Robbar

কলকাতার তলপেটে আলো ফেলেছে ‘রেডলাইট টু লাইমলাইট’

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 23, 2025 5:51 pm
  • Updated:December 23, 2025 6:30 pm  
Documentary review on Kalighat Redlight Area। Robbar

এই বছর ইন্টারন্যাশনাল ডকুমেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের অ্যাওয়ার্ডে দুটো বিভাগে নমিনেশন পেয়েছে কলকাতার বুকে বাংলাভাষায় তৈরি হওয়া ডকুমেন্টারি ফিল্ম, ‘রেডলাইট টু লাইমলাইট’– বেস্ট রাইটিং এবং বেস্ট সিনেমাটোগ্রাফি। ইউকে-র শেফিল্ড ডকফেস্ট, নেদারল্যান্ডসের ইন্টারন্যাশনাল ডকুমেন্টারি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অ্যামস্টারডাম, হাঙ্গেরির ভার্জিও ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, নেপালের হিউম্যান রাইটস ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সাড়া জাগিয়েছে এই ছবি। রোববার.ইন-এর তরফে সিনেমাটা দেখলেন উদয়ন ঘোষচৌধুরি

উদয়ন ঘোষচৌধুরি

উত্তুঙ্গ স্বাস্থ্যের, খোসা-ওঠা ওই যে যুবতী– ঠা ঠা দুপুরে ফাটা-কলপাড়ে উবু হয়ে বাটি মাজে; পাত্রপক্ষ হঠাৎ এসে পড়লে তাকে যেমন নিয়ে আসা হয় সস্তার ক্রিম ও পাউডার মাখিয়ে; আর, ছেলের বাবা চুল দেখে এবং ছেলে দেখে বুকের আন্দাজ– সাম্প্রতিক সিনেমায় কলকাতাকে দেখলে, আমার ঠিক অতটাই অশ্লীল লাগে!

জানি না, কোন অজ্ঞাত কারণে পশ্চিমবঙ্গের মান্যগণ্য সিনেমাকাররা ভুলে গিয়েছেন কলকাতা মানে নিউ টাউনের হাইরাইজ নয়; কলকাতা মানে বাইপাসের মসৃণতা নয়; কলকাতা মানে ময়দান, হাওড়া ব্রিজ আর হলুদ ট্যাক্সি নয়। বরং, কলকাতার তলপেটে ফল্গু হয়ে আছে অজস্র নাড়িভুঁড়ি, সুড়ঙ্গ, জং-ধরা রেললাইন এবং ওতপ্রোত আলোর ভূমিকা। সে-রকম একটা কলকাতায় হাত রেখেছে বিপুলজিত বসুর ডকুমেন্টারি, ‘রেডলাইট টু লাইমলাইট’।

‘কালীঘাট’ শব্দটা শুনলে অনেক হৃদয়েই ভক্তির সুনামি চলে আসে। চলন্ত বাসের জানলা দিয়ে অদেখা দেবীর প্রতি নিমীলিত চোখ, নতমাথা, জোড়-হাতের সংখ্যা গুনতে দরকার পড়ে না কোনও এসআইআর করার। অথচ, সেই কালীঘাটেরই কুঁচকিতে যেসব গলি, অলিগলি ও তস্যগলি– যেসব গলিতে মৃদু সাইকেল-ক্রিং নেই, যেসব গলিতে পাড়াতুতো ক্রিকেটের বিশ্বকাপ নেই, যেসব গলিতে মায়া নেই– সেখানের বাসিন্দাদের মুখোমুখি হলে এই ভক্তবৃন্দই স্যানিটাইজার ঘষে নেন দেবীত্বে! কারণ, তাঁরা পতিতা, তাঁরা বেশ্যা; তাঁদের কাছে যৌনতা কোনও উৎস-সুখ নয়; আমাদের নিপাট, সুশীল ও ইস্ত্রি-করা অগ্রগামী সমাজে তাঁদের উপস্থিতিটাই যেন এক ঘৃণ্য কলঙ্ক।

আমরা জানি না, কারণ জানার বা খোঁজ নেওয়ার মানসিকতাই আমরা লালন করি না– এইসব গলিতেও খিলখিল হাসে স্বপ্নের চারাগাছ। এই দুর্দিনেও এখানের কয়েকজন বাসিন্দা স্বপ্ন দেখেন, তাঁরা সিনেমা বানাবেন। টিমের নাম, ‘ক্যাম-অন’। লেখক-পরিচালক রবিনের কাছে স্টোরিবোর্ড নেই, আছে ‘স্টোরি-ট্রি’। তাঁর ঘুপচি ঘরের দেওয়ালে একটা গাছ আঁকা, সেই গাছের ডালে-পাতায় পরপর বসানো থাকে দৃশ্যের টুকরো বিবরণ। তাঁর বন্ধু রূপেশ ধরেন ক্যামেরা; আলো পৌঁছতে না-পারা ঘরে বসেই করে নেন পোক্ত এডিট। মীনা, আফসারা, বিলকিস– এঁরা রাজি হয়ে যান অভিনয় করতে। আর, প্রোডাকশনের ঝামেলাটাও সামলান সকলে মিলে। অবাক হয়ে ভাবছেন, প্রোডিউসার কে? ওঁরাই নিজেরা কিছু কিছু চাঁদা জমা করেন, ‘কাস্টোমার’ বাবুদের কাছ থেকে বাড়তি নেন ১০-২০ টাকা। সিনেমা তৈরি হওয়ার পর, থান কাপড় সেলাই করে পর্দা বানিয়ে, হাতে লেখা পোস্টার নিয়ে ঘুরে ঘুরে সকলকে আমন্ত্রণ করে, আদিগঙ্গার ধারে হইহই করে হয় ‘কমিউনিটি স্ক্রিনিং’।

তাঁদের এই যাত্রাপথের সঙ্গী হয় বিপুলজিতের ডকুমেন্টারি। রবিনের সিনেমা ‘নূপুর’ আর ‘রেডলাইট টু লাইমলাইট’ পাশাপাশি হাঁটে সহযোদ্ধার মতো, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। চিরাচরিত ডকুমেন্টারির ফরম্যাট ভেঙে, এই সিনেমায় তাই মিলেমিশে যায় রবিনের লেখা কাহিনি ও তাঁর সিনেমার দৃশ্য। পরিচালক হিসেবে বিপুলজিত কখনওই ‘ক্যাম-অন’-এর কাজকে বিব্রত করেন না। তাঁর কাজ যেন শুধুমাত্র একাগ্র-দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করা। কেবল একটা দৃশ্যে, ক্যামেরার পিছনে থেকেই, তিনি মীনাকে জিজ্ঞাসা করেন– ‘নূপুর’ সিনেমায় তাঁর চরিত্র যে প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়েছে, সেই একই প্রশ্ন বাস্তবে হাজির হলে কীভাবে সামলাবেন তিনি।

‘রেডলাইট টু লাইমলাইট’-এর পরিচালক বিপুলজিত বসু

‘রেডলাইট টু লাইমলাইট’ শুধুই তাঁদের সিনেমা বানানোর কাহিনি বলে না। বরং, তাঁদের রোজকার বাঁচা, হাহাকার, হতাশা, মানুষের তৈরি করা মানুষের জঙ্গলে প্রতিদিন লড়াইয়ের কথাও বলে। বলে তাঁদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, প্রেম, পরিজন, অপত্য-স্নেহের কথাও। কার্তিকপুজোয় ছেলের মঙ্গল কামনায় মা উপোস রাখেন সারাদিন। বয়সের গাছ-পাথর না থাকা ঠাকুমা নাতিকে যত্ন করে খাওয়ান নিজের ভাগের ভাত আর চারাপোনার তরকারি। সদ্য-প্রসব করা, কাঁচা-নাড়ি অবস্থায় প্রাক্তন স্বামীর যৌন-নির্যাতন মনে করে গুমরে কেঁদে-ওঠা যুবতীকে দু’হাতে বুকে টেনে নেন পড়শি যুবক। টলি-পাড়ায় অডিশন দিয়ে, ব্যর্থ হয়ে ফিরতি-পথে মনখারাপ করা মেয়েদের হাসি-হুল্লোড়ে ভুলিয়ে রাখেন সঙ্গীরা। লকডাউনের নির্জন রাস্তায় ‘খদ্দের’ না পাওয়া দুই নারী ভাগাভাগি করে নেন সস্তার সামান্য মদ; নেশাতুর হয়ে দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদেন।

‘রেডলাইট টু লাইমলাইট’-এর দৃশ্য

‘ক্যাম-অন’ টিমের ছেলেরা ছাড়া, গোটা সিনেমায় পুরুষের তেমন কোনও উপস্থিতি নেই। বা কয়েকজন থাকলেও, তাঁরা প্রায় নীরব দর্শক। সমস্যার সমাধানে সামনে এগিয়ে আসেন মহিলারাই; তাঁরা তীব্র, অদম্য, দৃপ্ত। এই সিনেমায় খুব সূক্ষ্ম লুকিয়ে আছে হিংস্রতা আর নিষ্ঠুরতা। কোথাও-ই স্পষ্টভাবে দেখানো হয়নি কী কী অত্যাচার প্রতি মুহূর্তে সইতে হয় ওঁদের। মাত্র একটা দৃশ্যে যখন দেখবেন, পর্বতের মতো চেহারার একজন পুরুষ কাঁচা-খিস্তি সহযোগে মারতে উদ্যত হয়েছে এক নারীকে, আর আপনি গুছিয়ে বসবেন এই ভেবে যে, ‘বাঃ! এবার একটা জম্পেশ ক্যালাকেলি হবে!’ তখনই দেখবেন, আশপাশ থেকে বয়স ও স্বাস্থ্য নির্বিশেষে, নারীরা একজোট হয়ে ওই পুরুষকেই দিয়ে দিল আড়ং ধোলাই। এবং ঠিক পর মুহূর্তেই রবিন যেই বলে উঠল, ‘কাটছি, এবার কাটছি!’– আপনি নিরাশ হয়ে টের পাবেন, ওটা ‘নূপুর’ সিনেমার শুটিং চলছিল!

‘রেডলাইট টু লাইমলাইট’-এর দৃশ্য

এই ডকুমেন্টারিতে নাটকীয়তা আছে, কিন্তু সেটা মোটেও অতিপ্রাকৃতিক নয়। বরং সেটা যেন দৈনন্দিন ঘেশকুটে জীবন থেকে উঠে আসা খুব ব্যক্তিগত, মানসিক বিষয়; যা আমরা চাপা দিয়ে রাখি, দেখতে বা দেখাতে চাই না। বেশ্যাপল্লির নারীদের জীবনে যা হওয়া স্বাভাবিক– তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই নিজের পরিবারের কাছে ব্রাত্য, অস্পৃশ্য। নিরুপায় হয়ে স্বেচ্ছায় বা চূড়ান্ত অনিচ্ছায়, বেঁচে থাকার জন্য তাঁরা বেছে নিয়েছেন এমন একটি পেশা, যা তাঁরা নিজেরাও জানেন, কখনও কণামাত্র সম্মান তাঁদের দেবে না। সুতরাং, কী-বা করতে পারেন তাঁরা? কিছুই কি পারেন? হ্যাঁ, এলাকার দাদাগিরি আর পুলিশের পেশির সামনে দলবদ্ধ হয়ে তাঁরা লড়াই করতে পারেন।

‘রেডলাইট টু লাইমলাইট’-এর দৃশ্য

এঁদের যাবতীয় দুর্দশা সত্ত্বেও, যেটা চমৎকার ফুটে ওঠে, সেটা হল শিল্পকলার শক্তি; সৃজনশীল কাজে মানবিক স্বাভাবিকতা। পর্দায় দেখতে পাই, রবিন নিজের কাজে কতখানি আন্তরিক, নইলে বাকিরা তাঁকে বিশ্বাস করবেন না। আমরা বুঝতে পারি, পর্দার পিছনে বিপুলজিত ও তাঁর টিম কী অসামান্য হৃদ্য। নইলে, এই ডকুমেন্টারি তৈরির কর্মকাণ্ডে তাঁরা অবিশ্বাস্যভাবে সঙ্গ দেবেন না। ‘রেডলাইট টু লাইমলাইট’ আমাদের দেখায়, রবিন, রূপেশ আর তাঁদের ফিল্মমেকিং টিমের সঙ্গে ওইসব মহিলার আচরণ ও কথাবার্তা কতটা আলাদা, যা অন্য যেকোনও পুরুষের সঙ্গে তাঁদের আচরণের সম্পূর্ণ বিপরীত। নামকরণের মতো এই সিনেমাও শেষমেশ আলোর কথাই বলে। ভাগ্যের ভরসা না করে, বলে চেষ্টা করার কথা। মীনা তাঁর ছেলেকে ভর্তি করেন স্কুলে। ঈশ্বরের মূর্তি সাজানোর কাজ নেন বিলকিস। তুমুল বৃষ্টিতে কালীঘাট ভেসে গেলে, সেদিনের মতো কারবার বন্ধ জেনেও, প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে ভেলা বানিয়ে আনন্দলহরিতে মাতেন সকলে।

‘রেডলাইট টু লাইমলাইট’-এর দৃশ্য

এই সিনেমার দুটো টেকনিক্যাল দিকের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা জরুরি। এক, সিনেমাটোগ্রাফি। দুই, এডিটিং। ক্যামেরা শুধুমাত্র চরিত্র ও ঘটনাবলি অনুসরণ করেছে, আলাদা করে কোনও স্টাইলাইজেশনের চেষ্টা করেনি। ফেটে-যাওয়া সিমেন্টের চিলতে গলিতে দু’হাতে জল-ভর্তি বালতি নিয়ে হেঁটে আসা তরুণীর পদক্ষেপে ধরা হয়েছে তাঁর দৃঢ় শ্রম; কোনও চেষ্টা করা হয়নি কাব্যিক ন্যাকামিতে ‘লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ’ তোলার। আর, শুভদীপ দে, মৃণ্ময় মণ্ডল ও রূপেশ চতুর্বেদী– এই তিনজন সিনেমাটোগ্রাফারের কাজ সুচারু গেঁথে সাজিয়ে তুলেছেন এডিটর, অনির্বাণ মাইতি; যা দেখলে মনেই হয় না ক্যামেরার পিছনে ছিলেন তিনজন আলাদা মানুষ।

‘নূপুর’-এর স্ক্রিনিং শেষ হয়। খুশিতে চোখ ভিজিয়ে দর্শকরা ফিরে যায় যে যার ঘরে। আদিগঙ্গার পাঁক আর পাশে টাঙানো সাদা পর্দার সামনে ঘুরে বেড়ায় দুয়েকটা কুকুর। এই শহরসমগ্রের ক্লেদাক্ত, মৃতপ্রায়, একদা-নদী ও আপাত-কলঙ্কিত নারীজীবন যেন একাকার হয়ে যায় ‘রেডলাইট টু লাইমলাইট’-এ এসে। আমার মনে পড়ে, হাজরা মোড়, শিয়ালদা বা বউবাজার এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় কতবার এড়িয়ে গিয়েছি এঁদের। হয়তো মীনা বা বিলকিস বা আফসারার মুখোমুখি হয়ে চকিতে আড়াল করেছি দৃষ্টি। এখন, এই ফাঁকা উৎসবের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলতে চাইছি, কত কালো মেখেছি দু’হাতে কতকাল ধরে, কত কাচ রেখেছি দু’চোখে কতকাল ধরে, কখনও তোমার করে তোমাকে ভাবিনি!

………………………..

রোববার.ইন-এ পড়ুন উদয়ন ঘোষচৌধুরি-র অন্যান্য লেখা

………………………..