লজ থেকে বেরিয়ে কিছুক্ষণ নিরুপদ্রবে এগিয়ে গিয়েছি। লোকালয় পেরিয়ে এসেছি কখন বুঝতে পারিনি। অন্ধকার ঘিরে ধরেছে আমাদের, জঙ্গলের মধ্যে পাতায় পাতায় ঘষা খাওয়ার আওয়াজ। ঝিঁঝি পোকার আওয়াজ একটু একটু করে বাড়ছে। আমরাও কেমন জানি একটা ঘোরে হেঁটে চলেছি সামনে। হঠাৎ দেখি সামনে একটা অবয়ব। আরও স্পষ্ট হল খানিক পর। একটা স্কন্ধকাটা লোক আমাদের আগে আগে চলেছে। লিখছেন সুদীপ ঘোষাল
একবার আমরা সপরিবার পুত্রকন্যা-সহ দার্জিলিংয়ের তিনচুলে (৫০০০ফুট) গিয়েছিলাম। প্রচন্ড ঠান্ডা। একটা কমদামি লজে আশ্রয় নিলাম। তিনচুলে ও ছোটামাঙ্গোয়ার মধ্যবর্তী পথ বেশ বিপজ্জনক। ছোটামাঙ্গোয়ারা দৃশ্য মোহিত করে দেয় মন। একদিকে দার্জিলিং, কালিম্পং অন্যদিকে সিকিম। শালিক পাখি আর কমলালেবুর বাগান চোখে পড়ার মতো। সকালবেলার কুয়াশা কাটতেই বেলা বারোটা বেজে যায়।
আমি কোনও দিন ভগবানের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতাম না। সবাই আমাকে নাস্তিক বলেই জানত। এই তিনচুলে এসে সে বিশ্বাস আমার ভঙ্গ হয়েছিল। বলছি সে ঘটনা। একদম সত্য ঘটনা। বিশ্বাস নাও করতে পারেন।
আমি আর আমার এক বন্ধুর পরিবার এখানে লজে আছি। পোশাক আরও প্রয়োজন ছিল। ঠান্ডা যে এত বেড়ে যাবে, এই ধারণাটা ছিল না। এক রাতে আমি আর আমার বন্ধুটি বাইরে বেরব ঠিক করলাম। খাওয়া-দাওয়ার পর একটু হাঁটা ভাল, এই ভেবে। লজ থেকে বেরিয়ে কিছুক্ষণ নিরুপদ্রবে এগিয়ে গিয়েছি। লোকালয় পেরিয়ে এসেছি কখন বুঝতে পারিনি। অন্ধকার ঘিরে ধরেছে আমাদের, জঙ্গলের মধ্যে পাতায় পাতায় ঘষা খাওয়ার আওয়াজ। ঝিঁঝি পোকার আওয়াজ একটু একটু করে বাড়ছে। আমরাও কেমন জানি একটা ঘোরে হেঁটে চলেছি সামনে। হঠাৎ দেখি সামনে একটা অবয়ব। আরও স্পষ্ট হল খানিক পর। একটা স্কন্ধকাটা লোক আমাদের আগে আগে চলেছে। বন্ধুটি ভয়ে তোতলাতে শুরু করেছে। আমি বললাম, চুপ। ভয় পাস না। কেউ হয়তো আমাদের ভয় দেখাচ্ছে। আমি কথাটা বলামাত্র পুরো শরীরটা লোকটা পাহাড়ের উপর থেকে নিচে ভাসিয়ে দিল। লোকটা নিচে পড়ছে। প্রায় কয়েক হাজার ফুট নিচে। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম লোকটা লাফিয়ে পড়ল নির্দ্বিধায়। দেখে আমাদের পিলে চমকে উঠল।
বন্ধুটি বলল, চল লজে ফিরে যাই। আমিও বললাম, সেই ভালো। আর ঘোরার শখ নেই।
তারপর লজের দিকে পা বাড়ালাম। ও মা, হঠাৎ ধূমকেতুর মতো স্কন্ধকাটা লোকটা আবার আগে আগে চলতে লাগল। আমাদের অবস্থা ততক্ষণে বলার মতো নয়। হাত-পা নড়ছে না, গলা দিয়ে আওয়াজ বেরচ্ছে না। বন্ধুটি অজ্ঞান হয়ে গেল। আমি এবার চিৎকার করতে শুরু করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে লোক জড়ো হল। ভাবিনি আমাদের চিৎকার কারও কানে যাবে। আমাদের লজের যিনি গাইড, তিনিও খবর পেয়ে ছুটে এসেছেন। আমরা যতটা পারলাম, ঘটনাটার ব্যাখ্যা করলাম। সব শুনে তিনি বললেন, রাত এগারোটার পর আপনাদের বেরতে বারণ করেছিলাম। আমার কথা শুনলেন না।
মাথায় জল দিলে বন্ধুটি জ্ঞান ফিরে পেল। আমরা এক ঘরে বসলাম। সকলে আমাদের ঘটনা শুনে ভয় পেল। গাইড বললেন, ভয় পাবেন না। আজ পর্যন্ত কোনও লোকের ক্ষতি হয়নি। শুনুন এই ভূতের একটি মর্মান্তিক ঘটনা আছে।
একবার নব দম্পতি বেড়াতে এসেছিল। মধুচন্দ্রিমায়, বিয়ের পরে আনন্দ ভ্রমণে। আর তাদের সঙ্গে এসেছিল ছেলেটার একটা বন্ধু। বেশ চলছিল আনন্দের ফোয়ারা। কিন্তু বাদ সাধলো এক বিকেলের ঘটনা।
বর ছেলেটি, চা আনতে গেছে সামনের দোকানে। একটু দেরি হয়েছে। চল্লিশ মিনিটের মতো। তারপর ফিরে এসে স্ত্রীকে দেখতে পায় বন্ধুটির সঙ্গে অন্তরঙ্গ অবস্থায়। সেদিন জানতে পারে বন্ধুর সঙ্গে তার স্ত্রীয়ের বিয়ের আগের সম্পর্কের কথা। সব শুনে বর ছুটে গিয়ে স্ত্রীকে ঘর থেকে বের করে দেয়। তারপর দরজা বন্ধ করে বন্ধুর সঙ্গে অনেকক্ষণ বাকবিতণ্ডা করে। হাতাহাতিও চলে।
তারপর সেইদিন রাতে প্রেমিক বন্ধুটি তার প্রতিদ্বন্দ্বী বন্ধুটিকে চিরতরে সরিয়ে দিল।
আমি বললাম, কীভাবে?
গাইড বললেন, মাথা কেটে দিয়েছিল, তারপর বডিটা পাহাড় থেকে ছুড়ে ফেলে পালিয়ে গেছিল দু’জনেই। আজ পর্যন্ত পুলিশ তাদের খোঁজ পায়নি।
তারপর থেকে প্রতি রাতে এই লজে কেউ এলেই গলাকাটা এই ভূতটি দেখে নেয় কে এসেছে তার লজে। একবার এক নব দম্পতির সঙ্গে এক বন্ধু এসেছিল। বন্ধুটির দেহ পরের দিন পাওয়া গেল পাহাড়ের নিচে মৃত অবস্থায়।
তারপর থেকে লজের মালিক ঘরভাড়া দেয় পরিবার ও তার সন্তান থাকলে তবেই। আপনার বন্ধুটিকে দেখে হয়তো মারার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু আপনার বন্ধুর স্ত্রী ও কন্যা থাকায় রক্ষা পেলেন। পরিবার সঙ্গে থাকলে কোনও ক্ষতি হয় না। হয়নি আজ পর্যন্ত।
প্রচ্ছদ ছবি: অর্ঘ্য চৌধুরী