
জ্যোতিদার কথা কাউকে জিজ্ঞেস করলেই উত্তর আসত: ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’। কিন্তু দুম করে একদিন খাস কলকাতার রাস্তায় দেখা হয়ে গেল। বললাম, ‘আপনি নাকি এখন আন্ডারগ্রাউন্ডে আছেন?’ জ্যোতিদা বললেন, ‘হ্যাঁ।’ আমি বলেছিলাম, ‘আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যাপারটা আমি বুঝি না, কী বস্তু?’ ‘যদি বুঝতে চাও, ভোর ৬টায় এসপ্লানেডে চলে এসো, এখান থেকে কেওনঝড়ের বাস ছাড়ে, তুমি আমার সঙ্গে আন্ডারগ্রাউন্ডে যাবে।’ গিয়েছিলাম এসপ্লানেডে। ভোরবেলাই। ৬টায় রওনা হয়ে কেওনঝড়ে পৌঁছেছিলাম বেলা ১২টা নাগাদ। কেওনঝড় থেকে খানিক রাস্তা পেরিয়ে বাংরিপোসি নামের এক জায়গায় একটুকরো টালির ঘরে ঢুকলাম। এখানেই ভাড়া নিয়ে থাকেন জ্যোতিদা। জ্যোতিদার পরিচয়– তিনি আর্টিস্ট।
১৯৭১ সাল। আমি তখন ব্যাঙ্কের কর্মচারী– ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ায়। সেসময় প্রথম আলাপ হয়েছিল জ্যোতির্ময় দত্তর সঙ্গে। আমাকে বলেছিলেন, ‘এই যে তোমরা ব্যাঙ্কের চাকরি করো, ভেতরে কী ঘটে আমরা জানতে পারি না। আমরা স্রেফ চেক জমা দিই, আর টাকা পাই। তুমি ভেতরের কাণ্ডকারখানা জানো। তুমি এই অভিজ্ঞতা এবং তোমার ছেলেবেলা থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত যে জীবন– তা মিলিয়ে মিশিয়ে একটা গদ্য লিখে আমাকে দাও।’

আমি তখন কবিতা লিখি। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ভাবনায় সাম্প্রতিক শব্দগুলি’ সদ্য বেরিয়েছে। কখনও গদ্য লিখিনি। কিন্তু জ্যোতির্ময় দত্ত বলেছেন, অতএব লিখতে হবে। ব্যাঙ্কের যে টিফিন আওয়ার্স– দুটো থেকে আড়াইটে– আমি সেসময় ক্যাশের কাউন্টারে দরজা বন্ধ করে রোজ একপাতা-দু’পাতা করে লিখতে থাকলাম। মনে আছে, লেখা শেষ করেছিলাম প্রায় ৪০ পাতায়! বাড়ি গিয়ে দিয়ে এসেছিলাম ‘কলকাতা’-র সম্পাদককে।

সদ্য একটা কবিতার বই বেরিয়েছিল আমার। অথচ তারপরই মস্ত একটা আত্মজীবনী বেরিয়ে গেল জ্যোতির্ময় দত্তর ‘কলকাতা’ পত্রিকায় (তৃতীয় বর্ষ। চতুর্থ-পঞ্চম যুগ্ম সংখ্যা। বৈশাখ, ১৩৭৯)! লেখার নাম: ‘একজন সাতচল্লিশের শিশুর কাহিনী’। বলা চলে, ‘কবি’ হওয়ার আগেই আত্মজীবনী প্রকাশিত হয়েছিল! জ্যোতিদা খুব চমৎকার একটা পরিচিতি লিখে দিয়েছিলেন আমার। সে বয়সে, সদ্য লিখতে এসে, মনে হয়েছিল তা আমার কাছে বিরাট পুরস্কার।

এই ঘটনার পরই, ওঁর সঙ্গে আমার সখ্য বাড়ে। ‘জরুরি অবস্থা’র সময় জ্যোতির্ময়দার কথা না-বললে, কিছুই বলা হয় না। বললেন, ‘‘কলকাতা’ পত্রিকায় একটা জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে সংখ্যা করছি, তুমি কিন্তু পাঁচটা কবিতা দেবে।’’ সেসময় ‘কলকাতা’ পত্রিকায় কবিতা লেখা, একজন তরুণ কবির কাছে স্বপ্ন! আমি পাঁচটা কবিতা লিখেও ফেলেছিলাম। কিন্তু জমা দেওয়ার আগের মুহূর্তে মনে হল, আমি একটা সরকারি চাকরি করি। জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে যে-পত্রিকা, সেখানে যদি লিখি, আমার চাকরিটা নিশ্চিতভাবেই চলে যাবে। শেষ মুহূর্তে সে-লেখাগুলো আর দিলাম না। সেই সংখ্যায় আর যাঁরা লিখেছিলেন– গৌরকিশোর ঘোষ, বরুণ সেনগুপ্ত গ্রেফতার হয়েছিলেন। সম্পাদক জ্যোতির্ময় দত্ত ও সহ-সম্পাদক শম্ভু রক্ষিত– দু’জনেই চলে গেলেন আন্ডারগ্রাউন্ডে। উৎপলকুমার বসুর বাড়িতে সরকারের তরফে জিজ্ঞাসাবাদ হয়েছিল, কারণ তিনি কবিতা লিখেছিলেন সে সংখ্যায়। এইসব যখন ঘটছে, তখন আরও বুঝতে পারছিলাম, চাকরিটা আমার যেতই!
এসবের পর অনেক দিন দেখা নেই। জ্যোতিদার কথা কাউকে জিজ্ঞেস করলেই উত্তর আসত: ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’। কিন্তু দুম করে একদিন খাস কলকাতার রাস্তায় দেখা হয়ে গেল। বললাম, ‘আপনি নাকি এখন আন্ডারগ্রাউন্ডে আছেন?’ জ্যোতিদা বললেন, ‘হ্যাঁ।’ আমি বলেছিলাম, ‘আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যাপারটা আমি বুঝি না, কী বস্তু?’ ‘যদি বুঝতে চাও, ভোর ৬টায় এসপ্লানেডে চলে এসো, এখান থেকে কেওনঝড়ের বাস ছাড়ে, তুমি আমার সঙ্গে আন্ডারগ্রাউন্ডে যাবে।’
গিয়েছিলাম এসপ্লানেডে। ভোরবেলাই। ৬টায় রওনা হয়ে কেওনঝড়ে পৌঁছেছিলাম বেলা ১২টা নাগাদ। কেওনঝড় থেকে খানিক রাস্তা পেরিয়ে বাংরিপোসি নামের এক জায়গায় একটুকরো টালির ঘরে ঢুকলাম। এখানেই ভাড়া নিয়ে থাকেন জ্যোতিদা। জ্যোতিদার পরিচয়– তিনি আর্টিস্ট। বড় বড় ক্যানভাসে অর্ধেক আঁকা বহু ছবি। মাঝে মাঝেই কিছু কাগজ ফেলতেন ডাকে। কাকে লিখছেন, কোথায় লিখছেন, স্পষ্ট করে বোঝা যেত না। খুব ঝুঁকি নিয়েছিলাম, কিন্তু জীবনে এক দুরন্ত অভিজ্ঞতা! এই বিষয় নিয়েই পরে উপন্যাস লিখেছিলাম– ‘আমাদের জরুরি দিনগুলি’। সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত সম্পাদিত ‘বিভাব’ পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় বেরিয়েছিল সেই উপন্যাস। পরে আমার ১০টি উপন্যাস যখন বের হয়, তার প্রথম উপন্যাসই এটি। উপন্যাসের ‘ব্রহ্মাদা’ নামের চরিত্রটি জ্যোতির্ময় দত্তকে মাথায় রেখেই।

ডব্লুউবিসিএস দিয়ে আমি চলে গিয়েছিলাম কাকদ্বীপে। সেখানে একদিন আবার দেখা জ্যোতিদার সঙ্গে। আমাকে বললেন, আমি একটা পরিকল্পনা করছি যে, নৌকা করে পাড়ি দেব আন্দামানে। কাকদ্বীপে মাঝিদের সঙ্গে কথাবার্তা বললেন। নৌকা তৈরির বন্দোবস্ত করলেন। ডিএম কোয়ার্টারের সামনে যে কালনাগিনী নদী, সেই নদীর পাড়েই তৈরি হচ্ছিল নৌকা। তখন জ্যোতিদা কখনও একা, কখনও সপরিবার আমার বাড়ি এসে থাকতেন। নৌকার তদারকি করতেন। আমার বাড়ির সামনে থেকেই রওনা রয়েছিলেন নৌকা করে। সঙ্গে এক যুবক-যবুতী। আমরা সি-অফ করেছিলাম। সম্ভবত ‘আজকাল’ পত্রিকায় তখন রোজ ছোট্ট করে একটা খবর বেরত এই অবিশ্বাস্য যাত্রা নিয়ে।
এসবের পর আবার অনেক দিন জ্যোতিদার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ নেই। চাকরির কারণেই নানা জায়গায় বদলি হতে হয়েছে আমাকে। ফলে ধারাবাহিক যোগাযোগ রক্ষা অসম্ভব! কিন্তু একদিন নন্দন চত্বরে হঠাৎ দেখা! জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, ‘একদিন চলে এসো আমার বাড়ি।’ গিয়েওছিলাম। সেই শেষ সাক্ষাৎ।
জ্যোতিদার এই বোহেমিয়ান জীবন, তাঁর খামখেয়ালিপনা, তাঁর রাজনীতি, কলকাতা পত্রিকা, নিজের লেখালিখি– সব মিলিয়ে যে মস্ত অভিজ্ঞতা টলটলে মানুষটা, সেরকম চরিত্র খুব বেশি বাংলাভাষায় আসেনি। মনে আছে, ‘বোম্বেটের গান’ নামে ওঁর একটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছিল। আমাকে উপহারও দিয়েছিলেন। সে বইয়ের কবিতার ভাষা, কবিতার চরিত্র ছিল একেবারেই অন্যরকম। কিন্তু যতটা স্বীকৃতি পাওয়ার কথা, তিনি পেয়েছেন কি? মনে হয় না। কলকাতা পত্রিকা, প্রকাশনা এবং ওঁর লেখালিখি নিয়ে বিশদে কাজ হওয়া দরকার।
জ্যোতিদার সঙ্গে আর দেখা হবে না। ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ কথাটার অর্থ, আজ এতদিন পর, জ্যোতিদা আরেকবার বুঝিয়ে গেলেন।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved