বারাণসীরাজ দশরথের অন্তঃপুরে ১৬,০০০ মহিষী। তার মধ্যে যিনি প্রধানা তাঁর দুই ছেলে, এক মেয়ে। বড় ছেলের নাম রামপণ্ডিত, ছোট ছেলে লক্ষ্মণকুমার, তাদের আদরের বোন সীতাদেবী। স্বভাবে, মেধায়, মননে তারা সবার প্রিয়। রাজপ্রাসাদের অবিমিশ্র আনন্দের সুর হঠাৎ ধাক্কা খেল প্রধানা মহিষীর অকাল প্রয়াণে। দশরথ শোকে একেবারে ভেঙে পড়লেন। রাজকার্যে আর মন নেই তাঁর।
রামায়ণ, মহাভারত আর জাতকের মধ্যে কে আগে, আর কে পরে, কে কার দ্বারা প্রভাবিত, তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে অনেক তর্ক-বিতর্ক। তবে মোটামুটিভাবে বলা যায়, মহাভারতের মূল বৃত্তান্ত, মানে কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধ, লিপিবদ্ধ হয়েছিল যিশুর জন্মের পাঁচ শতক বা আরও কিছু আগে; রামায়ণের মূল কাঠামো তৈরি তারও আগে; আর গৌতম বুদ্ধ খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের মানুষ। সুতরাং মহাকালের বিপুল বিস্তারের সাপেক্ষে বিচার করলে এই তিন আখ্যানমালা প্রায় সমসাময়িক, প্রায় একই সময়স্রোতে তারা পরিবর্তিত হতে হতে এগিয়েছে।
পারস্পরিক প্রভাবের কথা উঠলে গবেষকরা ‘দশরথ জাতক’-এর কথা তুলবেনই। এই গাথার শুরুতে রয়েছে ‘দস বস্স-সহস্সানি সট ঠি বস্স-সতানি…’; তার সঙ্গে বাল্মিকী রামায়ণের বালকাণ্ড, প্রথম সর্গের ৯৮ নম্বর শ্লোকের প্রায় হুবহু মিল, ‘দশবর্ষসহস্রাণি দশবর্ষ শতানি…’। অথচ আখ্যানে কত তফাত। জাতক গল্পে দশরথ বারাণসীর রাজা, রামচন্দ্রের নাম এখানে রামপণ্ডিত, সীতা তাঁর– না থাক, তালিকা বানিয়ে লাভ নেই। বরং জাতকের নিজস্বতা বুঝতে গল্পটিই বলি।
বারাণসীরাজ দশরথের অন্তঃপুরে ১৬,০০০ মহিষী। তার মধ্যে যিনি প্রধানা তাঁর দুই ছেলে, এক মেয়ে। বড় ছেলের নাম রামপণ্ডিত, ছোট ছেলে লক্ষ্মণকুমার, তাদের আদরের বোন সীতাদেবী। স্বভাবে, মেধায়, মননে তারা সবার প্রিয়।
রাজপ্রাসাদের অবিমিশ্র আনন্দের সুর হঠাৎ ধাক্কা খেল প্রধানা মহিষীর অকাল প্রয়াণে। দশরথ শোকে একেবারে ভেঙে পড়লেন। রাজকার্যে আর মন নেই তাঁর।
ঘনিষ্ঠ সভাসদরা তাঁকে বোঝাতে লাগলেন, রামপণ্ডিত এখনও নাবালক, রাজ্যের দায়িত্ব আরও বেশ কিছু বছর আপনাকেই নিতে হবে। দীর্ঘকাল এমন মুহ্যমান হয়ে থাকলে কী করে চলবে?
ঘনিষ্ঠতমরা বললেন, মহিষী কি কম পড়েছে?
শেষ পর্যন্ত অন্তঃপুরচারিণীদের মধ্য থেকেই একজনকে নতুন প্রধানা মহিষী করা হল। মহারাজ ক্রমশ স্বাভাবিক রাজকার্যে ফিরে এলেন। নতুন রানি পুরনোর অভাববোধ ভুলিয়ে দিলেন। তিনিও এক রাজপুত্রের জন্ম দিলেন। তার নাম রাখা হল ভরতকুমার।
ভরতের যখন সাত বছর বয়স, নতুন রানি বললেন, মহারাজ, আপনি আমার অভিলাষ পূরণ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
–অবশ্যই।
–তাহলে আমার পুত্রকে পরবর্তী রাজা হিসেবে ঘোষণা করুন।
ক্রুদ্ধ দশরথ তীব্র তিরস্কার করে রানিকে ফিরিয়ে দিলেন।
কিন্তু এক ভয়ানক আশঙ্কা তাঁর মনকে নিয়ত বিক্ষত করে চলে, উচ্চাকাঙ্ক্ষী নারী আমার রাম-লক্ষ্মণকে বিষ প্রয়োগ করবে না তো?
অস্থির দশরথ জ্যোতিষীকে দিয়ে নির্ণয় করালেন, তিনি আর ১২ বছর বাঁচবেন। রাম-লক্ষ্মণকে আড়ালে ডেকে তিনি বললেন, ‘এখানে তোমাদের সমূহ বিপদ, তোমরা দূরে আত্মগোপন কর, ১২ বছর পর আমার মৃত্যু ঘটলে ফিরে এসে রাজ্যের দায়িত্ব গ্রহণ করবে, অমাত্যদের সব বলা থাকবে।’
বোন সীতা বললেন, ‘আমিও যাব দাদাদের সঙ্গে, ওদের দেখাশোনা করব।’
গোটা রাজ্য চোখের জলে ভাই-বোনদের বিদায় জানাল। তাঁরা হিমবন্ত প্রদেশে গিয়ে এক আশ্রম স্থাপন করলেন।
ওদিকে শোকে, ক্ষোভে, উৎকণ্ঠায় দশরথের আয়ুক্ষয় হতে থাকল। ন’ বছরের মাথায় তিনি মারা গেলেন।
ভরতকুমারের মা দেখলেন, এই সুযোগ। দ্রুত তাঁর ছেলের রাজ্যাভিষেক সেরে ফেলতে চাইলেন। কিন্তু সেকালে মন্ত্রী-অমাত্যদের শিরদাঁড়া ছিল টানটান। তাঁরা রানির প্রতিবাদ করলেন– এই সিংহাসনের প্রকৃত উত্তরাধিকারীকে আমরা চাই!
বুদ্ধিমান ভরত পরিস্থিতি অনুধাবন করে নিজেই এগিয়ে এলেন। বললেন, ‘আমি দাদা-দিদিদের ফিরিয়ে আনব, রামপণ্ডিতকে রাজছত্র দিয়ে বরণ করে নেব। খড়্গ, ছত্র, উষ্ণীষ, পাদুকা, চামর– এই পাঁচ রাজচিহ্ন নিয়ে নিয়ে ভরত আগে আগে চললেন। সঙ্গে চতুরঙ্গ সেনাবাহিনী আর অমাত্যরা।
রামপণ্ডিত শুনে বললেন, ‘‘এখন থাক, বাবা বলেছিলেন বারো বছর পর। এখন সবে ন’ বছর।’’
–কিন্তু তিনি তো গত হয়েছেন।
–তথাপি তাঁর আদেশ অলঙ্ঘনীয়।
–তাহলে এই তিন বছর কীভাবে দেশ চলবে?
–ভরতকুমার চালাবে।
অনেক পীড়াপিড়িতেও রামপণ্ডিতকে টলাতে না পেরে আমাদের পরিচিত কাহিনির মতোই ভরত অগ্রজের পাদুকা সিংহাসনে বসিয়ে তিন বছর দেশ শাসন করলেন। সকলে মনে করত পাদুকাদ্বয়ই প্রকৃত শাসক। মীমাংসায় ভুল হলে দুই পাটি পাদুকায় ঠোকাঠুকি লাগত।
তিন বছর পর রামপণ্ডিত ভাই-বোন নিয়ে দেশে ফিরলেন। যথাযোগ্য মর্যাদায় অভিষেক হল তাঁর। এবং, কী আশ্চর্য, বোন সীতাদেবীকে করা হল প্রধানা মহিষী!
এখানে ভুরু কুঁচকে গেলেও কিছু করার নেই। ‘দশরথ জাতক’-এর শেষটি এমনই।
ঋণ: দশরথ জাতক