
একদা জোসেফ ফোর্ট নিউটন, আমেরিকার নাগরিক এক প্রটেস্টান্ট যাজক বলেছিলেন, ‘Men build too many walls and not enough bridges.’ নিউটনের মতো লোকেরা বরাবরই ব্রিজ গড়ার স্বপ্ন দেখেছেন। এখনও দেখছেন। যেমন দেখেছিলেন মার্টিন লুথার কিং। ‘…We cannot walk alone’– সুতরাং আমাদের মিলেমিশে যেতে তো হবেই। বলেছিলেন মার্টিন লুথার। এক্ষেত্রে ব্যাপারটি এত সহজ নয় যে, দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে বললেই গল্পের নটেগাছটি মুড়িয়ে যাবে।
গত সপ্তাহেই গোটা বিশ্ব আঁতকে উঠেছে একটি ‘ভাইরাল’ ভিডিও দেখে। যেখানে স্কুল ফেরত পাঁচ বছরের একটি ভারতীয় মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে মাকে বলছিল, ‘I want new skin colour…’!
চোখে জল, কান্নায় ভেঙে যাচ্ছে স্বর, কাতর হয়ে বলছিল কন্যা, এটাই তার স্বপ্ন এখন– সে ফরসা হতে চায়। স্কুল-সহপাঠীরা তার বাদামি রং নিয়ে উপহাস-অপমান করেছিল। সে বড় মারাত্মক অপমান! এই অপমান ও প্রত্যাখ্যান থেকে কীভাবে নিজেকে রক্ষা করতে হয়, পাঁচ বছরের মেয়ে কি আর জানে সেকথা! আমরা– বড়রাও কি আর জানি! কন্যার বয়স পাঁচ বলেই সে নিশ্চিন্তে বলতে পারে, ‘I want to be like the rest’। সে বিশ্বাস করে, চাইলেই তার অ্যাঞ্জেল পালটে দিতে পারে গায়ের রং! ‘…and then, suddenly, her dream comes true.’
এ এক অদ্ভুত সমাপতন! পাঁচ বছরের কন্যাটি জানত না প্রায় সাড়ে ছ’ দশক আগে এক পুরুষও বলেছিলেন তাঁর স্বপ্নের কথা– ‘I have a dream’। রঙের বিভেদ মুছে দেওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি, নাম তাঁর মার্টিন লুথার কিং। তিনি তখন ৩৪। ৩৪ বছরের ম্যাচিওরড পুরুষ বলেই তিনি ‘rest’-দের দলে ভিড়ে নিজেকে আড়াল করতে চাননি। বরং তাঁর স্বপ্ন পালটে দিয়েছিল সমাজ। জোর গলায় তিনি ঘোষণা করতে পেরেছিলেন, “We can never be satisfied as long as our children are stripped of their adulthood and robbed of their dignity by signs stating ‘For Whites Only’.”
বছর চৌত্রিশের তারুণ্যের ভাষা আলাদা– কিন্তু পাঁচ আর চৌত্রিশের স্বপ্নে ফারাক নেই কোনও। ‘গ্রেট মার্চ অন ওয়াশিংটন’-এ স্বপ্নদেখা তরুণটি তাই বলতে পারেন, ‘I have a dream’। সময়-প্রেক্ষিত পালটায় হয়তো, কিন্তু ‘History repeats itself’।

স্বপ্নদেখা তরুণটি ব্যর্থ নন, কিন্তু না-পাওয়ার পাল্লা আজও ভারী বলেই পাঁচ বছরের শিশুকে কাতর কণ্ঠে বলতে শোনা যায়, ‘আমি ফরসা হতে চাই, এটাই আমার স্বপ্ন’। আসলে বহু পথচলা এখনও যে বাকি। কালো-বাদামি শিশুরা এখনও সাদাদের দলে মিলেমিশে এক হয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। গায়ের রঙের দরুন যাদের মাথা বারবার হেঁট হয়ে যায়, সেইসব শিশু কি আর লড়াই করে অধিকার আদায়ের কথা জানে! তাদের ভরসা তাই অ্যাঞ্জেল। গায়ের রং পালটে গেলেই এক লহমায় পালটে যাবে পৃথিবী– এই তাদের বিশ্বাস। তখন আর লজ্জা নয়, কোনও হীনম্মন্যতা নয়– ‘আমি-তুমি’র দেওয়াল নয়, সবাই এক। আমরা– বড়রা, যারা কালো ও বাদামি– তারাও প্রত্যাখ্যান-অপমানের লজ্জা সহ্য করতে করতে এখন আর সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পালটানোর কথা ভাবি না, বরং শিশুদের মতো করে ভাবি, যদি কোনও এক জাদুকাঠির ছোঁয়ায় রাতারাতি ফরসা হওয়া যেত! পৃথিবীর সব কালো আর বাদামিরা তখন এক হয়ে যাবে– এই স্বপ্ন দেখতে দেখতে আমরাও জাদুকাঠির দিকে ঝুঁকি। আমরা ভরসা করি– ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি থুড়ি গ্লো অ্যান্ড লাভলিতে।
সুতরাং পাঁচ বছরের কন্যাটির গায়ের রং বদলে ফেলার আকাঙ্ক্ষাকে কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা যাবে না। পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে এমনটি অহরহ ঘটছে। কৃষ্ণাঙ্গরা যেমন, তেমনই ভারতীয়রাও স্কুল থেকে খেলার মাঠ, রিয়েলিটি শো– সবখানেই গায়ের রঙের জন্য বুলিংয়ের শিকার। শুধু কি আর বিদেশের মাটিতে! নিজেদের দেশেও কি নয়? নইলে বাজার ছেয়ে যাবে কেন ফরসা হওয়ার ক্রিমে!

এর জন্য দায়ী কে? প্রশ্নটি সহজ আর উত্তরও তো জানা। কালপ্রিট আমাদের স্কুলিং। সে বড় মারাত্মক প্রতিষ্ঠান। গৃহকোণ থেকে সমাজ– জন্ম-মুহূর্ত থেকে প্রতিক্ষণ সৌন্দর্যের প্রচলিত মানদণ্ড সম্পর্কে আমাদের সজাগ করে তুলতে চাইবে। ফলত শিশুরাও প্ররোচিত হয়। না-বুঝেই। বড়দের দৃষ্টিকোণ তাদের প্রভাবিত করে। ত্বকের রং দিয়ে তারা ভালোমন্দ বিচার করতে শেখে। অতএব পৃথিবী ভাগ হয়। সাদা এবং কালোয়। কালোরা অন্ধকারে মিশে যেতে চায়। লজ্জায়, হীনম্মন্যতায়। দেওয়ালের ছায়া ক্রমে দীর্ঘতর হয়। সেই ছায়াতেই চাপা পড়েছিল রূপকথায় বিশ্বাসী পাঁচ বছরের কন্যাটি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে তার ভ্রম হয়, সাদা বুঝি আলোর প্রতীক। ছায়াকে, কালোকে শাসন করার অধিকার তারা অর্জন করেছে। অতএব, সে আলো হতে চায়– ফরসা হতে চায়।
এই ভ্রম থেকে মুক্তি সহজ নয়! আর একে ভ্রমই বা বলি কী করে! বরং এটাই যে সত্য, সেটাই তো প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে এতদিন ধরে। সেই প্রতিষ্ঠার মূলে আঘাত করতে হলে আলো-অন্ধকারের মাঝখানের দেওয়ালে চিড় ধরানো চাই। কিন্তু এই দেওয়াল অভেদ্য প্রায়! একদা জোসেফ ফোর্ট নিউটন, আমেরিকার নাগরিক এক প্রটেস্টান্ট যাজক বলেছিলেন, ‘Men build too many walls and not enough bridges.’ নিউটনের মতো লোকেরা বরাবরই ব্রিজ গড়ার স্বপ্ন দেখেছেন। এখনও দেখছেন। যেমন দেখেছিলেন মার্টিন লুথার কিং। ‘…We cannot walk alone’– সুতরাং আমাদের মিলেমিশে যেতে তো হবেই। বলেছিলেন মার্টিন লুথার।
এক্ষেত্রে ব্যাপারটি এত সহজ নয় যে, দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে বললেই গল্পের নটেগাছটি মুড়িয়ে যাবে। তবে হ্যাঁ, পাঁচ বছরের কন্যাটির সঙ্গে যে ঘটনাটি ঘটল, এবং এর প্রতিক্রিয়া স্বরূপ বিশ্বজুড়ে যে উদ্বেগ-দুশ্চিন্তা-অস্বস্তি দেখা গেল, তাতে নিশ্চিত হওয়া গেল বর্ণভেদটা যে অপরাধ– অন্তত সেই বোধটা অনেকের মনের গভীরে কাজ করছে। গোটা বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশও এই নিয়ে উদ্বিগ্ন। কারণ মেয়েটি ভারতীয়। আর লাঞ্ছিত হয়েছে সে বিদেশের মাটিতে। অথচ এঁরাই পুত্র-ভ্রাতা কিংবা আত্মীয়ের বিয়ের সময় ফরসা পাত্রীর সন্ধান করবেন।

তাই বলছিলাম, সাদা-কালোর মাঝখানের দেওয়ালটা বড়ই মজবুত। তাতে ফাটল ধরানো সহজ কম্ম নয়। সম্ভবত অ্যাইবিলিনরাই পারে শুধু এতে চিড় ধরাতে। এর জন্য হাজার হাজার অ্যাইবিলিন চাই আমাদের। তারাই জানে শুধু কীভাবে ব্রিজ গড়তে হয়! অ্যাইবিলিন ক্লার্ক– ক্যাথরিন স্টকেটের ‘দ্য হেল্প’ উপন্যাসের ছোট্ট মেই মবলির ন্যানি ছিল সে। মবলিকে যে গল্প শোনাত:
‘দুটি ছোট্ট মেয়ে ছিল বুঝলে, একজন কালো– আর একজন খুব ফর্সা।’
মবলি অ্যাইবিলিনের চোখে চোখ রেখে মন দিয়ে শুনত তার গল্প।

“একদিন ছোট্ট কালো মেয়েটি সাদা মেয়েটির কাছে জানতে চাইল, ‘তোমার গায়ের রং এমন ফ্যাকাসে কেন বলো তো?’
ফরসা মেয়েটি উত্তর দিয়েছিল, ‘আমি জানি না। তা তোমার গায়ের রং এত কালো হল কীভাবে? তোমার কী মনে হয়, এর কারণ কী হতে পারে?’
না, এদের দু’জনের কারওরই জানা ছিল না এর উত্তর। তখন ফরসা মেয়েটিই আবার বলে, ‘আচ্ছা বেশ! দেখো, তোমারও চুল আছে, আমারও চুল আছে।’
বলতে বলতে অ্যাইবিলিন আলতো করে মবলির চুলে হাত বোলাত।
শুনে ছোট্ট কালো মেয়েটি বলেছিল, ‘আমার নাক আছে, তোমারও নাক আছে।’
অ্যাইবিলিন হাত বাড়িয়ে মবলির নাকে হালকা টোকা দিত। মবলিও হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করত অ্যাইবিলিনের নাক।
ফরসা মেয়েটি বলে, ‘আমার পায়েও আঙুল আছে, তোমার পায়েও।’
অ্যাইবিলিন মবলির পায়ের আঙুলগুলোতে সুড়সুড়ি দিত। কাজ করার সময় বলে অ্যাইবিলিনের পায়ে সাদা জুতো। মবলির তাই তার পায়ের আঙুল ছুঁয়ে দেখা হত না।
‘তাহলে তো আমরা এক-ই বলো! শুধু রংটাই যা আলাদা।’ ছোট্ট কালো মেয়েটি বলেছিল।
ছোট্ট ফরসা মেয়েটি তাতে সায় দিলে তারা বন্ধু হয়ে যায়। ব্যস্, গল্প শেষ।
বলে অ্যাইবিলিন যখন মেই মবলির দিকে তাকিয়েছিল, ভেবেছিল মবলি হয়তো বলবে, এই বুঝি তোমার গল্প! এতে তো কোনও গল্পই নেই! এ যদি গল্প হয়, তবে এত বাজে গল্প এর আগে আমি শুনিনি কখনও।
কিন্তু মেই মবলি হেসেছিল, বলেছিল, ‘আরেকবার গল্পটা শোনাও তো দেখি।’…”

তাই বলছিলাম, আমাদের অগুনতি অ্যাইবিলিন চাই। যারা পৃথিবীর সব মেই মবলিদের এমন গল্প শোনাবে। ফরসা মবলিরা জড়িয়ে ধরবে কালো অ্যাইবিলিনদের। জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খাবে। ঘৃণার পাথরটা তখন নরম হবে। গলবে। তাতে ধুয়ে যাবে সাদা-কালো রং। পালটাবে স্কুলিং। তখন নিশ্চিত সাদা-কালোর মাঝখানের ঘৃণার দেওয়ালটা ভাঙবে দ্রুত। ‘Free at last, Free at last, Great God a-mighty, We are free at last’– ‘গ্রেট মার্চ অন ওয়াশিংটন’-এ জমায়েত শ্রোতাদের মতো নতুন প্রজন্মও তখন গাইবে কোরাসে– না, কোনও ‘গ্রেট গড’-এর উদ্দেশ্যে নয়, তারা গাইবে গান গণদেবতার উদ্দেশ্যে…
……………………
রোববার.ইন-এ পড়ুন জয়িতা দাস-এর অন্যান্য লেখা
……………………
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved