Robbar

ফুরিয়ে যাওয়া স্মৃতির চিরন্তন গল্প

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 22, 2025 7:55 pm
  • Updated:December 22, 2025 7:55 pm  

আমরা যারা নয়ের দশকের চারপাশের পরিবর্তন চোখের সামনে দেখেছি, তাদের স্মৃতিতেও থেকে গিয়েছে ঠিক আগের সময়টার ঢিমেতালের জীবন। সময়টাকে যেন তখন চোখে দেখা যেত। হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করা যেত। লেখক সেটাই করেছেন। যে সময় নেই, তাকে তিনি স্মৃতির ভিতরে ধরে রেখেছেন। এই বইয়ের অধিকাংশ লেখাতেই একটা চাপা বিষণ্ণতা আছে। নাকি মায়া?

বিশ্বদীপ দে

স্টিফেন কিং তাঁর ‘ইট’ নামক মহাগ্রন্থের উৎসর্গপত্রে লিখেছিলেন ‘ফিকশন ইজ দ্য ট্রুথ ইনসাইড দ্য লাই’। মিথ্যের ভিতরে লুকিয়ে থাকা সত্যিই হল ফিকশন। এর ঠিক উল্টো অবস্থানে দাঁড়িয়ে থাকে নন ফিকশন। যার মধ্যে পড়ে স্মৃতিকথাও। সত্যের ভিতরে লুকিয়ে থাকা মহাসত্যকে অন্বেষণ করা হয় যেখানে। আর সেই সত্যিটা বিজ্ঞান-ইতিহাসের সত্যি নয়, বরং তুচ্ছাতিতুচ্ছের ভিতরে লুকিয়ে থাকা সত্যি। সভ্যতা বদলে দেওয়া গাণিতিক সমীকরণের বিপ্রতীপেই থাকে মধ্যবিত্তের দৈনন্দিন বেঁচে থাকা। কিন্তু শালিখ-খোঁটা জীবনেও থাকে নানা বিচিত্র সমীকরণ। ‘ফুরোনো কথা’ অতীত খুঁড়ে তুলে আনে সেই সব ঠিক-ভুল অঙ্ক!

গত শতকের নয়ের দশকে এদেশে মুক্ত অর্থনীতির সূচনা। তার ঠিক আগের পৃথিবীর নানা জলছবি ও এক ঢিমে জীবনের আঁচে বাঙালির কালাতিপাতই এই বইয়ের বিষয়। লেখক বিশ্বজিৎ রায় ‘ঘটিপুরুষ’ বইটির মাধ্যমে স্মৃতিকথায় তাঁর অনায়াস দক্ষতা বুঝিয়েছিলেন। এই বই সেই দক্ষতারই সম্প্রসারণ।

‘ফুরোনো কথা’ এক ফুরিয়ে যাওয়ার সময়ের কথা বলে। একটানা লেখা কোনও গদ্য নয়। ছোট্ট ছোট্ট গদ্যের সমাহার। শুরুতে লেখকের ‘নিবেদন’ অংশ থেকে জানা যায় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বেরনো লেখাকেই দুই মলাটের ভিতরে নিয়ে আসা হয়েছে। কিন্তু আলাদা আলাদা লেখা হলেও এদের মধ্যে অমোঘ যোগসূত্র ওই হারিয়ে যাওয়া সময়। বইয়ের ব্লার্বে ‘স্মৃতির মনোভূমি’ শব্দটি পাচ্ছি। এই বই আক্ষরিক ভাবেই স্মৃতির মনোভূমির কথাই বলে।

কোনও লেখাই খুব বড় নয়। শিরোনামও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছোট! যেমন ‘বাবা’, ‘আদর’, ‘কন্ডোম’, ‘আঁচ’, ‘খাঁজ’ ইত্যাদি। খুব ছোট্ট ছোট্ট স্কেচধর্মী লেখাগুলির মধ্যে রয়ে গিয়েছে এক-আধটা বাক্য– যা আলাদা করে লেখাগুলিকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়।

যেমন ‘কন্ডোম’। এই লেখাটি মূলত সাত-আটের দশকে বাঙালির গর্ভনিরোধক বড়ি খাওয়া ও কন্ডোমে অনীহার কথা বলে। সারাজীবন গর্ভনিরোধক বড়ি খাওয়া বাঙালি গৃহবধূ একেবারে জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে প্রথম কন্ডোম দেখলেন। লেখকের উপলব্ধি– ‘পিলের থেকে কন্ডোমের ইতিহাস প্রাচীন।… অনেক সময় পুরনো জিনিস আমাদের দেখা হয়ে ওঠে না।’ আবার ‘সমুদ্র চশমা’ রচনাটির শেষ বাক্য– ‘সমুদ্র কোনো কোনো জিনিস নিলে আর ফিরিয়ে দেয় না– যেমন চশমা।’

প্রতিটি লেখাই নির্ভার। তুলোর মতো তা মনোভূমিতে ভেসে বেড়াতে থাকে। তারপর চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে শেষও হয়ে যায়। কিন্তু রেশ থেকে যায়। নিজের জীবন ছেঁচে লেখক চোখের সামনে মেলে ধরেন রোদে ঝিকোনো মুক্তোবিন্দু। বিন্দু বিন্দু উচ্চারণেই যাদের সিদ্ধিলাভ।

আমরা যারা নয়ের দশকের চারপাশের পরিবর্তন চোখের সামনে দেখেছি, তাদের স্মৃতিতেও থেকে গিয়েছে ঠিক আগের সময়টার ঢিমেতালের জীবন। সময়টাকে যেন তখন চোখে দেখা যেত। হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করা যেত। লেখক সেটাই করেছেন। যে সময় নেই, তাকে তিনি স্মৃতির ভিতরে ধরে রেখেছেন। এই বইয়ের অধিকাংশ লেখাতেই একটা চাপা বিষণ্ণতা আছে। নাকি মায়া?

‘বাবা’ নামের লেখাটির কথাই ধরা যাক। এখানে বাবা এমন এক মানুষ যাঁর নিজের বলতে দাড়ি কামানোর ক্রিম, ব্রাশ, ফটকিরিতে ভরা একটা বাক্স ও নীল রঙের মগ ছিল। দু’-তিনটের বেশি বাইরে পরার জামাকাপড়ও ছিল না তাঁর। এহেন একজন মানুষ বাবাকে তাঁর সন্তান জড়িয়ে ধরতে পারছে না। মায়ের সঙ্গে যে আদরের দেওয়া নেওয়া, বাবার সঙ্গে কেন যে সেটা হয় না! তবু এরই মাঝে মধ্যরাতে ঘুমের ঘোরে সেই বাবাকেই আদরে ভরিয়ে দেয় বালক। আসলে ‘ভুল’ করে! লেখাটির অন্তর্লীন মায়া বুকের ভিতরে মেঘ ভাসিয়ে তোলে।

এক আশ্চর্য দৃশ্যকল্প তৈরি করে ‘ঘড়ি’। “একটা ঘড়ি আঁকতে বসলাম। হাতের ওপর নীল কালির পেন দিয়ে আমার ঘড়ি আঁকা।… এ ঘড়ির কাঁটা তো চলে না।… রেডিয়ো থেকে বাইরে এল সেই ছেলেটা। সে আমার আঁকা ঘড়ির কাঁটাটাকে একটু একটু করে ঠেলতে লাগল। বলল, ‘এ তো দিশি ঘড়ি, আমি এটাকে ঠিক চালিয়ে দেব।’ তারপর সত্যি সত্যি আমার আঁকা হাত ঘড়ি চলতে লাগল…” এই রেডিও থেকে বেরিয়ে আসা ছেলেটা মার্ফি কোম্পানির রেডিওর সেই মুখে আঙুল দিয়ে বসে থাকা ছেলেটি। এই কল্পবাস্তবতার সঙ্গেই লেখক বুনে দেন এক ঘোরতর বাস্তব। আমরা দেখি রুমালে বেঁধে মাইনে এনে এক গৃহকর্তা তাঁর গিন্নির সঙ্গে বসে সংসারের হিসেব মেলাচ্ছেন। ‘বাড়িভাড়া ২২৫, মঙ্গলাদি ১০, মাসকাবারি ৫০০, বাজার ৫০০’… ঘড়ি ও টাকা এখানে কী আশ্চর্যভাবে মিলে যায়! দম দেওয়া ঘড়ির মতোই সংসারকেও যেন দম দিয়ে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মানুষ। ঘড়ির ক্রমশ স্লো হয়ে যাওয়া মধ্যবিত্তর মাসের শেষে অর্থ ফুরিয়ে ফেলার কথাই কি মনে করায়? এই সমস্যা আজও আছে। কিন্তু সেই হারানো সময়ে তার চেহারা-চরিত্র যেন আলাদা ছিল।

চৌবাচ্চা, দম দেওয়া ঘড়ি, তোলা আর পাতা উনুনের মতো ‘তামাদি’ হয়ে যাওয়া জীবননাট্যের ‘প্রপস’কে লেখক আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরেন। খুব ছেলেবেলা থেকেই তাঁর দেখার চোখ ছিল তীক্ষ্ণ। দেওয়ালে বাল্বের ধারে বসবাসকারী নধর চেহারার টিকটিকি পর্যন্ত কালো অক্ষরে হেঁটে বেড়ায় বইয়ের ভিতরে। আজ যে আগুন আমরা অনায়াসে জ্বালাই, সেটাই একসময় কত কষ্ট করে জ্বালতে হত মধ্যবিত্ত সংসারে, সে-কথা পড়তে পড়তে কয়েক দশকে বাঙালির বদলে যাওয়াটা কালখণ্ডের হিসেবের বাইরে ‘শতাব্দীপ্রাচীন’ মনে হতে থাকে। লেখকের উচ্চারণ স্পষ্ট। কোনও সংকোচ কিংবা থমকে থাকা নেই। তাই অনায়াসে তিনি বারবার ব্যবহার করেন ‘পায়খানা’র মতো শব্দ। মাসের বিশেষ বিশেষ দিনে মা-কে ঠাকুরঘরে না যেতে দেখা কিংবা প্রতি রাতে ‘ওষুধ’ খেতে দেখার অভিজ্ঞতার কথা লিখতে পারেন অনায়াসে। এই সত্যনিষ্ঠ অনাবিল উচ্চারণ ও সহজতা লেখাগুলিকে পাঠকের প্রিয় করে তোলে অনায়াসে।

অরিন্দম নন্দীর করা প্রচ্ছদ সুন্দর। অসংখ্য ঘড়ির সমাহারে রয়েছে এমন ঘড়িও, যাদের কাঁটা আছে, কিন্তু সংখ্যাগুলি নেই! সময়ের সারণীকে মুছে তার স্থানিক অবস্থানকেই অসীমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যেন! চমৎকার ছাপা, বাঁধাইও। সবচেয়ে বড় কথা, বানান ভুল বিশেষ চোখে পড়ে না। কেবল লেখক পরিচিতিতে একেবারে শেষে ‘অবসর’ বানানটিতে ভ্রান্তি রয়ে গিয়েছে। চট করে ফুরিয়ে যায় ‘ফুরোনো কথা’। কিন্তু বইটিকে বালিশের পাশে রেখে দিতে সাধ হয়। মাঝে মাঝেই চোখ বুলনোর অভিপ্রায়ে।

ফুরোনো কথা
বিশ্বজিৎ রায়
রাবণ
৩২৫ টাকা