on kolkatar jishu and poet nirendranath chakravarty
‘কলকাতার যীশু’, সীমান্তহীন নীরেন্দ্রনাথ
Published by: Robbar Digital
Posted:December 25, 2025 2:25 pm
Updated:December 25, 2025 2:25 pm
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী নিজে বলেছেন, ‘আমার কবিতা লেখায় কল্পনার প্রয়োগ তেমন নেই। চারপাশে যা দেখি, শুনি, যে অভিজ্ঞতা হয়, তা নিয়েই আমার কবিতা গড়ে ওঠে।’ এই কবিতাটিও তেমনই এক দিনের একটি দৃশ্যের বর্ণনা। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, একদিন বিকেলে আনন্দবাজার পত্রিকা অফিস থেকে দোতলা বাসে বাড়ি ফিরছেন, হঠাৎ বাসটা প্রচণ্ড ব্রেক কষে ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। বছর চার-পাঁচের ন্যাংটো একটি শিশু টলমল করতে করতে সদাব্যস্ত, চওড়া চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের একপাশ থেকে উল্টোদিকের ফুটপাতে হেঁটে চলে গেল।
দীপংকর চক্রবর্তী
‘লালবাতির নিষেধ ছিল না,
তবু ঝড়ের-বেগে-ধাবমান কলকাতা শহর অতর্কিতে থেমে গেল;’
…এমনই আকস্মিকতা দিয়ে শুরু হয়েছে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘কলকাতার যীশু’।
কোনও এক ভাদ্র দ্বিপ্রহরে সদ্য বৃষ্টিস্নাত কলকাতার চৌরঙ্গি পাড়ায় কবি দোতলা বাসে করে চলেছেন। মেঘ ফুঁড়ে রৌদ্রের তীব্র ঝলক মায়াবী আলোয় শহরকে ভাসিয়ে দিচ্ছে। তখনই হঠাৎ ওই ঝাঁকুনি।
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
‘স্তব্ধ হয়ে সবাই দেখছে,
টালমাটাল পায়ে,
রাস্তার এক-পার থেকে অন্য-পারে হেঁটে চলে যায়
সম্পূর্ণ উলঙ্গ একটি শিশু।’
তাকে বাঁচাতেই ভয়ংকরভাবে টাল সামলে দাঁড়িয়ে পড়ে ট্যাক্সি ও টেম্পো, বাঘমার্কা ডবল ডেকার। তখন সত্যিই স্টেট বাসের গায়ে আঁকা থাকত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মুখের একটা ছবি, নীচে লেখা সিএসটিসি– স্টেট ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশনের সংক্ষিপ্তাকার। শুধু দোতলা বাস বা ডবলডেকার লিখলেও চলত, কিন্তু বিপুলকায় যানটির বিশালতা আর ভয়ংকরত্ব বোঝানোর জন্য নীরেন্দ্রনাথ ইচ্ছে করে ‘বাঘমার্কা’ শব্দটি বসিয়েছেন।
ঋণ: কলকাতা বাস-ও-পিডিয়া
এমন দৃশ্য তো কলকাতা নিত্যদিন দেখে! মনে হয়, এই বুঝি ব্যস্ত রাস্তায় ছুটে চলা বাস বা গাড়ির তলায় চাপা পড়ে গেল অসতর্ক বাচ্চাটা। গেল গেল করে সবাই ছুটে আসে। রুদ্ধশ্বাস কয়েক মুহূর্ত পেরিয়ে যখন দেখা যায় বস্তুত কিছুই ঘটেনি, যে যার কাজে ফেরে। পথচারী, গাড়ি চালকেরা আবার পথ চলা শুরু করেন।
এইবার বোঝা গেল, কেন ওই আপাত সাধারণ দৃশ্য কবির চোখে ঘোর লাগিয়ে দিয়েছে। ওই পথশিশুকে দেখে তাঁর যিশুর কথা মনে হয়েছে। যিশুখ্রিস্টের অন্তিম যাত্রার কথা। যখন রক্তাক্ত অবিন্যস্ত চরণে তিনি নিজের ভারী ক্রুশ বহন করে বধ্যভূমির দিকে চলেছেন। ঈশ্বরের সন্তান জানেন, একটু পরেই তিনি ক্রুশবিদ্ধ হবেন বিনা অপরাধে, মানুষের হিংসার বলি হয়ে। তবু তাঁর চোখ দু’টিতে করুণা মাখা। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই। চলতে হবে, তাই নিস্পৃহ ভঙ্গিতে অশক্ত পায়ে যিশু চলেছেন।
কবির কল্পনায় ওই শিশুটিই যেন যিশু হয়ে ধরা দিয়েছে। কলকাতার যিশু।
‘কিছুতে ভ্রুক্ষেপ নেই;
দুদিকে উদ্যত মৃত্যু, তুমি তার মাঝখান দিয়ে
টলতে টলতে হেঁটে যাও।’
এই শিশুটির চোখেও তেমনই নিস্পৃহতা। শুধু যেতে হবে। হঠাৎই কেন যেন রাস্তাটা তাকে পার হতে হবে। তাতে তার জীবন বিপন্ন হতে পারে কি না, তা-ও সে জানে না। দু’হাজার বছর আগে যিশুর অন্তিম যাত্রার সঙ্গে কলকাতার সেদিনের পথশিশুর ওই যাত্রার মিল কবির কল্পনাকে এমনই নাড়া দিয়েছিল, বাড়ি ফিরে সেই রাতেই তিনি লিখে ফেলেন এই কবিতা, কলকাতার যিশু।
প্রচ্ছদশিল্পী: পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায়
অথচ মাসটা তো ডিসেম্বর ছিল না, এমনকী, শীতকালও না যে যিশুর অনুষঙ্গ মাথায় আসবে। নীরেন্দ্রনাথ কবিতাটি লিখেছেন বাংলা ১৩৭৬ সালের ২৬ ভাদ্র। কিন্তু কবিদের একটি তৃতীয় নয়ন থাকে। তাঁরা এমন কিছু দেখতে পান, বুঝতে পারেন, যা সাধারণের চোখে পড়ে না।
যদিও নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী নিজে বলেছেন, ‘আমার কবিতা লেখায় কল্পনার প্রয়োগ তেমন নেই। চারপাশে যা দেখি, শুনি, যে অভিজ্ঞতা হয়, তা নিয়েই আমার কবিতা গড়ে ওঠে।’ এই কবিতাটিও তেমনই এক দিনের একটি দৃশ্যের বর্ণনা। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, একদিন বিকেলে আনন্দবাজার পত্রিকা অফিস থেকে দোতলা বাসে বাড়ি ফিরছেন, হঠাৎ বাসটা প্রচণ্ড ব্রেক কষে ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। বছর চার-পাঁচের ন্যাংটো একটি শিশু টলমল করতে করতে সদাব্যস্ত, চওড়া চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের একপাশ থেকে উল্টোদিকের ফুটপাতে হেঁটে চলে গেল। নির্বিকার, ভ্রুক্ষেপহীন নিষ্পাপ চোখ-মুখ।
এই দৃশ্যটিকেই নীরেন্দ্রনাথ বর্ণনা করেছেন নিজস্ব কবিতার ভাষায়। এই আপাত সাধারণ দৃশ্যের মধ্যে কল্পনার প্রয়োগ আমরা দেখি শুধু মাত্র যিশুখ্রিস্টের সঙ্গে পথশিশুটির তুলনায়। তাতেই ‘কলকাতার যীশু’ হয়ে উঠেছে অনন্য সাধারণ।
শিল্পী: যামিনী রায়
প্রসঙ্গত আমার ব্যক্তিগত একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমি তখন আনন্দবাজার পত্রিকায় সাংবাদিক। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী সেখানে আছেন অ্যাসিসট্যান্ট এডিটর পদে। পত্রিকার রীতি অনুযায়ী আমি তাঁকে ‘নীরেনদা’ বলেই ডাকতাম। একবার ২৫ ডিসেম্বর কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে গিয়ে আমাদের ফোটোগ্রাফার একটি ছবি তুলে আনেন। বড়দিনের ছুটির ভিড়ের মধ্যে ভিক্টোরিয়া প্রাঙ্গণে এক মা কোলে তাঁর শিশুপুত্রকে নিয়ে বসে আছেন। শিশুটি মায়ের দিকে অপলক তাকিয়ে, মায়ের চোখ মুখ স্নেহের আলোয় উজ্জ্বল। সুন্দর ছবি। ‘কলকাতার যীশু’র আদলে আমি তার ক্যাপশন করলাম, ‘কলকাতার ম্যাডোনা’। মা মেরির কোলে যিশু এবং ‘মায়ের কোলে শিশু’ অর্থেও যা ব্যবহার করা হয়। পৃথিবীর তাবৎ নামী শিল্পী ‘ম্যাডোনা’ এঁকেছেন। বার্তা সম্পাদক ক্যাপশনের প্রশংসা করলেন, আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতায় ছবিটি বেরল। পরদিন আমার সহকর্মীদের কেউ কেউ বললেন, ‘ম্যাডোনা’ বলতে মা ও শিশুর ভাবনা মাথায় আসে না। প্রথমেই বিশ্ববিখ্যাত পপ গায়িকার কথা মনে হয়। মন খারাপ নিয়ে নীরেনদার কাছে গেলাম। উনি হেসে বললেন, একেবারে ঠিক ক্যাপশন হয়েছে। বড়দিনের সময় এমন ছবির ‘ম্যাডোনা’ ক্যাপশন দেখে যাদের মা মেরির কোলে যিশু, অথবা মা ও শিশুর বদলে পপ সিঙ্গারের কথা মনে হয়, তাদের করুণা করা ছাড়া আর কী-ই বা করা যায়!
এর অনেক বছর পর ২০১৮ সালে ঘটল এক আশ্চর্য সমাপতন। নবতিপর কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী যেদিন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, সে দিনটি ছিল পঁচিশে ডিসেম্বর।
যিশুর জন্মদিন হল ‘কলকাতার যীশু’র স্রষ্টার মৃত্যুদিন।