বাইকটা থেকে আন্দাজ ১০০ মিটার দূরে থাকা বাঁশবাগানটার দিক থেকে একটা লোক আমাদের দিকেই হেঁটে আসছে। চাদরমুড়ি দেওয়ায় মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেলাম না। কিন্তু সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে তারপর যেটা হল তার জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। বাইকের অভিমুখ ততক্ষণে ঘুরে গেছে, আর তাই অর্ক হয়তো খেয়ালও করেনি, কিন্তু আমি কী মনে হতে পিছন ফিরে তাকাতেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। লিখছেন উৎস ভট্টাচার্য
আমার বন্ধু অর্কজিৎ কৃষ্ণনগরের কাছেই থাকে। বহুবার যেতে বলেছে ওদের বাড়ি, কিন্তু ‘যাবো যাবো’ করেও শেষ পর্যন্ত আর যাওয়া হয়ে উঠছিল না। তা গতবার পুজোর ছুটিতে একদিন সকাল সকাল বেরিয়েই পড়লাম ওদের বাড়ির উদ্দেশে। অর্ককে বলাই ছিল। কৃষ্ণনগর স্টেশনে নামতেই দেখি– ব্যাটা ঠিক হাজির হয়েছে আমায় রিসিভ করতে। স্টেশন থেকে খুব একটা দূর নয় ওদের বাড়ি। অর্কর বাইকে মিনিট পাঁচ-সাতেকের মধ্যেই ওদের বাড়ি পৌঁছে গেলাম। কলেজের পর নিয়মিত ফোনালাপ থাকলেও, বহুদিন সরাসরি দেখাসাক্ষাৎ নেই আমাদের। অর্ক তো বটেই, কাকু-কাকিমাও খুব খুশি হলেন আমায় দেখে। সকলের সঙ্গে গল্প করতে করতে কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত সরভাজা এবং আরও কিছু মিষ্টি ও নোনতা খাবারের সমাবেশে জলযোগ সারলাম।
তারপর অর্কর ঘরে গিয়ে দুই বন্ধুতে মিলে কলেজের দিনগুলোর সব সুখস্মৃতি রোমন্থনে মশগুল হয়ে পড়লাম। একবার ফেলে আসা সময়ের সেইসব কথা আরম্ভ হলে, সময়ের আর কোনও হিসেব থাকে না– প্রায় সকলেই বোধ করি এই ব্যাপারে সহমত হবেন। নানা রকমের সব গল্প। তারপর এক সময় কথায় কথায় অশরীরীদের প্রসঙ্গও এসে পড়ল। অর্ক বলছিল, ওদের পাড়াতেই ক’টা বাড়ি পরে– এমন একটা বাড়ি আছে, যার ছাদে নাকি কখনও কখনও রাতের বেলায়, ওই বাড়িটায় বসবাসকারী পরিবারটির, এক পরলোকগত বয়স্ক সদস্যকে লাঠি হাতে পায়চারি করতে দেখা যায়। স্বাভাবিকভাবেই আমার তো বিশ্বাসই হল না। সশব্দে হেসে উঠে বললাম, ‘তুই নিজে কি কখনও দেখেছিস?’
অর্ক বলল, ‘না রে ভাই, আমি নিজে অবশ্য দেখিনি, কিন্তু, বিশ্বাস কর, এ পাড়ার অনেকেই নিশুতি রাতে সেই দাদুকে লাঠি নিয়ে পায়চারি করতে দেখেছে!’
আরও ১৪ ভূতের গল্প: রাতে শুধু মেসের ছাদে যাস না
সেই ভৌতিক গল্প চলতে চলতেই মধ্যাহ্নভোজের সময় হয়ে গেল। তারপর মাছ-মাংস সহযোগে এলাহি খাওয়া-দাওয়ার পর্বটি সুসম্পন্ন হতে, একটু গড়িয়ে নেওয়া গেল। বিকেলের দিকে ঠিক হল, অর্ক আর আমি একটু ঘুরে আসব। অর্ক অনির্দিষ্টভাবে মাঝেমাঝে নিজেও তার বাইকটা নিয়ে ঘুরতে বেরোয়। সে’দিন আমিও ওর সঙ্গী হলাম।
আগেই বলেছি, নির্দিষ্ট কিছু প্ল্যান-প্রোগ্রাম ছিল না। নিতান্ত খেয়ালের বশেই আমরা গোবরাপোতার দিকে বাইক ছুটিয়েছিলাম। কেবল চলার আনন্দেই এগিয়ে চলেছিলাম অনির্দিষ্ট সেই যাত্রাপথে। খেয়াল ছিল না কখন বেলা পড়ে এসেছে। দিনের আলো মরে এলে, বাইকের হেডলাইটটা জ্বালাতে হল। ওই পথে তখন লোকজন বিশেষ নেই, গাড়িঘোড়াও না। মসৃণভাবে বাইকটা এগিয়ে চলেছে রাস্তার বুক চিরে, এমন সময়ে একটা তিনমাথার মোড়ে, কোথাও কিছু নেই, হঠাৎ স্পষ্ট দেখতে পেলাম, একটা রিকশা-ভ্যান আড়াআড়ি মেন রোডটা পার হচ্ছে। ব্যাপারটা ঘটল স্বাভাবিকের থেকে ঢের আকস্মিকভাবে। অর্থাৎ হঠাৎ করেই যেন ভ্যানটা চলে এসেছে আমাদের সামনে– তার আগে আমরা সেটাকে দেখতেই পাইনি! মুখ দিয়ে একটা অস্ফুট শব্দ বের হয়ে এল আমার। অর্ক ততক্ষণে গতি কমানোর চেষ্টা করেছে, কিন্তু হেডলাইটটা হাই বিম করতেই চমকে উঠলাম আমরা। কোথায় ভ্যান? কিছু নেই তো! রাস্তা যেমন ফাঁকা ছিল, ঠিক তেমনটাই রয়েছে। তবে কি আমরা দু’জনেই এতটা ভুল দেখলাম?
আরও ১৪ ভূতের গল্প: একই জায়গা ক্রস করেছিলাম পাঁচবার
আমাদের বাইকটা এরপরও গোবরাপোতার দিকে এগিয়ে চলল ঠিকই, কিন্তু মনটা কেমন যেন খচখচ করতে লাগল। কিন্তু তখনও বুঝিনি সেদিন আমাদের জন্য আরও কিছু অপেক্ষা করছে! গোবরাপোতার কাছেই একটা ছোট্ট চায়ের দোকানের পাশ দিয়ে একটা সরু রাস্তা চলে গেছে। আমরা ঠিক করলাম ওই রাস্তাটা দিয়ে আর একটু যাব, তারপর ইউটার্ন নিয়ে ওই চায়ের দোকানটায় এসে চা-টা খেয়ে, ফেরার পথ ধরা যাবে। লক্ষ করলাম দোকানটায় বেঞ্চে বসা গুটিকয় লোক উৎসুকভাবে আমাদের দেখছে। আমরা তখনকার মতো কথা না বলে, পরিকল্পনা মতো এগতে লাগলাম। পথের দু’পাশে বড় বড় গাছ আর কী ভীষণ অন্ধকার! হেডলাইটের আলোতেও সামান্য কিছু দূর পর্যন্তই কেবল দেখা যায়। কিছু দূর এগোতেই আমরা দেখতে পেলাম একটা বাঁশবাগানে গিয়ে রাস্তাটা শেষ হয়ে গেছে। অগত্যা এবার ফেরার পথ ধরতে হবে আমাদের। অর্ক বাইকটা ঘুরিয়ে নিচ্ছিল, ঠিক সেই সময় একটা ব্যাপার লক্ষ করলাম। বাইকটা থেকে আন্দাজ ১০০ মিটার দূরে থাকা বাঁশবাগানটার দিক থেকে একটা লোক আমাদের দিকেই হেঁটে আসছে। চাদরমুড়ি দেওয়ায় মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেলাম না। কিন্তু সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে তারপর যেটা হল তার জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। বাইকের অভিমুখ ততক্ষণে ঘুরে গেছে, আর তাই অর্ক হয়তো খেয়ালও করেনি, কিন্তু আমি কী মনে হতে পিছন ফিরে তাকাতেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। সাদা চাদরে ঢাকা সেই অবয়বটা মুহূর্তের মধ্যেই ব্যবধান কমিয়ে ঠিক বাইকের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। আমার সারা গা ভারি হয়ে এল। ভীষণ একটা শীতলতার অনুভূতি রক্তে যেন দলা দলা বরফকুচি মিশিয়ে দিল। অর্কর বাইকটাও হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়েছে। ও স্টার্ট দিচ্ছে বাইকটা। কোনওমতে মনে জোর এনে অর্কর নাম ধরে চেঁচিয়ে উঠলাম। অর্কও পিছন ফিরে তাকাল। নাহ্! বাইকের ঠিক পিছনে তখন আর কিচ্ছু নেই। কিচ্ছু না! কেবল এলোমেলো হাওয়ায় বাঁশে বাঁশে ধাক্কা লেগে অদ্ভুত একটা শব্দ হচ্ছে। অর্ককে সংক্ষেপে জানালাম যা কিছু দেখেছি আর যা কিছু অনুভূতির পরিসরে ধরা পড়েছে।
আরও ১৪ ভূতের গল্প: মুখের জায়গায় একটা চেরা জিভ লকলক করছে
ফেরার পথে চায়ের দোকানটায় নেমেছিলাম। কেবল আমারই নয়, অর্করও বেশ শীত শীত করছিল। উষ্ণ পানীয়তে চুমুক দিয়ে একটু ধাতস্থ হলাম আমরা। চায়ের দোকানি কথায় কথায় জানতে চাইল,
‘তা বাবুরা! ওদিক পানে কী মনে করে গেছলেন?’
তারপর আমাদের ‘অকারণের কারণ’ শুনে তো বেজায় চটে গেল সে! তারপর জানাল, ওই বাঁশবাগানের বেশ বদনাম আছে। জায়গাটায় অনেকে নাকি গলায় দড়ি দিয়ে আত্মঘাতী হয়েছে। তাদের অতৃপ্ত প্রেতরা এখনও ইহলোকের মায়া কাটাতে না পেরে ওখানেই ঘোরাফেরা করে। সন্ধ্যার পর ওদিকে বড় একটা কেউ ঘেঁষে না। অন্যক্ষেত্রে গালগল্প বলে উড়িয়ে দিতে পারতাম, কিন্তু, নিজের ইন্দ্রিয়কে অবিশ্বাস করি কী উপায়ে? আমি যে তখন কিছু পূর্বেই অনুভব করেছি ওদের মৃত্যু-শীতল অশরীরী অস্তিত্ব।
দিনটা ছিল ভূত চতুর্দশী। বছর ঘুরেছে। স্মৃতি আজও তাড়া করে ফেরে।
প্রচ্ছদের ছবি: অর্ঘ্য চৌধুরী
আজ যখন আমরা মার্কস ও এঙ্গেলসের বন্ধুত্বকে নতুন চোখে দেখে কমিউনিস্ট ইতিহাস রচনার কথা ভাবি, তখন একই সঙ্গে কমিউনিস্ট আন্দোলনের নারীবাদী ইতিহাস খুঁজতে গেলে আমাদের মেয়েদের এই বিপ্লবী কমরেডশিপের সম্ভাবনার, নারীবাদী বন্ধুত্বের রাজনীতির দিকেও নজর দিতে হবে।