জাস্টিন ট্রিয়েট চমকানোর জন্য ছবি করেন না, চাবকানোর জন্য করেন
Published by: Robbar Digital
Posted on: December 8, 2023 5:14 pm
Updated: December 8, 2023 5:22 pm
এই ছবি তাবড় সব কোর্টরুম ড্রামার চেয়ে আলাদা– এ কথা লেখার কারণ, এই ছবি আস্তে আস্তে একটি সামাজিক আয়না হয়ে ওঠে। আমরা বুঝেও উঠতে পারি না কখন আমারা এক মহিলা, যিনি সফল, শিক্ষিত, মার্জিত, সুসভ্য; যিনি সুন্দরী এবং ব্যক্তিত্বময়ী, যিনি মা হয়েও স্বাধীনচেতা; যিনি সংসার থাকা সত্ত্বেও কাজকে প্রাধান্য দেন, যিনি কাঁদেন না, কাঁধ খোঁজেন না, শত অপমানেও ভেঙে পড়েন না, যিনি অর্থনৈতিক ভাবে স্বাধীন, তার বিরুদ্ধে কীভাবে জোট বাঁধে সবাই।
সোহিনী দাশগুপ্ত
কোর্টরুম ড্রামা আমার খুব প্রিয় জঁর। বানানো অত্যন্ত কঠিন, কিন্তু ঠিকভাবে বানাতে পারলে দারুণ টানটান। আরও একটি কারণ ভালো লাগার, কোর্টরুম ড্রামা-র একটি অবস্থান থেকে, থাকে প্রতিবাদ। থাকে এমন একটি লড়াই, যা চিরকালীন– the fight for justice, সুবিচারের লড়াই, সঠিকের লড়াই। এমন কোনও লড়াইয়ের গল্প এই জঁরে বলা হয়, যা রাজনৈতিক এবং সামাজিক, এমন বৈষম্য এবং অবিচার, যা সিস্টেমের মধ্যে বাসা বেঁধেছে। তাবড় সব কোর্টরুম ড্রামা হয়েছে সারা পৃথিবীর চলচ্চিত্র মানচিত্রে, তার মধ্যে হঠাৎ ২০২৩-এর কান চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ ছবির পুরস্কার, ‘‘পাম ডি’ওর’’ পাওয়া জাস্টিন ট্রিয়েটের এই ছবি ঘিরে আলোড়ন, আলোচনা, বিতর্ক কেন! শুরুতে সত্যিই বুঝতে পারছিলাম না ঠিক কেন, বুঝতে পারছিলাম না সত্যিই ঝুলিতে পাম ডি’ওর ভরার মতো ছবি কি এইটে! আস্তে আস্তে পরিচালক ছবিটা এমন জায়গায় নিয়ে গেলেন, যাতে এই ছবি অনবদ্য সব কোর্টরুম ড্রামার মধ্যেও আলাদা হয়ে ওঠে।
প্লটটি আপাত সাধারণ– অনায়াসে তাকে থ্রিলার বলে দাগিয়ে দেওয়া যায়। নামকরা জার্মান লেখিকা স্ত্রী, লেখক হতে চাওয়া ফ্রেঞ্চ স্বামী, তাদের এগারো বছরের ছেলে; চার বছর বয়সে এক দুর্ঘটনায় তার চোখ দু’টি প্রায় অন্ধ হয়ে গেছে, আর স্নুপ নামের একটি নীল চোখের বর্ডার কলি কুকুর। স্বামীর মৃতদেহ পাওয়া যায় বরফের ওপর, তিনতলার অ্যাটিক থেকে জমাট বরফের চাতালের ওপর পড়ে মাথা ফেটে মৃত্যু হয়েছে তার। স্ত্রী স্যান্ডরা (অভিনেতা স্যান্ডরা হিউলার) তখন বাড়িতেই, এক সাংবাদিক এবং লেখক হতে চাওয়া মেয়েকে সদ্য একটি ইন্টারভিউ দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন নিজের শোয়ার ঘরে। ছেলে ড্যানিয়েল আর স্নুপ বেরিয়েছিল হাঁটতে। ফিরে এসে সে দেখে বরফে শয়ান বাবার মৃতদেহ। টপ শটের ছড়াছড়ি আজকাল সব সিনেমায়, বিশেষত ড্রোন-এর আবির্ভাবের পর। এখন সেগুলো দেখে মনে হয়, একটুকরো বাড়তি গয়না যেন, নিষ্প্রয়োজন। ট্রিয়েটের টপ শটটি ছিল একটি উচ্চারণের মতো, তুলনারহিত। ঠিক শট ঠিক জায়গায় বসালে সে যে কত শক্তিশালী হতে পারে, সেই শিক্ষা। এদিকে, স্যামুয়েলের অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে জল ঘোলা হতে থাকে। অ্যাটিকের ওই ছোট তিনকোনা জানলা দিয়ে নিছক পড়ে যাওয়া সম্ভব না, অতএব হয় সে নিজে লাফিয়েছে, নয়তো তাকে ফেলে দেওয়া হয়েছে। নিজে লাফিয়ে থাকলে সুইসাইড নোট থাকা উচিত, যা পাওয়া যায়নি, আর নিজে না লাফালে যে একটিমাত্র মানুষের পক্ষে তাকে ঠেলে ফেলে দেওয়া সম্ভব, সে স্যামুয়েলের স্ত্রী, স্যান্ডরা। পুলিশ মনে করে স্যান্ডরা খুন করেছে তার স্বামীকে, প্রমাণ না থাকায় গ্রেপ্তার করতে পারে না তাকে, কিন্তু শুরু হয় কোর্ট কেস। স্যামুয়েল আর স্যান্ডরার এগারো বছরের ছেলে ড্যানিয়েল হয়ে যায় এই কেসের একমাত্র আই উইটনেস। আরেকজন আই উইটনেস আছে, সে স্নুপ; সাদাকালো সারমেয়টি– সারা ছবিতে যার উপস্থিতি একটি উষ্ণ চাদরের মতো, নীরব, মায়াময়। স্যান্ডরার পুরনো বন্ধু, এবং হয়তো পুরনো প্রেম বা প্রায়-প্রেম ভিনসেন্ট আসে স্যান্ডরার হয়ে কেস লড়তে। উল্টোদিকে এক জবরদস্ত উকিল, না ভুল বললাম, উল্টোদিকে এক জবরদস্ত উকিল এবং পুলিশ, না না আবার ভুল বললাম। উল্টোদিকে উকিল, পুলিশ, জুরি। না, আরও রয়েছে– স্যামুয়েলের সাইকায়াট্রিস্ট বা মনোবিজ্ঞানী, ফরেনসিক এক্সপার্ট, মিডিয়া, আপামর জনতা এবং এমনকী, জাজ, বিচারক। এর পরেও পুরোটা ঠিক হল না, উল্টোদিকে আছে দর্শক, অর্থাৎ আমরা।
প্রথমে লিখেছিলাম না, এই ছবি তাবড় সব কোর্টরুম ড্রামার চেয়ে আলাদা– একথা লেখার কারণ, এই ছবি আস্তে আস্তে একটি সামাজিক আয়না হয়ে ওঠে। বুঝেও উঠতে পারি না কখন আমরা এক মহিলা, যিনি সফল, শিক্ষিত, মার্জিত, সুসভ্য; যিনি সুন্দরী এবং ব্যক্তিত্বময়ী, যিনি মা হয়েও স্বাধীনচেতা; যিনি সংসার থাকা সত্ত্বেও কাজকে প্রাধান্য দেন, যিনি কাঁদেন না, কাঁধ খোঁজেন না, শত অপমানেও ভেঙে পড়েন না, যিনি অর্থনৈতিক ভাবে স্বাধীন, তার বিরুদ্ধে কীভাবে জোট বাঁধে সবাই। নারীবাদের এমন অনুচ্চার মারকাটারি উপস্থাপনা দেখতে দেখতে ভয় করে। প্রথম বিশ্বের অন্যতম প্রগতিশীল দেশ, নারী স্বাধীনতার কান্ডারি ফ্রান্স এবং স্যান্ডরার মতো নারীর প্রতি তাদের জাজমেন্ট এক বিস্ময়কর উন্মোচন। আমাদের অবচেতন এক অজানা অন্ধকার, সেখানে ক্রমাগত তৈরি হয় নানা রকম পক্ষপাত– আমরা হেসে উঠি যখন পর্দায় উকিল মজা করে, কটাক্ষ করে, আক্রমণ করে স্যান্ডরাকে। যখন হঠাৎ শুরু হয় তাঁর ব্যক্তিজীবন নিয়ে কাটাছেঁড়া, তার কিছু সম্পর্ক নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি। স্যান্ডরা আর স্যামুয়েলের স্তব্ধ করে দেওয়া ঝগড়ার দৃশ্যটি আমাদের ওই কোর্টরুমের অংশ করে তোলে, স্যান্ডরার উচিত শিক্ষা চাই আমরা মনে মনে– যুক্তিকে গুলি মেরে। আমরা হাসতাম না যদি স্যান্ডরা এত সফল বা স্মার্ট না হতেন, যদি স্যান্ডরা অত্যাচারিত, অবহেলিত, অবদমিত হতেন, যদি তিনি অর্থনৈতিক ভাবে স্বাধীন না হতেন, যদি স্যান্ডরা পুরো ছবিতে এমন আশ্চর্য পরিশীলিত পলিশ না ধরে রাখতেন। সেরকম স্যান্ডরা হলে, তাকে উকিলের এই আক্রমণে আমাদের রাগে গা-রি-রি করত, আমাদের মন জ্যাবজ্যাব করত করুণা রসে। আর এক্ষেত্রে দেখলাম বেশিরভাগ দর্শক মজা পাচ্ছে স্যান্ডরার অপমানে, কোর্টরুমের মতোই হল-এও তাকে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে স্বামীর হত্যাকারী হিসেবে। ‘নারীবাদ’-এর এই ক্রিটিক এবং ‘মিসোজিনি’-র এই তুখড় প্রেজেন্টেশনের জন্য জাস্টিন ত্রিয়েটকে আমার স্যালুট! তার এই ছবি একটি বিরাশি শিক্কার থাপ্পড় আমাদের ভিতরে গেঁড়ে বসে থাকা অবচেতন পক্ষপাতের মুখে, যা স্থান-কাল-পাত্রের সীমার বাইরে।
আস্তে আস্তে যখন ছোট্ট ড্যানিয়েনও ভুল বুঝতে শুরু করে মাকে, তখন অবাক হয়ে যাই আপাত দর্শকের নীরব সমর্থনে। কিন্তু না, জাস্টিন ট্রিয়েটকে আবার কুর্নিশ– সমাজ, প্রচলন, বহুত্ববাদ এখনও পক্ষপাত তৈরি করে উঠতে পারেনি এগারো বছরের ছেলেটির মনের গভীরে। ড্যানিয়েলের শেষ সাক্ষ্য আবার আমাদেরও হাত ধরে নিয়ে যায় নিষ্কলুষ, পক্ষপাতহীন সমাপতনের কাছে। ছবি শেষ হয়ে আসছে যখন একটু ভয় করছিল, টিপিক্যাল ওটিটি-মার্কা ক্লিশে ফরম্যাট অনুযায়ী শেষ দৃশ্যে ফট করে ফ্ল্যাশ কাট আসবে না তো– স্যান্ডরা ঠেলে ফেলে দিচ্ছে স্যামুয়েলকে– কাহানি মে টুইস্ট! না, তেমনটা হয়নি। আশ্চর্য এক শেষ দৃশ্য এই ছবির– অবশেষে স্যান্ডরা এসে বিছানায় এলিয়ে দিয়েছে ক্লান্ত দেহভার, অসম্ভব একাকিত্বের একটি ছবি। ক্যামেরা ধরা থাকে স্যান্ডরার ওপর এবং কাহানি মে টুইস্টও হয়। আস্তে করে স্নুপ এসে শুয়ে পড়ে স্যান্ডরার পাশটিতে, নীরব এই উইটনেস। স্যান্ডরা জড়িয়ে ধরে স্নুপকে বিশ্বাসের মতো, ভরসার মতো, পরম আশ্রয়ের মতো। নিভৃত দেবতার মতো। নিজের বোকামিতে নিজেই মুচকি হাসলাম, এই মেয়েটি (জাস্টিন ট্রিয়েট) চমকানোর জন্য ছবি করেন না, চাবকানোর জন্য করেন।
রবীন্দ্রনাথ অসুস্থ অবস্থায় তাঁর বক্তৃতার সংখ্যা কমিয়ে দিয়ে ছবি বিক্রির টাকা বিশ্বভারতীর স্বার্থে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন– কিন্তু প্রতিবন্ধক ছিল সেই পর্বের বিশ্ববাজারের মন্দা।