খটখটে রাঙা মাটির দেশে বন্যার ঘটনা উঠে আসে; ব্যাঙ্কের স্টেটমেন্ট, দফতরি শিট, সেখানে মিশে যাওয়া জলের অতীত, গুর্বো হতদরিদ্রের গবাদি পশু কেনার জন্য ঋণের বায়না, ঋণ না মেটানোর বা মেটাতে না পারার বিভিন্ন বয়ানে অবসরজীবনের লেখকের স্বঘোষিত খামখেয়াল স্মৃতিচর্চা কুয়াশায় ঘেরা তবু রাজনৈতিক আভাসও দিতে থাকে। সেসবের স্বাদ পেতে গেলে, ‘পুরুলিয়াবাস: ছিন্ন স্মৃতি’ সততই পুরুলিয়া এক্সপ্রেসের জানলার ধারের সিট।
অরণ্যের কি নিজস্ব কোনও গুণ, বৈশিষ্ট্য থাকে? এহেন ভূগোল-প্রশ্নে বিভিন্ন অরণ্যের ছবি ও তার গন্ধ ভেসে উঠতে পারে, কোনও বিজ্ঞান-যুক্তিগ্রাহ্য বইয়ের ভাষ্য থেকেও হয়তো মিলতে পারে বিভিন্ন অরণ্যের উল্লেখ-সহ তার গুণাবলি। কিন্তু, আমি বলছি, অরণ্যের কোনও নিজস্বতা থাকে না। অরণ্যের একক থাকতে পারে মাত্র। আর তা হল– গাছ। অরণ্যের ক্ষেত্রভূমে যে গাছ সবচেয়ে বেশি বেড়ে ওঠে, কেবল তা দিয়ে অরণ্যকে যাচাই করা যায় না, যেমন ‘শালজঙ্গল’ মানেই কেবল শাল নয়। সেই শালজঙ্গলের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে যে তেতো কষাটে ও ছটফটে তরুণ হাওয়া ভেসে এসে আমাদের শরীরে লাগে, প্রশ্বাসে ঢোকে, সেখানে জুড়ে থাকে শালের মর্মর পাতার বাদামি মৃত্যুগন্ধর সঙ্গে গাছের গা বেয়ে জেগে ওঠা লতানে গাছের পত্ররেণু, থাকে এমনকী, বনতুলসীর ঝোপের আভাস– যাদের সাকিন, ঘাপটি অবস্থান চেনে হয়তো কেবলমাত্র সেই হাওয়া বই আর কেউ নয়। ফলে, অরণ্য চিনতে গেলে গাছ খুঁজতে হয়। পরিখায় দাঁড়িয়ে থেকে তার গভীরতার আঁচ নিয়ে যা প্রাপ্ত হয়, তা কেবল আশঙ্কা। যে কোনও সুবিশাল, সুগভীর, বৃহৎ প্রাকৃত বাস্তবের মুখোমুখি হওয়ার মুহূর্তে আমাদের বুকের ভেতরে যেরকম কিছুক্ষণের জন্য ভ্যাকুয়াম তৈরি হয়, তা এক আশঙ্কা। মুগ্ধতা দিয়ে তার গায়ে সান্ত্বনার শাল জড়ানো যায় কখনওসখনও।
আরও পডুন: শেষবেলায় রচিত শিকড় যাতনা
তেমনই, যে কোনও অঞ্চলের, তা সে শহর হোক বা গ্রাম, মফস্সল হোক বা ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুর– সেখানের বৈশিষ্ট্য বহন করে তার জনপদ, মানুষে-মানুষের কথোপকথনের আঁশ, আশঙ্কা, আশ্বাস। মানুষেরই অবস্থানে, সেই অঞ্চলের ভূমিষ্ঠ রোদ অন্য অন্য রঙে দর্শন হয়ে ওঠে, সেখানের রাস্তাঘাটই বলে দেয় কতটুকু গাছপালা-মাটি নিয়ে ফ্ল্যাটের অ্যাটাচড বাথরুমের মতো অ্যাটাচড প্রান্তর ধরা হবে। আবার এ-ও সত্য, সেই জনবসতির কোঁচড়ে, অঙ্কে, শিয়রে প্রকৃতি জাগ্রত লোকদেবতা হয়ে নজরদারি চালায়, এমনকী খবরদারিও। এহেন মানুষ-প্রকৃতি রহস্যের অন্যতম স্পট যদি চাইতে হয়, তবে পুরুলিয়া জেলার অনন্যতা এই রহস্যকে গ্রাস করে নিয়ে অন্যতর এক রহস্যের জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। মুক্তবাজার অর্থনীতির আঁচ সেখানে কোথাও যেই না গনগনে অনুভব হবে, পরমুহূর্তে ঘাপ করে ধরবে এসে পুরাকালীন জীবনচর্যা, যাকে শহর দেখতে পাবে বড়জোর, বুঝতে পারবে না। ‘পুরুলিয়াবাস: ছিন্ন স্মৃতি’ গ্রন্থে অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ক ম্যানেজার মানব চক্রবর্তী যে স্মৃতিপটটি আয়নাতালি করে গিয়েছেন, তার সুতো ১৯৯১ সালের এপ্রিল মাসে সুচের রাহুমুখে প্রবেশ করছে। টালিগঞ্জের ‘ছেলে’, সবে মাত্র ৭ বছর হয়েছে বিয়ের, আদর হয়ে জেগে আছে ৬ বছরের পুত্রসন্তান। এমন এক সাংসারিক ঘনঘোর সময়ে কিনা ব্যাঙ্ক চাকরির বদলি হয়ে গেল কলকাতা, হাওড়া, মেদিনীপুর ছাড়িয়ে পুরুলিয়া জেলার তস্যগ্রাম আহাড়রা-য়। ঘনঘোর রাজনৈতিক সময়ে, দেশের প্রেক্ষাপটে, ব্যক্তিজীবনে এ এক ক্ষুদ্রতর সন্দর্ভ। মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রবেশ ঘটছে বা ঘটতে শুরু করে দিয়েছে কিংবা ঘটবে, সোভিয়েত রাশিয়ার পতন ঘটেছে– কিন্তু পুরুল্যে জেলার কাছে তা কি ঘটমান বর্তমান? বাস ধরার জন্য যেখানে জড়ো হচ্ছেন লেখক (তৎকালীন ব্যাঙ্ক ম্যানেজার) এবং আর বাকি সহকর্মী, ব্যাঙ্ককর্মীরা, তার উল্টোদিকের দেওয়ালে, আলকাতরা দিয়ে লেখা, দেখা যাচ্ছে: ‘শিক্ষায় মাতৃভাষাই মাতৃদুগ্ধ, তবে হামদের ভাষা-ট কি?’ তলায় ছোট অক্ষরে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা।
গ্রাম, ফলে, স্বভাবতই ঝাঁ চকচকে পিচ রাস্তা হবে না, পরিবহণ ব্যবস্থা হবে গোলমেলে-নিয়মহীন, তায় গত শতকের নয়ের দশকের যাত্রারম্ভ– এই বাস্তব মোটামুটি আঁচিয়েই তাঁর বদলি-জীবনের সাড়ে তিন বছরের অভিজ্ঞতাচক্রে ঢুকে পড়া যায়। আর মজা এখানেই যে, সেই অভিজ্ঞতার আবর্তে, ফিরে ফিরে আসে পুরুলিয়া অর্থে, সেখানকার মানুষ। সেই মানুষদের ঘিরে নদী, ঝোরা, ঝাড়, অরণ্য, আলোর রঙ্গমঞ্চ মেতে ওঠে অন্য রঙে, যাদের ক্যানভাস হয়ে জড়িয়ে রাখে লেখকের শিকড়ের টান, সংসারের টান। কীভাবে জীবন কাটত ও কীভাবে জীবন কাটছে– এই দুই বাখানের পাশাপাশি, পুরুলিয়ায় থাকাকালীনই রোজকার দিনযাপন ও রোজ রোজ একটু একটু বদলের ধ্বনি ও এক্কা-দোক্কায় পুরুলিয়ার অভিজীবন ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকে। গল্পের কাছে গিয়ে হাত ধরে বসে থাকে জীবন-আখ্যান।
আরও পড়ুন: মাটির কামড়ে এগিয়ে চলা রেখা
লেখকের সেই সময়ের উল্লেখের মধ্য দিয়ে বৃহত্তর এক সময়ের আঁচ পাওয়া যায়। খটখটে রাঙা মাটির দেশে বন্যার ঘটনা উঠে আসে; ব্যাঙ্কের স্টেটমেন্ট, দফতরি শিট, সেখানে মিশে যাওয়া জলের অতীত, গুর্বো হতদরিদ্রের গবাদি পশু কেনার জন্য ঋণের বায়না, ঋণ না মেটানোর বা মেটাতে না পারার বিভিন্ন বয়ানে অবসরজীবনের লেখকের স্বঘোষিত খামখেয়াল স্মৃতিচর্চা কুয়াশায় ঘেরা তবু রাজনৈতিক আভাসও দিতে থাকে। সেসবের স্বাদ পেতে গেলে, ‘পুরুলিয়াবাস: ছিন্ন স্মৃতি’ সততই পুরুলিয়া এক্সপ্রেসের জানলার ধারের সিট।
আরও পডুন: বেড়াতে গিয়ে পাইপয়সার হিসেব করে চলার পাবলিক আর যাই হোক, ‘বাঙাল’ নয়
স্মৃতির এই সরণিতে কিছু আক্ষেপও তৈরি হয়েছে বইকি। ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া লেখাগুলি যে সংকলিত হয়েছে, তা উল্লেখ আছে বটে, তবু পড়ার সময় কি সেই খেয়াল নিয়ে পাঠক পড়তে বসবে? এর ফলে, গদ্যর ক্রম কী নিরিখে বেছে নেওয়া হল, সে নিয়ে ধন্দ জাগে। একই কথা বারবার উঠে আসে, এবং পড়তে গিয়ে অনেক সময়ই মনে হয়, তা যতই প্রসঙ্গক্রমে হোক না কেন, ঘটনার চর্বিতচর্বণ হয়ে ওঠে, একবার উল্লেখের স্বাদ-গন্ধ-ম্যাজিক হারায়। লেখার মধ্যেকার সময়কাল বইপাঠের সময়কালের সঙ্গে পিছলে পিছলে যায়, কারণ লেখার ধরনে দিনলিপির আভাস হয়েও, সেখানে মনে পড়ার সময়কাল উল্লেখ থাকে না। সবচেয়ে অভিমান হয়, গ্রাম্যজীবনের তথাকথিত শিক্ষাহীন, অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষের জ্ঞানগম্যির উল্লেখ করতে গিয়ে ঈষৎ রসিকতার ঝোঁক দেখে। এই ঝোঁক ‘আমরা, ওরা’-প্রসূত যে বুঝতে যেমন অসুবিধা হয় না, তেমনই এই ঝোঁক সহচেতনার প্রশ্ন তুলতে বাধ্য করে। লেখার ক্রম সাজানো থেকে শুরু করে, লেখাকে বইয়ের পাতায় বসানোর আয়োজনে সম্পাদনার অভাব প্রকট হয়ে ওঠে। যতই হোক ফেসবুকীয় স্মৃতিকণ্ডূয়ন, তবু তাদের যখন বইয়ের আকার দেওয়া হচ্ছে, কিছু অতিরিক্ত যত্নের আশা করা কি অপরাধ হবে? পাঠক এই ধারবাকি গ্রহণ করে নিতে পারলে, বাকি সব, লেখকের উল্লেখ ধার করেই বলা যাক, ‘দি ফেক্ট ইজ ট্রু’, গুস্তাখি মুয়াফ!
পুরুলিয়াবাস ছিন্ন স্মৃতি
মানব চক্রবর্তী
ঋতাক্ষর ২৫০্