Robbar

একালের পৌষ‘মেল্লা’

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 30, 2025 9:06 pm
  • Updated:December 30, 2025 9:11 pm  

ট্রেনে টিকিট নেই। বাসে ছিল। ডানকুনি টোল প্লাজা পেরতেই সাদা ফিতের টুকরো বিছানো মাল্টি লেন কালো এক্সপ্রেসওয়ে ঢুকে পড়ল ছাই কুয়াশার আবছা দিগন্তে। শক্তিগড়ে খাবার বাথরুমের দোকানের পাশে সার্ভিস রোড রয়ে গেল নিচে। দশ মিনিটের মধ্যে ফের মেইন ট্র্যাকে। রেকর্ড সময়ের আগে বোলপুরে। নামতেই টোটো ডাক– ‘মেল্লা মেল্লা’। আর দশ মিনিট। এ বছর নাকি বাইশে শুরু। পঁচিশেই ভাগিয়ে দেবে না, থাকছে আরও দু’-এক দিন। কানাঘুষো শোনা গিয়েছে। করোনা কালে থমকে গিয়েছিল। এরপর বিশ্বভারতী বেঁকে বসায় মেলা বসিয়েছিল রাজ্যসরকারভারতী, ছোট করে। তারপর কিছুটা নিশ্চিন্তে। গত বছর থেকে অবাধে। জমিয়ে। এ বছর আরও।

শুভময় মিত্র

প্যাসেঞ্জার ভর্তি ভোরের ভলভো রওনা হয়ে গেল। সবাই পৌষমেলা। ট্রেনে টিকিট নেই। বাসে ছিল। ডানকুনি টোল প্লাজা পেরতেই সাদা ফিতের টুকরো বিছানো মাল্টি লেন কালো এক্সপ্রেসওয়ে ঢুকে পড়ল ছাই কুয়াশার আবছা দিগন্তে। শক্তিগড়ে খাবার বাথরুমের দোকানের পাশে সার্ভিস রোড রয়ে গেল নিচে। ১০ মিনিটের মধ্যে ফের মেইন ট্র্যাকে। রেকর্ড সময়ের আগে বোলপুরে। নামতেই টোটো ডাক– ‘মেল্লা মেল্লা’। আর ১০ মিনিট। এ বছর নাকি বাইশে শুরু। পঁচিশেই ভাগিয়ে দেবে না, থাকছে আরও দু’-এক দিন। কানাঘুষো শোনা গিয়েছে। করোনা কালে থমকে গিয়েছিল। এরপর বিশ্বভারতী বেঁকে বসায় মেলা বসিয়েছিল রাজ্যসরকারভারতী, ছোট করে। তারপর কিছুটা নিশ্চিন্তে। গত বছর থেকে অবাধে। জমিয়ে। এ বছর আরও। শুনলাম গানের আসরের বাঁধানো পাকা মঞ্চের মাপ আরও বড়  হয়েছে। ছৌ-নাচের জন্য একটু বেশি জায়গা পেলে ব্যাপারটা খোলতাই হয়। আজ বাইশ। ফাঁকা ফাঁকা কুয়াশা মোড়া মাঠ। প্লাস্টিক চাপা দেওয়া ছাউনির ফাঁকফোকর দিয়ে গরম ভাতের বাষ্প বেরিয়ে আসছে। কুয়াশা কেটে যাওয়ায় ট্রেডমার্ক শান্তিনিকেতনী ফিকে হলুদ রোদ উঠেছে। মাইক এখনও বক্তব্য রাখেনি। লোকজন উত্তেজনা ছড়াচ্ছেন। সবাই সবাইকে শাসাচ্ছেন, ‘এই তো কুয়াশা কাটল। চরম ঠান্ডা ছিল, চরম।’ শুরুর আগের এই চেহারাটা দেখছি অনেক বছর পরে।

পৌষের ভোর, ভুবনডাঙ্গার মাঠ

তেইশের ভোর হচ্ছিল না কিছুতেই। নিশ্চিতভাবে জানি আধো-অন্ধকারে শান্তিনিকেতনের ঘুম ভেঙে গিয়েছে। বৈতালিক শুরু হয়েছে গৌর প্রাঙ্গণে। এরপর ছাতিমতলায় উপাসনা হবে। এসব থেকে অনেক দূরে যেতে যেতে একলা পথে দেখতে পাচ্ছি ঘন কুয়াশায় হেড লাইট জ্বেলে ট্রাক আসছে সাবধানে। একটু পরে স্পষ্ট হচ্ছে মেলার গেটের ফ্রেমের মধ্যে ফেড আউট করে যাওয়া দোকানপাট। পর্দা তুলছে একে একে। সবার আগে রেডি হয়ে গিয়েছে ভাপা পিঠের সেমি মোবাইল দোকান। মনে পড়ে যাচ্ছে, জীবনানন্দের কলমে কিশোরীর চাল ধোয়া হাতের কথা। ভিজে চালের গুঁড়োকে অল্প সময় কাপড়ে মুড়ে স্টিম ভেপারের গল্প শুনিয়ে বের করে নিলেই ইডলির মতো চেহারা। মাঝখানে খুব ছোট বাচ্চাদের কপালে ধেবড়ানো টিপের মতো গুড়। ঘ্যানঘ্যান করলে আরও একটু। চরিতার্থ হল লোভ নম্বর এক। পূর্বদিকে, থানার সামনের গেটে প্রত্যেকবারের মতো চেনা চায়ের দোকানে বসলাম। পাঁচের ছোট চা এ বছরেও পাঁচ। দোকানের পিছনে উঁকি দিচ্ছে জায়ান্ট হুইল। এখনও অস্পষ্ট। তার গায়ে লিলিপুটরা চক্রের নাট বল্টু টাইট করছেন। দক্ষিণের লোক। সারা দেশে ঘুরে বেড়ান মহা খেলনার অজস্র খোলা টুকরো নিয়ে। মাঠে পৌঁছে পেতে ফেলেন সংসার। ক্লক ওয়ার্ক প্রিসিশনে বানিয়ে ফেলেন ডায়নামিক ইনস্টলেশন। একটু পরে টেস্ট রান হবে নিশ্চয়ই। পাশে দুরন্ত ঘূর্ণির আর এক উত্তেজক রাইড। শুধু ঘোরে না। হঠাৎ ওঠে। হঠাৎ নামে। পিলে চমকানোর হরেক প্রযুক্তি। আছে খোলা ছাদ এক ট্রেন। মাটির কিছুটা ওপরে তার ট্র্যাক। ড্রাগনে টানা ইঞ্জিন। এরপর হাওয়া ভরা কার্পেট, স্লিপ, জাল ঘেরা নেটের ওপর উদ্দাম লম্ফঝম্পর খেলা। নতুন দেখলাম ভূত দেখানোর তাঁবু। পাশে ডিজনি ডিজনি মারমেডের ছবি দেওয়া ঘর। জলকন্যাদের সঙ্গে জলকেলি করার ব্যাপার হতে পারে। এই সবকিছু মেলার পূর্বদিকের সীমানা বরাবর। প্রত্যেক রাইডের জন্য জাল লাগানো খুপরি টিকিটঘর। স্পষ্ট লেখা আছে, ‘ইউ পি আই নয় অনলি ক্যাশ’। এবারে খুঁজে পেলাম না। হারিয়ে গিয়েছে মহাগোলকের মধ্যে গাড়ি আর বাইকের জীবন মৃত্যুর উত্তেজনা ছড়ানো চক্রবৎ ঘুরে বেড়ানোর খেলা।

প্রস্তুতিপর্ব

পৌষমেলার সৃষ্টিলগ্ন থেকে ভুবনডাঙার মাঠের উত্তর কোণে শীতের হাওয়া আগলে দাঁড়িয়ে থাকে এক বিশাল ষাঁড়। তার আড়ালে গরু-কুকুররা। সেই পৌষমেলা আর নেই– একথা সত্যি হলে ওকেও বিশ্বাস করতে হবে। বহু বছর ধরে দেখছি। কিছুক্ষণ পর পর সে অল্প ঘুরে যায়। কালের কম্পাস। এই যেমন, বাউল কীর্তনের প্যান্ডেল থেকে কিঞ্চিৎ ঘুরে সে নির্দেশ করছে সারি সারি বাঁশের কারিগরদের আখড়া। বাঁশ কেটে, ছিলে, একটু পুড়িয়ে স্টেইন করে, হালে রং লাগিয়ে কত কী তৈরি হচ্ছে। এই যুগে রামরাজ্যের প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনায়, হয়তো, মেলার তীর-ধনুক হারিয়ে যায়নি। এর পরে সারি সারি দোকানের মাঝের জায়গায় বসেছে মেঠো লোকেরা। এক বান্ডিল রহস্যময় শুকনো গাছ-পাতা জলে ডুবিয়ে রাখলে তাতে এসে যায় ম্যাজিক সবুজ বসন্ত। বসেছে। সুদূর মধুবনী থেকে এসেছে ভাবলে ক্ষতি নেই, তার ছোট-বড় মোটা রঙের কল্পনায় আঁকা প্রাচীন ভারত, কৃষ্ণ-রাধা, পাখি-লতার ছবির কার্পেটে ছড়িয়ে পড়ছে পৌষালি রোদ্দুর। রুপোলি গয়নার কারিগররা নাকি আসত দুমকা থেকে। তারাও এসেছে। চলছে মালা গাঁথা। ঝুমকো দুল, সর্বাঙ্গের মোহিনী আভরণ। অতি উজ্জ্বল সাদা দেহাত গন্ধী গহনার প্রতি নিষ্পাপ আকর্ষণে ভিড় করছেন রঙিন পুরনারীরা। এঁরা ঠিক খুঁজে বের করবেন কোনগুলো আসলে হাতেগড়া। কট কট তেলের সলতে লাগানো টিনের নৌকো ঘুরছে আপন বৃত্তে। পেয়ে গেলাম সেই হাসিখুশি বুড়োটাকে। নিশ্চিতভাবে শান্তিনিকেতনী, হয়তো বিশ্বভারতীর এক ছাত্রীকে সে দিচ্ছে মালা। গলায় হার পরাতে পরাতে ভাঙা বাংলায় বলছে, ‘বড় সুন্দর, বড় সুন্দর লাগছে তুমাকে।’ অভ্যাসমতো খুঁজে না পেয়ে আর একবার নিশ্চিত হলাম যে হারিয়ে গিয়েছে ডোকরা। বিচিত্র ধাতুকে গলিয়ে ভীষণ ইম্পারফেক্ট কালো পোড়া শরীরের শিব, দুর্গা, বাদ্যযন্ত্রী, জঙ্গুলে নকশার জিনিসগুলো এবারেও আসেনি। বসেছে এম্পোরিয়ামের পালিশ করা চকচকে জিনিসগুলো। খেজুরের রস চোখে পড়ছে না। কিন্তু আখের রস বইছে এদিক-ওদিক। মাটির ভাঁড়ের চা, কাগজের গ্লাসে কফি। ফোন ফেলে আসায় ক’টা বাজে জানার উপায় নেই। দরকারও নেই। চব্বিশের সকালের নিয়ম অনুযায়ী শান্তিনিকেতন গৃহ ও আম্রকুঞ্জে সকালের অনুষ্ঠান হয়ে গিয়েছে নিশ্চয়ই। ওই পৌষ প্রাঙ্গণে শুধুই রবীন্দ্রনাথ। প্রায় একরঙা, কিছু গেরুয়া, সামান্য হলুদ ছোঁয়ানো পোশাকে বাছাই প্রাণের ভিড়। সানাই, ভাষ্য, গান। কিছু কৃষ্টি বিনিময়। কিঞ্চিৎ আক্ষেপ। ফোনবন্দি সকালের পরিস্থিতি। রামকিঙ্করের সুজাতা, গান্ধী, সাঁওতাল পরিবারকে ফেলে রেখে ধীর পায়ে আপন পল্লিতে প্রত্যাবর্তন।

আকাশ থেকে পৌষমেলা

ঘুরতে শুরু করেছে কল চক্র জায়ান্ট হুইল। ঘুরছে অন্যান্য কালের চাকারা। খুঁজে পেলাম দুই দোকানের মধ্যে প্রায় অদৃশ্য মাছের জালের দোকানকে। মুসলমান মালিক চিনলেন আমাকে। বললেন,’এবারে লাগবে না বুঝি? গতবারের জাল ভালো আছে নিশ্চয়ই।’ থোকা থোকা সস্তার আলিগড়ি গরম জামা, কম্বল, কান ঢাকা, টুপি। কাঁধের বাঁক থেকে ঝোলানো ‘দই চাই, দই।’ সাতসকালে অমল ছবি। লৌহযুগের স্মৃতি বিজড়িত কোদাল, শাবল, হাঁড়ি, কড়াই, মহা খুন্তি। কাস্তে, হামান দিস্তে। করাত ছুরি, গজাল পেরেক, শেকল। রান্নাঘরের, ক্ষেতের, গেরস্থালির হরেক মাল। কুনকে। লোভ নম্বর দুই। কিনে ফেলা গেলো। মাইক পাঠ করিয়ে চলেছে মেলা স্তোত্র। যেসকল দোকান এখনও তাদের ভাড়া দেন নি, তারা যেন অবিলম্বে নচেৎ লাইন কেটে দেওয়া হবে। যারা আগুন জ্বেলে রান্না করছেন তারা যেন অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র ইস্তেমাল করেন। মেলা প্রাঙ্গনে গাড়ি, টোটো, বাইক, ধূমপান, নেশাদ্রব্য, বচসা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। প্রশাসন যথেষ্ট তৎপর। সহায়তা কেন্দ্র, দমকল, পুলিশ, সিসিটিভি, ফার্স্ট এড পর্যাপ্ত। এবছরে নতুন, আইনি সহায়তা কেন্দ্র। গাড়ি ঘুরছে জলের ঝারি নিয়ে। ভিজিয়ে দিচ্ছে পায়ে চলার পরিসর। ফলে ‘সেই রাঙা ধুলো’ আর উড়ছে না। যথারীতি, জল শুকোনোর সময়টুকু দিতে নারাজ কিছু মানুষের আপত্তি ছোট ছোট কাদার পুডল ঘিরে। মেলার ভিড় বাড়ছে। রাস্তায় নয়। সব ধরণের গাড়ি, টোটোকে রুখে দেওয়া হয়েছে। অনেকখানি হেঁটে মেলার যে কোনো প্রবেশ পথের মুখে পৌঁছে ক্লান্ত মানুষরা বেজায় চটে উঠছেন। ওঁরা সম্ভবত এখনও জানেন না যে, রাগের আসল কারণ শুরু হবে ফেরার সময়। স্টেশন বা জামবুনি যেতে চাইলে মেলা সীমার অনেক বাইরে বোলপুরের আন্ডারবেলিতে, অলিতে-গলিতে অপেক্ষায় আছে গলা কাটা টোটোরা। অভিজ্ঞ ও সচ্ছল গত বছরের মেলার পরেই মেলা সংলগ্ন হোটেল, লজে ঘর বুক করে রেখেছিলেন। শেষ মুহূর্তে এসে পড়লে সিঁড়ির তলায় জনপ্রতি তিন হাজার চাইবে। এইসব ব্যাপারগুলো অপছন্দ হলে থাকতে হবে শান্তিনিকেতন নিবাসী ‘আরে এসো এসো’ বলা আত্মীয়, বন্ধুদের বাড়িতে। অর্থাৎ ফেসবুকে ঝগড়া না করে দীর্ঘসময় ধরে এনাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে হবে। শান্তিনিকেতনের আউটস্কার্টে দেদার রিসোর্ট, লজ হয়ে গেছে। সেখান থেকে ব্যবস্থা করে বা নিজের গাড়িতে এসে মেলার কাছে নির্দিষ্ট কয়েকটি জায়গায় দুশো টাকা দিয়ে পার্কিং করে, খেয়ে দেয়ে, কাঁথা স্টিচ দর করে, রসুনের আচার, ঝোলাব্যাগ কিনে ঘুরে ফিরে ব্যাক। ক্লান্ত প্রাণ জুড়োতে স্টকে রাখতে হবে রুশ-শীত মোকাবিলায় সিদ্ধহস্ত ভোদকা। কম বাজেটে জীবনানন্দের স্বাদ পেতে চাইলে পাবেন সরকারি অনুমোদন প্রাপ্ত জীবনের সমুদ্র সফেন বাংলা। স্থানীয় ব্র্যান্ড জে.ডি।

শান্তিনিকেতনের পৌষমেলায় কলকাতায় পঁচিশের ক্রিসমাসের দুর্ভাবনার লেশমাত্র নেই। সন্ধেবেলা পার্ক স্ট্রিটে আলোর মালার তলা দিয়ে, নিজেই নিজের মাথায় লাল টুপি পরিয়ে সান্তাপ্রসাদ ভেবে অন্যকে ঠেলে একপ্রস্থ আপ, একপ্রস্থ ডাউনের বিড়ম্বনা নেই। ঠিক ওই সময়েই রেস্তোরাঁতে টেবিল বুক করতে ব্যর্থ হয়ে গুড়লোভী পিঁপড়ের মতো লাইন দিয়ে অপেক্ষা করার ব্যাপার নেই। বরং এই বীরভূমে মিশে যাওয়া লাভজনক। সাইলেন্ট নাইট চাইলে পৌষমেলায় আলোর ঝলকানি, শব্দ সংগীতের দাপটের বাইরে মূল রবি-পাড়া অর্থাৎ ছাতিমতলা, আম্রকুঞ্জে শান্ত নিস্তব্ধ প্রদীপের সারি দেখতে চলে যাওয়ায় ভালো। একা লাগলে ব্যাক টু ভুবনডাঙা। সব কিছু, অনেক কিছুর হ্যাপেনিং এরিয়া। মেলার মধ্যে বিশ্বভারতীর জবরদস্ত উপস্থিতি। বিশ্বভারতী প্যাভিলিয়ন। এ বছর বিদেশে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে ছবির প্রদর্শনী। বইয়ের দোকান। এছাড়া বিশ্বভারতী কার পার্ক। বিশ্বভারতী টয়লেট। অন্য বারের তুলনায় বইয়ের দোকান বেশি। স্থানীয় শিল্পীদের করা ঘর সাজানোর আর্টিফ্যাক্ট ও চারু ফিকশন। দারুণ সেরামিকের কাজ। এই তো! আবার সেই দাম বেশি বলে রাগ? পৌষমেলায় একটা স্টলের কত ভাড়া জানেন? তারপর ট্রান্সপোর্ট, ইলেকট্রিক, হ্যানাত্যানা। শিল্পীরা লাভ না করলে কে করবে? সব কিছু কুক্ষিগত করে নেওয়া ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টরা? কত কমের জিনিস খুঁজছেন মশায়? আছে তো, হরেক মাল পাঁচ টাকা। দশ। কুড়ি। পঞ্চাশ। হতে পারে বিশ্বায়নের আগে তৈরি দু’টাকার চিরুনি আজ কুড়ি। হাতির দাঁতের হলে পাঁচ হাজার হত। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথ এখানে হস্তশিল্প মেলা তৈরি করতে চেয়েছিলেন বলে মনে হয় না। টেগোর মেন্ট বিজনেস।

শীতের রোদ মেখে গ্রামের লোক, শহরের লোক আসবে। মিলিবে। বেচিবে। ভুবডাঙার ধুলাগড়ে। সেই ট্র্যাডিশন অব্যাহত রয়েছে। বিশ্ব ভারতীর মূল অনুষ্ঠান বদলায়নি। মেলাতে যোগ হয়েছে নতুন অনেক কিছু। আজকের সঙ্গে মেলাতে গেলে বিপদ। শম্ভু সাহার পুরনো শান্তিনিকেতন নিয়ে ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ছবির বইয়ের প্রচ্ছদে যে গরুর গাড়ির কাঠের চাকার আদলে তৈরি গেট দেখা যাচ্ছে, সেই চাকা বহুদিন আগেই বিলুপ্ত। এখনও হারিয়ে যায়নি অনেক কিছু। মাটির হাঁড়িকুঁড়ি, কলসি বাটিরা আসবে ভাঙা মেলায়। ফিরি আজকের পৌষে। চালু মেলার মধ্য পশ্চিমে প্রবল জনোৎসাহ। সেখানে তেল ক্রিম পাউডার পারফিউম, প্যাকেজড প্রোডাক্টস, ইলেক্ট্রিকাল, প্লাস্টিকের দেদার সবকিছু, বাই ওয়ান, গেট মেনি। সেকালের পৌষমেলাতে এসব ছিল না। কারণ তৈরিই হত না। হলে শান্তিদেব ঘোষ একটা মোটরবাইক দর করতেন না, এখন সেটা জোর দিয়ে বলা যায় না। বাইক বলতে জর্জ বিশ্বাসের কথা মনে পড়ল। উনি আসতেন কি? যাঁরা স্থানীয়, এক কালে সেই সেলিব্রিটিদের নিশ্চয়ই দর্শন মিলত কালোর দোকানে। অমন আড্ডা আমিও দেখেছি। এখন সেই মাত্রার বিখ্যাত মানুষ কম পড়িয়াছে, তা হয়তো নয়। কথা হলো, ইউটিউবের কল্যাণে তাঁরা আর দুর্লভ নন। শক্তি-সুনীল-সন্দীপন মেলার মাঠে এসে পড়লে আজ ক’জন চিনতে পারত, জানি না। মুশকিলও আছে। ইদানীংকালে শিল্পব্যক্তিত্ব  ও রাজনীতি প্রায়ই খুব কাছাকাছি এসে পড়ায় পাবলিক মাইন্ডসেটের ওপর প্রভাব পড়েছে। শিল্পী আবার পলিটিক্স করবে ক্যানো? মেরুকরণের চাপ। এখন সবাই উইন্টার অথবা সামার। নো বসন্ত। অপছন্দের দলের লোক হলে কটু মন্তব্য শুনতে হতে পারে। হয়তো সেজন্যই সেলিব্রেশনের সব আয়োজন থাকা সত্ত্বেও সেলিব্রিটি নজরে পড়ছে না। বেশ নামী একজনের মুখে শুনেছি, ‘ছোটলোকের মতো ভিড়।’ কে যে ছোট, কে যে বড়, ক্যানো, ঝলমলে পৌষমেলাতে দাঁড়িয়ে সে নিয়ে ভাবতে ভালো লাগছিল না। মেলার উত্তর ঘেঁষে চাষবাস, ফল-ফুল, বীজ-মাটি-জল, চিনি না-মেশানো ভেজালহীন গুড় মধুর দোকান এবারেও। পাট শিল্পজাত জিনিসের বিরাট স্টল। বাচ্চা তার মায়ের হাত ধরে টানছে। প্রবল চেঁচাচ্ছে, ‘মামা জুট। মামা জুট।’

বাংলার প্রায় সব মেলার চেহারা চরিত্র একটু একটু করে এক হয়ে আসছে। পৌষমেলাতে তার একটি শকিং ব্যতিক্রম রয়েছে। এখানে বরাবরই মাংস নিষিদ্ধ। মাছের দেদার ভাজাভুজি, ডিম নিয়ে কোনও আপত্তি নেই। অথচ প্যান্ডেল বেঁধে বানানো বিশাল খাবারের দোকানগুলোর দেওয়ালে চিকেনের ছবির ছড়াছড়ি। সামনে সাজানো প্রচুর রংবেরঙের সবজি, সসের শিশি। একেবারে চোখের সামনে তৈরি হওয়া মোগলাই পরোটা, চাউমিন, চোখ নিশপিশ করা ফিসের সুগন্ধে ম-ম করছে চারপাশ। মাংসের ম খুঁজে পাওয়া যাবে না। রহস্য হল, ওই বিশাল ফ্লেক্স প্রিন্টেড বিজ্ঞাপনী দেওয়ালগুলো মেলা টু মেলা ট্রাভেল করে। কাজে লাগে দোকান মুড়তে। এখানেও লেগেছে। ম-কারান্ত কিছুই বিক্রি হয় না। নিষিদ্ধ খাদ্যের ছবি-সহ নাম লেখা অপরাধ নয়। স্মার্ট হিউমার। আবার ইউজুয়াল সাস্পেক্টরাও আছে। চাট, ফুচকা থাকবেই। ঘুগনি মুড়ি ব্যাপকভাবে। পৌষমেলার মিষ্টির লিস্ট লম্বা। ‘বেস্ট অফ বেঙ্গল’ হল নরমাল ভাপা পিঠে, দুধে ভেজানো ভাপা পিঠে, দুধপুলি, নরমাল পাটিসাপ্টা, ওই চকোলেট, ওই ম্যাংগো, ওই নারকেল, ওই দুধে ভেজানো প্লাস চুষি পিঠে, মালপোয়া, চোষির পায়েস। ভাজা মিষ্টির প্ল্যাটারে চিনি কাঠি, গুড় কাঠি, খাজা, খাস্তা গজা, নিকতি, জিলিপি, বাদাম বরফি। পাশাপাশি চপ, সেউ, নিমকি, ঝুরিভাজা। আছে সফিস্টিকেটেড দই স্পেশাল দোকান। লম্বা লাইন। এরা কিন্তু অনলাইন পেমেন্টে রাজি। এত কিছুর পরেও চিকেন নিয়ে চ্যাঁ ভ্যাঁ করা ক্যানো বাপু? এবারে আলাদা করে বলা হবে, লোভ নম্বর থ্রি-র কথা। মথুরা কেক। মোটেই কেক নয়। এক অত্যুৎকৃষ্ট দেশি ডোনাট। গরম ভেজে সঙ্গে সঙ্গে চিনির গুঁড়ো মাখিয়ে হাতে। মাত্র ১০ টাকা।

গ্রাম কবে উঠে গিয়েছে। আমরা, কিছু শহুরে সেলফ ডিফাইন্ড কালচার আর ইকোনমির স্ক্যানারে পাশ করিয়ে মেলার মধ্যে সস্তার অত্যুজ্জ্বল জামা পরা বিহ্বল অবস্থায় ঘুরে বেড়ানো পরিবার দেখলে বলি গ্রামের লোক। তারা ঝলমল করছে সোবার ম্যাট ফিনিশ বেইজ রঙের শাল বা জ্যাকেট পরা আমাদের মতো বহিরাগতদের পাশে। সন্ধে পেরিয়ে মেলা সদর্পে এগচ্ছে রাতের পথে। কেনাকাটা হোক বা না হোক, না খেয়ে উপায় নেই। তাই আগুন জ্বলছে যত্রতত্র জবরদস্ত দাপুটে কড়াইয়ের তলায়। মেলার স্পটলাইটের একটু বাইরে, সামান্য খোলা জমিতে আরও কিছু খুচরো আগুন। আধো অন্ধকারে। এবারে ঠান্ডা কি আরও বেশি? বাউল ফকিররা স্বঘোষিত লাইসেন্স নিয়ে মারছে টান গাঁজার কল্কেতে। শান্তিতে। হিংসার আগুন জ্বলতে দেখছি না কোথাও। পুলিশ সযত্নে অন্যত্র। কানে এল মণ্ডপ থেকে ভেসে আসা গানের কিছু কথা। বদলে গিয়েছে সেটাও। ঘুরে ঘুরে একতারার না স্ট্রিং না পার্কাশন ইনস্ট্রুমেন্টের তরল শব্দ প্রক্ষেপণের মধ্যে কানে ঢুকছে ‘বিশ্বকবি, বিশ্বগুরু, রবীগুরু।’ মাঝের শব্দের কারেন্ট দেশীয় মানেটা আপাতত অন্য। শিল্পীরা কি ইচ্ছে করে সেটা টপকে দিলেন আপাত নির্দোষ দু’টি শব্দের মধ্যে। দিলেও তা ডুবিয়ে দিলেন জোরালো মিঠে বাদ্যের ক্যাপসুলে। ঘূর্ণি নাচে।

বয়স ও আরও অনেক কিছু গুলিয়ে ফেলা একজন মানুষ কোথা থেকে যেন উদয় হয়ে আমাকে বললেন, ‘জানেন, আমি না, হারিয়ে গেছি। কোথায় উঠেছি বলতে পারেন? আমার চেনা টোটোকে ডেকে তাহলে এবার না হয় চলে যাব।’ টোটো আসবে কোনখানে? উনি তার ফোন নম্বরও জানেন না। হারানো প্রাপ্তির সহায়তা কেন্দ্রে না নিয়ে গিয়ে কথা বললাম একটু। দেখাই যাক না। একসময় বুঝলাম তাঁর বাড়ির লোকদের একজনকে আমি চিনি। ওঁর মেয়ে। তাঁকে আবার যিনি চেনেন, তাঁর কাছ থেকে নম্বর জোগাড় করে ফোন করে ডেকে আনায়, ‘বাবা কী যে করে, কোথায় চলে গেলো বুঝতেই পারিনি’ বলে খুব কৃতজ্ঞতা জানাতে লাগল। বিপদ কেটে যেতেই ভয়ানক রাগ হল। হতচ্ছাড়ি, আপনি ক্যানো এমন বাবাকে হাতছাড়া করলেন? স্মৃতির হার্ড ডিস্ক অ্যাকসেস করতে অপারগ ওঁকে নিয়ে এলেন ক্যানো? বললাম, ‘মেলা অমন হতেই পারে। দেখে নিন, মিলিয়ে নিন আপনার বাবাকে। পরে দোষারোপ করবেন না।’ সলজ্জ হাসি ও রিপিট থ্যাংক্সগিভিংয়ের পর আমি আমার মুক্ত হয়ে গেলাম। মনে হল, পৌষমেলায় আসা সার্থক। এদিকে অনেক আগেই ৬.৫০-এর শেষ বাস চলে গিয়েছে জাম্বুনি ছেড়ে। নিজের আস্তানায় কীভাবে ফিরব ভাবতে হবে। ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। পা টেনে টেনে কোনওমতে পৌঁছলাম যেখানে ভোরের কুয়াশায় দাঁড়িয়ে ছিল সেই কালজয়ী ষাঁড়। এখন নেই। একটু জমি পেয়ে বসে পড়লাম। এই রাতে এদিকে একসময় হত বাজির খেলা। বন্ধ হয়ে গিয়েছে। একটু দূরে মেলার দোকান মণ্ডপের সিল্যুট ও রোশনাই ছাপিয়ে দেখতে পাচ্ছিলাম জায়ান্ট হুইলকে। আলো জ্বলছে তার প্রত্যেক বাহুতে। থেমেছে একবার। দেখে এখন মনে হচ্ছে অনেক হাতের মালিক চেনা এক নটরাজ। নিশ্চিত এক দেবতা। মাথার ওপরের স্থির আলো যোগাযোগ রাখছে বহির্বিশ্বের সঙ্গে নিচের যাবতীয় শব্দ, হুল্লোড়, হারানো, প্রাপ্তি ও নিরুদ্দেশের ঊর্ধ্বে। তাঁর মাথার ওপর সিগনেচার টুকরো চাঁদ কখনও হারিয়ে যাচ্ছে রাত্রিকালীন কুয়াশার আগমনে। আমাদের চেনা কালপুরুষ অনেক ওপর থেকে দেখছেন নিজের সৃষ্টি করা মহাকুম্ভের আলো দিয়ে সেলাই করা বিস্তৃত এক নকশি কাঁথাকে।

………………..
ছবি: লেখক