বাংলাদেশ ওভাররেটে পিছিয়ে ছিল। এদিকে ম্যাথেউজের হেলমেট পরিবর্তন করতে সময় লাগছে। এমন সময় সাকিব আম্পায়ারদের কাছে ‘টাইমড আউট’-এর আবেদন করলেন এবং আম্পায়ার ইরাসমাস জানালেন ক্রিকেটের আইন অনুসারে ম্যাথিউজ আউট! আম্পায়াররা সাকিবকে আবেদন ফিরিয়ে নেবেন কি না, জিজ্ঞাসা করলেন। সাকিব ‘না’ বললেন। ম্যাথিউজ বাধ্য হয়েই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ‘প্রথম টাইমড আউট ব্যাটার’ হিসাবে প্যাভিলিয়নে ফিরলেন।
পুরুষদের বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০২৩-এর লিগের ম্যাচে দিল্লিতে বাংলাদেশ খেলছিল শ্রীলঙ্কার সঙ্গে। ২৫তম ওভারে বাংলাদেশের অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের বলে আউট হয়ে ফেরত গেলেন শ্রীলঙ্কার সমরবিক্রমা। স্কোর ৪ উইকেটে ১৩৫। পরবর্তী ব্যাটার অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউজ নামতে একটু বেশিই সময় নিলেন। দাঁড়িয়ে গার্ড নেওয়ার আগে হেলমেট পরতে গিয়ে তাঁর হেলমেটের স্ট্র্যাপটি ছিঁড়ে গেল। ম্যাথিউজ সাজঘরের দিকে ইশারা করলেন, নতুন হেলমেট আনতে। বোলার সাকিব, আম্পায়ারদ্বয় দক্ষিণ আফ্রিকার মারাইস ইরাসমাস ও ইংল্যান্ডের রিচার্ড ইলিংওয়র্থ তৈরি, ফিল্ডাররা তৈরি। বাংলাদেশ এমনিতেই ওভাররেটে পিছিয়ে আছে। কিন্তু হেলমেট পরিবর্তন করতে সময় লাগছে। এমন সময় সাকিব আম্পায়ারদের কাছে ‘টাইমড আউট’-এর আবেদন করলেন এবং আম্পায়ার ইরাসমাস জানালেন ক্রিকেটের আইন অনুসারে ম্যাথিউজ আউট। ম্যাথিউজ নাকি প্রায় প্রায় ২ মিনিট পার করে ক্রিজেই এসেছিলেন এবং তিনি আম্পায়ার বা বিপক্ষ অধিনায়কের অনুমতি না নিয়েই হেলমেট পরিবর্তন করতে সময় নিচ্ছিলেন।
ম্যাথিউজ প্রথমে বিষয়টিকে হালকাভাবেই নিয়েছিলেন। কিন্তু পরে বুঝলেন যে, আম্পায়ার ও সাকিব উভয়েই খুব সিরিয়াস। প্রথমে তর্ক করলেন। আম্পায়াররা সাকিবকে আবেদন ফিরিয়ে নেবেন কি না, জিজ্ঞাসা করলেন। সাকিব ‘না’ বললেন। ম্যাথিউজ বাধ্য হয়েই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ‘প্রথম টাইমড আউট ব্যাটার’ হিসাবে প্যাভিলিয়নে ফিরলেন।
পরে, সাংবাদিক সম্মেলনে নিজের বিরক্তি চেপে রাখেননি তিনি। সোশাল মিডিয়ায় ঝড়। প্রাক্তন ক্রিকেটার-সহ অনেকেই সাকিবকে অখেলোয়াড়োচিত মনোভাবের জন্য দুষছেন। সাকিব বললেন, ‘ভুল ঠিক জানি না, আমার তখন দেশকে জেতানোর জন্য যা মনে হয়েছে করেছি!’
আসলে এই খেলোয়াড়োচিত মনোভাবের ব্যাপারটা একটা ধূসর ক্ষেত্র। মানে যিনি ব্যাটার তিনি অপেশাদারি মনোভাব দেখিয়ে দেরি করে আসবেন, তারপর হেলমেট পরিবর্তন করবেন আম্পায়ার বা বিপক্ষ অধিনায়কের কাছ থেকে পূর্বানুমতি না নিয়ে– এইরূপ অপেশাদারিত্ব চলবে। কিন্তু বিপক্ষ অধিনায়ক তাতে অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে আইন মেনে আউট চেয়ে বসেন তাহলে সমস্যাটা কেন হয়?
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল জনি বেয়ারস্টোর কথা। জোরে বোলারের বল ব্যাটারের ব্যাট না ছুঁয়ে তাঁর গ্লাভসে গেলে এবং ব্যাটার যদি ক্রিজের বাইরে রয়েছেন, তাহলে তিনি নিজেই ব্যাটারকে স্টাম্পড আউট করার চেষ্টা করেন বল ছুড়ে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে অ্যাসেজে মিচেল স্টার্কের একটা বল ছেড়ে তারপর নিজেই পিচ ঠুকতে বেরিয়ে গেছেন কাউকে না বলে আর পিছন থেকে অস্ট্রেলীয় উইকেটরক্ষক অ্যালেক্স ক্যারি বল ছুড়ে উইকেট ভেঙে দিয়েছেন। ব্যাস, সঙ্গে সঙ্গে বিশুদ্ধবাদীদের ভদ্রলোকের খেলা মিথও গেছে ভেঙে।
তারপর একে একে ভিনু মাঙ্কড়, রবিচন্দ্রন অশ্বিন, কপিল দেবরাও চলে আসেন। বল করার সময় অন্যায়ভাবে সুযোগ নিতে নন স্ট্রাইকার ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে গেলে যদি বোলার রান আউট করে দেন তখন খেলোয়াড়োচিত মনোভাব নিয়ে বিতর্ক হয়। অথচ নন-স্ট্রাইকারের ভুল নিয়ে হয় না।
তাহলে? ক্রিকেট ভদ্রলোকের খেলা বা খেলোয়াড়োচিত মনোভাবের ব্যাপারগুলো কি পুরোপুরিই মনগড়া? মিথ? তাই কি হয়? ক্রিকেট, সে আন্তর্জাতিক হোক বা গলির মোড়ের, দিনের শেষে সেটা একটা খেলাই, যুদ্ধ নয়। মাঠে হাড্ডাহাড্ডি, ষাঁড়াষাঁড়ি লড়াই করেও দিনের শেষে কুশল বিনিময় হয়। সেটাই তো খেলা শেখায়। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার পাশেপাশেই মানবিকতা এবং উদারমনস্কতা হাত ধরাধরি করে হাঁটে।
আরও পড়ুন: অজস্র ট্রফি-সহ, জলসংকটের বার্সেলোনায় কয়েক ফোঁটা অশ্রু রেখে গিয়েছিলেন মেসি
আমরা তাই মনে রাখি, বব টেলরের ক্যাচ ঠিকমতো ধরা হয়নি অথচ আম্পায়ার আউট দিয়েছেন– এই অবস্থায় মুম্বইতে জুবিলী টেস্টে অধিনায়ক বিশ্বনাথ তাঁকে ফিরিয়ে আনছেন। মনে রাখি, নটিংহ্যামে বল বাউন্ডারিতে যায়নি অথচ ব্যাটার ইয়ান বেল মনে করেছিলেন চার, তাই উইকেট ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছেন আর ভারতীয়রা উইকেট ভেঙে দিয়েছেন। অথচ অধিনায়ক ধোনি বেলকে ফিরিয়ে আনলেন। মনে রাখি, গুয়াহাটিতে শনাকাকে ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য সামি বল করতে এসে রান আউট করলেও অধিনায়ক রোহিত শর্মা ফিরিয়ে আনছেন। মনে রাখি, আম্পায়ার আউট না দিলেও অ্যাডাম গিলক্রিস্ট নিজে জানেন আউট হয়েছেন তাই প্যাভিলিয়নের দিকে হাঁটা লাগিয়েছেন। মনে রাখি, লাহোরে হারলে ছিটকে যেতে পারে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এই অবস্থায় ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে গেলেও সেলিম জাফরকে রান আউট করলেন না কোর্টনি ওয়ালশ।
অন্যান্য খেলাতেও দেখি, হ্যামস্ট্রিং-এ টান পড়ে ডিফেন্ডার পড়ে গিয়ে ছটফট করছেন, অথচ সুবিধাজনক অবস্থায় থেকেও বিপক্ষের আক্রমণভাগের খেলোয়াড় গোল না করে শুশ্রূষায় এগিয়ে গেলেন। প্রতিদ্বন্দ্বী দূরপাল্লার দৌড়ে পায়ে চোট লেগে দৌড় শেষ করতে পারছেন না, অপর দৌড়বিদ এগিয়ে এসে পদকের তোয়াক্কা না করে প্রতিদ্বন্দ্বীকে কাঁধে নিয়ে ফিনিশ লাইন পার করিয়ে দিচ্ছেন। খেলোয়াড়, নিয়ম মেনে খেলা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, লড়াই, যুদ্ধ! সব কিছুর আগে তো আমরা মানুষই। তাই তো খেলার মাঠের থেকেই মানুষ শিক্ষা নেয়। অধিনায়করা খেলার মাঠের বাইরে গিয়ে দেশনেতার সম্মান পান, শ্রদ্ধার পাত্র।
আরও পড়ুন: যে দেবীর দু’হাত নেই, সে দেবী দু’পায়েই তিরন্দাজ
এই শ্রদ্ধা জিনিসটা তো এমনিতে আসে না। মাঠের মাঝে তাঁকে উদাহরণমূলক কিছু করতে দেখলে তবেই আসে। এই যে বিরাট কোহলির ব্যবহার নিয়ে এত সমস্যা হয় মানুষের, কিন্তু বার্মিংহামে যখন অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে বিশ্বকাপে স্টিভ স্মিথকে এক অংশের দর্শকরা ‘চিটার, চিটার’ বলে আওয়াজ দিচ্ছেন, তখন কোহলি নিজে তাঁদের স্মিথকে সম্মান দিতে বলেন। অথবা আইপিএলে আফগানী নবীন উল হকের সঙ্গে সমস্যা হলেও দিল্লিতে বিশ্বকাপের ম্যাচে দর্শকরা ট্রোল করলে নিজে নবীনকে আগলান বিরাট। ইডেন গার্ডেন্সে ১৬ আগস্ট যে রক্তদান দিবস আয়োজিত হয়, তার নাম ‘ফ্র্যাঙ্ক ওরেল দিবস’। ভারতীয় অধিনায়ক নরি কন্ট্রাক্টর চার্লি গ্রিফিতের বলে আহত হলে তাঁর অস্ত্রোপচারে রক্ত দিয়েছিলেন ফ্র্যাঙ্ক ওরেল। ওরেল ক্রিকেট খেলার এক সেরা স্টেটসম্যান, ক্রীড়াদূত।
সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে গেলে অধিনায়ককে অনেকসময় দেশ কাল সময়ের কথা মনে রেখে নিজের উত্তরণ ঘটাতে হয়। সেই উত্তরণ ঘটিয়ে যদি সাকিব ম্যাথিউজের গড়িমসি এবং স্পষ্ট ভুলের পরেও আউট চেয়েও ফিরিয়ে আনতেন তাহলে তাঁকেও সেই সম্মান দিত লোকে। সেটা হল না, আর সাকিবও তাই বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় হয়েও, মাশরাফি বিন মোর্তাজার মতো জনপ্রিয় ক্রীড়াদূত হয়ে উঠতে পারলেন না। অথচ মঞ্চ সেই উত্তরণের অপেক্ষায় ছিল।
যখন আমরা, তথা সকল ব্যতিক্রমী লিঙ্গ-যৌনমানস ঠিক করব কোন ধরনের স্বাধীন সিদ্ধান্ত আমরা নেব, কিংবা জড়বৎ বাঁচা থেকে নিজেদের বের করে নিয়ে এসে, অপরের সিদ্ধান্তকে নিজের বলে প্রচার করা বন্ধ করব, তখন-ই আমাদের এই জড়বৎ অস্তিত্ব, অপরের শর্তে তৈরি করা জগৎ থেকে মুক্ত পাব।