ল্যাক বাক বা কৃষ্ণসার হরিণ, সরঙ্গনাথ বা সারনাথ অর্থে হরিণদের রাজা)। কিংবদন্তি অনুসারে, বারাণসীর রাজা হরিণ শিকারে ছিলেন মত্ত, মৃগরাজ তাকে অনুরোধ করে এই অবাধ হত্যালীলা বন্ধ করতে, পরিবর্তে একটি হরিণকে রোজ পাঠিয়ে দেওয়া হবে রাজপ্রাসাদে। এই চুক্তি চলছিল নির্বিঘ্নে কিন্তু একদিন এক গর্ভবতী হরিণীকে প্রাসাদে পাঠানোর সময় এলে মৃগরাজা তাতে অসম্মত হন। যে প্রাণ পৃথিবীতে আসেনি তার ক্ষতি না-করে নিজেই খাদ্য হিসেবে যেতে চান। মৃগরাজের এই আত্মত্যাগে অভিভূত হয়ে বারাণসীর রাজা চিরকালের জন্য মৃগয়া বন্ধ করেন এবং সেই জমি হরিণদের স্বাধীন বিচরণক্ষেত্র হিসেবে দান করেন। এই গল্প শুনতে শুনতে অশোকের যুদ্ধত্যাগের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল, এখানেও তো বোধিসত্ত্বের প্রভাবে বারাণসী রাজ অহিংসার পথ বেঁছে নিলেন। জাতকের এই রূপক গল্পগুলি সারনাথের বিভিন্ন স্থানে আঁকা হয়েছে, সেগুলো দেখতে দেখতে বেনারসকে কেন ‘living musuem’ বলে তা বেশ বোঝা যায়। সন্ধে হওয়ার আগে গঙ্গার পারে ফিরে এলে ঈষৎ ঠান্ডা বোধ হয়। আগুন পোহানো শুরু হয়ে গিয়েছে চারদিকে, দূর থেকে মণিকর্ণিকা ঘাটের চিতার আগুন দেখা যাচ্ছে। হোটেলে ফেরার পথে আবারও মনে পড়ে গেল গালিবের দুটো লাইন, উনি লিখছেন:
দিল্লি যেন বেনারসকে দেখেছে তার স্বপ্নে…
বারাণসীকে সে স্নেহ করে, দোয়া করে তার জন্য…
একে তোমরা জিঘাংসা (hasad) বলো না, বরং দিল্লি
বেনারসকে বন্ধুর মতোই ঈর্ষা (ghibtah) করে।

শীতের বেনারস যেন বিপুল মানুষের একজোট হওয়ার গল্প। গঙ্গার ঘাটে সকাল-দুপুর আড্ডা, মাঝিমল্লার হাসিঠাট্টা, ছোট মেয়েদের সাইকেল আর ছেলের দলের ক্রিকেট খেলায় আমরাও বাইরে থেকে এসে শামিল হই কিছুদিনের জন্য। নদী কাউকে ফেরায় না, গালিব যেভাবে দিল্লি থেকে এসে বেনারসে দেখেছিল চিরবসন্তের রেশ, আমরাও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে খোঁজ পাই সেই বিশ্বজনীনতার। হয়তো আজকে দাঁড়িয়ে তৈরি করা হচ্ছে কোনও একরৈখিক আখ্যানের (গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ), মনে হতে পারে, ঘাটের মানুষ বুঝি এগিয়ে চলেছে এক রং, এক পতাকা, মন্ত্র বা রাষ্ট্রীয় আদর্শের দিকে। কিন্তু যে মানবিক ধর্মকে গালিব ছুঁতে পেরেছিলেন ২০০ বছর আগে, আমরাও চাইলেই সেই বারাণসীকে অনুভব করতে পারি সহজে; যে নদী, ঘাট আর মানুষকে ছুঁতে আলাদা করে কোনও রং, পতাকা বা ধর্মীয় পুঁথি লাগে না।
…………………
রোববার.ইন-এ পড়ুন সম্প্রীতি চক্রবর্তী-র অন্যান্য লেখা
…………………
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved