মানছি, ইডেন ও তার দর্শক সময়-সময় চিরবিতর্কিত। অনেক সময়ই সে ঘরের টিম ছেড়ে বাইরের দল, বাইরের প্লেয়ারকে সমর্থন করা শুরু করে। কিন্তু করে কেন? করে, ইডেন ভালো ক্রিকেটের সাধক ব’লে। আর তার সমর্থন? ক্রিকেট বোধ? লিখে দিতে পারি, বিশ্বকাপ ফাইনালে ট্রাভিস হেডের তাণ্ডবের সময় আমেদাবাদ দর্শকের মতো স্থানুবৎ বসে থাকত না ইডেন, ‘মৃত’র মতো আচরণ করত না।
অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশের পুঁথিগত পার্থক্য যতই থাকুক, বিলেতের লর্ডস, অস্ট্রেলিয়ার এমসিজি এবং কলকাতার ইডেন সাযুজ্যে সহোদর বটে! জাতি ও ভাষাগত বিরোধ সত্ত্বেও এরা ঠিক যেন দিনশেষে এক মায়ের তিন সন্তান। দূরের হয়েও যারা কাছের, পর হয়েও একান্ত আপন, বাকি পৃথিবীর আর পাঁচটা মাঠ-ময়দানের চেয়ে যারা আলাদা, অনেকটা আলাদা।
জাতে। চেতনায়। বোধে।
আসলে খেলোয়াড়ের মতো খেলার মাঠেরও জাত হয়। কে ভুঁইফোড় আর কে বনেদি– বুঝতে সময়ও লাগে না। চোখ থাকলে দেখা যায়, অনুভূতি থাকলে বোঝা যায়। খেলার মাঠের আভিজাত্য দুটো বিষয়ের ওপর চিরাচরিত নির্ভরশীল। প্রথমত, মাঠের ইতিহাস। তার গর্ভের রত্নকোষে রক্ষিত খেলার খনিজ-সম্পদ। মাঠের কৌলিন্য-মান যা নির্ধারণ করে। দ্বিতীয়ত, সে মাঠের দর্শক। তাদের জাত। তাদের চেতনা। তাদের ক্রীড়া-শিক্ষা। এক্ষেত্রে বিচার্য হল, দেশপ্রেমের ঊর্ধ্বে উঠে ভালোবাসার দর্পণে খেলাকে তারা দেখে কি না? শুধুই খেলার টানে খেলার মাঠে তারা পাগলপারা ছুটে আসে কি না? সর্বোপরি, খেলাকে যথাযোগ্য সম্মান তারা করতে জানে কি না?
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও খেলাইডোস্কোপ: ২০২৩-এর আগে আর কোনও ক্রিকেট বিশ্বকাপ এমন ‘রাজনৈতিক’ ছিল না
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
মনে তো হয় না, খণ্ড ও অখণ্ড দুই ভারতবর্ষ জুড়েও সে ব্যাপারে ইডেনের সমতুল্য কোনও মাঠ আর পাওয়া যাবে বলে। ওয়াংখেড়ে থাকবে। চিপক থাকবে। খুব কাছাকাছিই থাকবে। পশ্চিম ও দাক্ষিণাত্যের এ দুই মাঠের ঐতিহাসিক গরিমা বড় কম নয়। কম নয় দুইয়ের ক্রিকেট-সমঝদার সমর্থক সংখ্যা। চিপকেই বিশ্বকাপের সময় ‘সিডিই’ ব্লকের গল্প শুনে এসেছি তামিলনাড়ু ক্রিকেট কর্তাদের কাছে। যা বিমোহিত করে দেওয়ার মতো! ‘সিডিই’ ব্লকের টিকিট আজও অনলাইনে ছাড়া হয় না! এই এআইয়ের যুগে দাঁড়িয়েও না। সেখানে এখনও বাবরের আমলের মতো আগের রাত্তির থেকে লাইন পড়ে। টিকিটের দাম রাখা হয় নামমাত্র। কারণ, সে ব্লকে খেলা দেখতে আসেন যাঁরা, অর্থ নেই তাঁদের। আছে শুধু খেলাটার প্রতি এক আকাশ ভালবাসা আর অফুরান জ্ঞান। চিপকে কেউ সেঞ্চুরি করলে অলিখিত নিয়ম হল, ‘সিডিই’ ব্লকের দিকে সর্বপ্রথম ব্যাট তুলবে। তাদের সম্মানজ্ঞাপন করবে। কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্তের যুগ থেকে যে ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে! তামিলনাড়ু ক্রিকেট সংস্থা দেখলাম, মহেন্দ্র সিং ধোনির ম্যুরাল দিয়ে সযত্নে রাঙিয়ে দিয়েছে সে ব্লক। প্রতিসম্মানে। কী করা যাবে, চিপক গ্যালারির সে প্রদেশে ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’ নয়, আজও একটাই মুদ্রা চলে– সাবজেক্ট নলেজ!
কিন্তু বিশ্বকাপের ওয়াংখেড়ে বা বিশ্বকাপের চিপক শেষে ইডেন হতে পারল কোথায়?
পারেনি। খুব কাছাকাছি এসেও ফোটোফিনিশে হেরে গিয়েছে। না, ভারত ম্যাচ দিয়ে বিচার করে লাভই নেই। মাঠ কেন, বিরাট কোহলি-রোহিত শর্মারা যদি গত বিশ্বকাপে পুকুরেও ব্যাট-বল নিয়ে নামতেন, পাঁচ মাইল লম্বা লাইন পড়ত। একে দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ। তার ওপর দেশের দুই যুগন্ধর ক্রিকেট প্রতিভার সম্ভবত শেষ ওয়ান ডে বিশ্বকাপ। গ্যালারি ছাড়ুন, স্টেডিয়ামের আশপাশের ছাদ-গাছের টিকিটও অধিক কাঞ্চনমূল্যে কিনতে রাজি ছিল লোকে। আসলে গত বিশ্বকাপ একটা ক্রুর সত্যকে প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছে। তা হল, অধুনা ক্রিকেট বিশ্বে একমাত্র ভারতই পণ্য, বাকিরা বিপন্ন! মাঠে ভারত নামলে, ভারত খেললে, লোকে কাজকর্ম ফেলে ছুটে আসবে। নইলে স্বচ্ছন্দে চুলোয় যেতে পারে ওয়ান ডে ক্রিকেট। আইসিসি সব দেখেও দেখেনি। আমলই দেয়নি। যা চলছে, চলতে দিয়েছে। আইসিসি কোষাগারে সবচেয়ে বেশি অর্থের জোগান দেয় ভারত। খামোখা কে আর প্রতিদ্বন্দ্বী খাড়া করে ‘গৌরী সেন’-কে চটাতে চায়?
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও খেলাইডোস্কোপ: রোহিত শর্মার শৈশবের বাস্তুভিটে এখনও স্বপ্ন দেখা কমায়নি
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
পরীক্ষা তাই ছিল ‘নন ইন্ডিয়া’ ম্যাচ। সে সমস্ত খেলা, যেখানে ভারত খেলছে না। কারণ সেটাই ছিল প্রকৃত ক্রিকেট প্রেম প্রদর্শনের প্রকৃত মঞ্চ।
যত দূর মনে করতে পারি, ইডেনে ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা বাদ দিলে (ধর্তব্যেই রাখছি না, কারণ ফুল হাউস ছিল) বাকি ম্যাচগুলোয় দর্শক সমাগম ছিল এ রকম: বাংলাদেশ বনাম নেদারল্যান্ডস– ১৫-২০ হাজার। পাকিস্তান বনাম বাংলাদেশ–হাজার ৩০-৩৫। পাকিস্তান বনাম ইংল্যান্ড– হাজার ৪০। অস্ট্রেলিয়া বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা সেমিফাইনাল– হাজার ৪০-৪৫।
যা বিশ্বকাপ চলাকালীন দেশের বাকি মাঠ স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। আমেদাবাদে বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ইংল্যান্ড-নিউজিল্যান্ড ম্যাচের দিন বেশ মনে পড়ে, খেলার পাতায় জনশূন্য নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামের পেল্লায় একখানা ছবি বসেছিল চার কলাম জুড়ে। যেখানে কতিপয় দর্শক আর অতি ভালমানুষ দণ্ডবায়স ছাড়া আর কিছু নজরে পড়েনি। ওই যে লিখলাম না, মাঠের জাত। মাঠের বোধ। মাঠের চেতনা। শুধুমাত্র মুখ দেখে কেউ কলকাতাকে খেলার শহর বলে না। দেশ-বিদেশের দিকপাল ক্রিকেটাররা এমনি-এমনি ইডেনকে শ্রেষ্ঠত্বের তাজ দিয়ে যাননি। আজহার দিয়েছেন। ভিভিএস দিয়েছেন। প্রসন্ন-রোহিত-আসিফ-আফ্রিদিরা বলেছেন।
মানছি, ইডেন ও তার দর্শক সময়-সময় চিরবিতর্কিত। অনেক সময়ই সে ঘরের টিম ছেড়ে বাইরের দল, বাইরের প্লেয়ারকে সমর্থন করা শুরু করে। কিন্তু করে কেন? করে, ইডেন ভালো ক্রিকেটের সাধক ব’লে। আর তার সমর্থন? ক্রিকেট বোধ? লিখে দিতে পারি, বিশ্বকাপ ফাইনালে ট্রাভিস হেডের তাণ্ডবের সময় আমেদাবাদ দর্শকের মতো স্থানুবৎ বসে থাকত না ইডেন, ‘মৃত’র মতো আচরণ করত না। ভারতকে না জেতাতে পারুক, স্রেফ চেঁচিয়ে আস্ট্রেলিয়ার আরও তিনটে উইকেট ফেলে দিত! এবং ফাইনালে অস্ট্রেলিয়া যে ভোগাবে, কঠিন ভোগাবে, তার আগাম পূর্বাভাস গোটা দেশে একমাত্র করেছিল ইডেন। আসমুদ্রহিমাচল যখন বিশ্বকাপ আসছে ধরে নিয়ে আনন্দে নটনৃত্য শুরু করে দিয়েছিল, ইডেন তখন আপ্রাণ চেষ্টা করছিল সেমিফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকাকে জেতাতে! মনে করুন, শহরে অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকা সেমিফাইনাল মনে করুন। শেষ দিকে ইডেন সম্পূর্ণ দক্ষিণ আফ্রিকার দিকে ঘুরে যায়নি? চাপে ফেলেনি অস্ট্রেলিয়াকে? আসলে সে বুঝেছিল, দক্ষিণ আফ্রিকা ফাইনাল খেললে ১২ বছর বছর পর কাপ আসবে দেশে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া উঠলে কপালে দুঃখ আছে!
আর তাই বাকিদের রাগ-জ্বলুনি হলে কিছু করার নেই। ক্রিকেট বিধাতা যে তাদের নিছক ক্রিকেট স্টেডিয়াম করেই রেখেছেন, ইডেন করেননি! ইডেন তো দেখিয়ে দিয়েছে, মুমূর্ষু ওয়ান ডে ক্রিকেটও গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে পারে পাশে মনের মতো একমাঠ দর্শক পেলে। ইডেন তো দেখিয়ে দিয়েছে, ভারতের বাইরেও ক্রিকেটটা খেলা হয়। আজও হয়। আর প্রতিদ্বন্দ্বী মাঠদের রাগ-হিংসা? ধুর, ভেবে লাভ কী? বাস-ট্রামের পিছনে লেখাটা দেখেননি?
তোমার ঈর্ষা, আমার অহংকার!