তামিল ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে, কখনও, কোনও দিন, কোনও ঘোষিত ‘আর্টহাউজ মুভমেন্ট’ হয়নি। ফিল্মমেকারকে প্রথমেই মাথায় রাখতে হয়, ‘দর্শক খাবে তো!’ এক্সপেরিমেন্ট? কী যে বলেন! তাও, ওই গণ-মনোরঞ্জনের সূত্রেই, যেসব কাজ তাঁরা উপহার দিয়েছেন ও দিয়ে চলেছেন, তা চমকে যাওয়ার মতো। আর, সেসব কাজের অন্যতম পুরোধা তিনি, যিনি হিন্দিতে ডেবিউ করিয়েছেন কমলকে। নাম, কৈলাসম বালাচন্দর।
আটের দশক সবে শুরু। বলিউড তখন বৈচিত্রের তুঙ্গে। একদিকে আগুন রাখছেন অমিতাভ বচ্চন, বিনোদ খান্না, শত্রুঘ্ন সিনহা; আরেকদিকে মধু-নম্রতায় ঋষি কাপুর, শশী কাপুর। পাশাপাশি, সমান্তরাল মুগ্ধতায় উঠে আসছেন নাসিরউদ্দিন শাহ, ফারুখ শেখ, ওম পুরি। ঠিক সেই সময়েই, দমকা দখিনা হাওয়ায় মাতিয়ে তুললেন তামিলনাড়ুর এক নায়ক ও এক গায়ক। হ্যাঁ, কমল হাসান আর এস. পি. বালাসুহ্মমন্যম। কোমর নয়, মন দোলাল– ‘তেরে মেরে বিচ মেঁ ক্যায়সা হ্যায় ইয়ে বন্ধন…’। সিনেমা, ‘এক দুজে কে লিয়ে’।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: যাদের ১৮ হয়নি, তারা এসব বুঝবে না; আর, যাদের ১৮ হয়েছে, তারা মজা পাবে
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
তামিল ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে, কখনও, কোনও দিন, কোনও ঘোষিত ‘আর্টহাউজ মুভমেন্ট’ হয়নি। ফিল্মমেকারকে প্রথমেই মাথায় রাখতে হয়, ‘দর্শক খাবে তো!’ এক্সপেরিমেন্ট? কী যে বলেন! তাও, ওই গণ-মনোরঞ্জনের সূত্রেই, যেসব কাজ তাঁরা উপহার দিয়েছেন ও দিয়ে চলেছেন, তা চমকে যাওয়ার মতো। আর, সেসব কাজের অন্যতম পুরোধা তিনি, যিনি হিন্দিতে ডেবিউ করিয়েছেন কমলকে। নাম, কৈলাসম বালাচন্দর; সংক্ষেপে, কে. বি.; তাবড় মানুষেরা যাঁকে সসম্ভ্রমে বলেন, ‘কে. বি. স্যর’।
কেনই-বা ইন্ডাস্ট্রি সম্ভ্রম করবে না তাঁকে? শুধু তো কমল হাসান নন! তাঁরই আলো-ছায়াতে বড় হয়েছেন রজনীকান্ত, শ্রীদেবী, চিরঞ্জীবী, জয়া প্রদা, নাসর, প্রকাশ রাজ… আরও অনেকে। শুধু তো অ্যাক্টররা নন! এ. আর. রহমান ডেবিউ করেছেন তাঁর প্রোডাকশনে, ‘রোজা’। এম. এম. কীরাবানির তামিল ডেবিউ তাঁর ফিল্মেই, ‘আজাগান’। তিনি নামমাত্র ডিরেক্টর-প্রোডিউসার নন, তিনি আস্ত একটা স্কুল!
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: পারিশ্রমিকের কথা না ভেবেই নপুংসকের চরিত্রে কাজ করতে চেয়েছিলেন শাহরুখ খান
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ওদিকে, যখন স্কুলে পড়তেন তিনি, তিনের দশকের শেষে, নাল্লামাঙ্গুড়ি গ্রামের চৌহদ্দিতে একটাও সিনেমাহল ছিল না। অথচ, আট বছরের বালাচন্দরের বুকে রুপোলি দুনিয়ার তীব্র আকুলি। কাছাকাছি যেখানে সিনেমা দেখায়, তা ১২ কিলোমিটার দূরে। সম্বল বলতে, লজঝড়ে সাইকেল একখান। তবু, কোনও নতুন সিনেমা এলেই, সাইকেল চালিয়ে পাড়ি দেয় বালক। ফেরার রাস্তায়, ভাঁজতে থাকে গল্প বলার কায়দা, আপনমনে। জুটিয়ে নেয় কয়েকজন সমবয়সিকে। নাটকের দল বানায়, ডিরেক্টর হয় সে। আস্তে আস্তে, নিজেও লিখতে শুরু করে নাটক। এইভাবে কৈশোর, তারুণ্য; কেটে যায় ইউনিভার্সিটি-বেলা। সরকারি চাকরিতে ঢুকেও, সহকর্মীদের নিয়ে, তৈরি হয় থিয়েটার গ্রুপ। হ্যাঁ, পাগলামির অন্য নাম সাধনা; তাকে থামালে চলে না।
তামিলনাড়ুর সিনেমা কিংবা রাজনীতির সঙ্গে যাঁরা অল্প-বিস্তর পরিচিত, তাঁদেরকে নতুন করে এম. জি. রামচন্দ্রনের (এম. জি. আর.) পরিচয় দেওয়ার দরকার নেই। বালাচন্দর জানতেন না, রামচন্দ্রন তাঁর নাটক দেখেন। একদিন, নিজের নতুন সিনেমায় ডায়লগ লেখার জন্য তিনি ডেকে পাঠালেন নাট্যকারকে। সুপারস্টারের ডাকে, তিনি প্রথমে খুশিতে হাবুডুবু; পরে বুঝলেন এ নাও বাওয়া তাঁর কাজ নয়। রামচন্দ্রনের লার্জার দ্যান লাইফ ইমেজে তাল মেলানো তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। সিদ্ধান্তে এলেন, নিজের মনের কথা বলবেন নিজের সিনেমায়; কোনও স্টারের ইমেজ বাঁচাবেন না, তৈরি করবেন নতুন স্টার। (তরুণ মজুমদারের কথা মনে পড়ছে, পাঠক?)
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: ‘আমি গানের দোকান খুলতে আসিনি’, যশ চোপড়াকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ‘দিল চিজ ক্যা হ্যায়’-এর গীতিকার
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
পুরো তামিল সিনেমার ইমেজটাই ভেঙে ফেললেন তিনি। পুরুষ মানেই ঢিসুম ঢিসুম নয়! নারী মানেই নয় মিনমিনে নাচ আর তুলতুলে সংলাপ! তাঁর সিনেমায় মহিলা চরিত্ররা পেল নিজস্ব স্বর, বলতে পারল নিজেদের কথা। তিনি দেখাতে থাকলেন এ দেশের অন্দরমহল, যা এতকাল ফল্গু রাখা ছিল।
ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ মুগ্ধ করল তাঁকে। না, গল্পটা টুকলেন না; বরং, অনেককিছু বদলে, বানালেন ‘অবল ওরু তোডার কথাই’। তামিলনাড়ুর মানুষের মনে গেঁথে গেল তাঁর কাজ। একে একে রিমেক হল তেলুগু, কন্নড়, হিন্দি– আর, বাংলাতেও! হ্যাঁ, ‘কবিতা’। কমল হাসানের কেরিয়ারে, এখনও পর্যন্ত, এটাই তাঁর অভিনীত একমাত্র বাংলা সিনেমা; বাংলা উচ্চারণও নিজেরই। মজার ব্যাপার, হিন্দি ছাড়া, সবক’টা রিমেকেই কমল ছিলেন; শুধুমাত্র তামিলে ও বাংলায় কাজ করেছেন একই চরিত্রে।
প্রায় ১২-১৩ বছর ধরে ‘শিশুশিল্পী’ তকমায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন কমল। হ্যাঁ, কয়েক বছর অ্যাসিস্ট্যান্ট কোরিওগ্রাফারের কাজও করছিলেন বটে; কিন্তু, আসল খিদেটা তো অভিনয়ের, ক্যামেরার সামনে। টের পেলেন বালাচন্দর। বড়বেলার বড়সড় রোল দিলেন তাঁকে, ‘আরঙ্গেত্রম’-এ। শুটিংয়ে এসে, কমল জানতে পারলেন, পারিশ্রমিক মাত্র ৫০০ টাকা! রেগেমেগে, গেলেন পরিচালকের কাছে। গোটা ইউনিট হাঁ! তরুণ রক্ত চেঁচামেচি জুড়েছে কে. বি. স্যরের ওপর! বালাচন্দর অবিচলিত। চুপচাপ শুনলেন, পাশে বসালেন কমলকে। বললেন, ‘টাকা নয়, চরিত্রটা নিয়ে ভাবো। দেখো, এই ফিল্মের পর পারিশ্রমিক নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।’ গুরুবাক্য ফলেছিল অক্ষরে অক্ষরে। তাঁর শিষ্যত্ব নিয়ে ভুল করেননি কমল।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: পায়ে বেত মেরে নাচাতে হল অমিতাভ বচ্চনকে
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
মাদ্রাজ ফিল্ম ইন্সটিটিউটের একটা অনুষ্ঠান, বালাচন্দর এসেছেন। ভিড়ের ভেতরে বসে, শিবাজী গায়কোয়াড়; দুম করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘অ্যাক্টিং ছাড়া একজন অ্যাক্টরের কাছ থেকে আর কী পাওয়ার আশা করেন?’ ডাগর চোখের ডিরেক্টর দেখলেন, হাসছেন এক শ্যামলবরণ– ভঙ্গিতে প্রেম, রাগ, হতাশা, অভিমান, আর আলগা তাচ্ছিল্য লুকনো। বালাচন্দর বললেন, ‘স্টুডিওর বাইরে যেন অ্যাক্টিং না করে।’
শিবাজী কাজ চাইলেন তাঁর সিনেমায়। পরিচালক বললেন, ‘তুমি তো তামিল ভাষাটাই জানো না!’ সত্যিই তাই, বেঙ্গালুরুর মারাঠি শিবাজী দুটো ভাষায় সড়গড়– কন্নড় আর মারাঠি। বাড়িতে ফিরে, তামিল বন্ধু রাজা বাঢারের সঙ্গে দিনরাত তামিলে কথা বলতে শুরু করলেন তিনি। ঠিক ২০ দিনের মাথায়, আবার এলেন বালাচন্দরের কাছে। তখন তিনি গড়গড়িয়ে তামিল বলছেন। ডেবিউ করলেন ‘অপূর্বা রাগাঙ্গাল’-এ।
মুশকিল বাঁধল অভিনেতার নামে। তামিল ইন্ডাস্ট্রিতে ‘শিবাজী’ একজনই– শিবাজী গণেশন। কী করা যায়? ভাবতে ভাবতে, পরিচালকের মনে পড়ল ‘মেজর চন্দ্রকান্ত’; একটা নাটক, চাকরি করার সময়ে লিখেছিলেন, পরে সিনেমাও বানিয়েছেন। ওই নাটকে তাঁর প্রিয়তম চরিত্র, ‘রজনীকান্ত’। তখুনি, নবাগতর নাম দিলেন নিজেরই লেখা চরিত্রের নামে। বাকিটা… মাইন্ড ইট! গুরুর নির্দেশ এখনও মনে রেখেছেন রজনীকান্ত। ক্যামেরা অফ হলে, আজও তিনি আমাদের মতোই সাধারণ।
তেলুগু ফিল্ম ‘ও সীতা কথা’-র তামিল রিমেক, ‘মুন্ড্র মুডিচ’-র জন্য নতুন নায়িকা খুঁজছেন বালাচন্দর। আরেকজন ‘শিশুশিল্পী’ নজরে পড়ল তাঁর। মাত্র ১৩ বছর বয়স, কিন্তু পর্দা বেয়ে চুঁইয়ে পড়ে প্রাণ। তাঁকেই কাস্ট করলেন তরুণী নায়িকার রোলে। হ্যাঁ, শ্রীদেবী। ভারতীয় সিনেমায় তর্কাতীত ঈশ্বরীর কেরিয়ারে, সম্ভবত, এটাই ছিল জটিলতম চরিত্র ও তাঁর সেরা কাজ। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার, তামিল রিমেকে কমল ছিলেন প্রেমিকের চরিত্রে; আর মালয়ালাম রিমেকে, নেগেটিভ চরিত্রে। কেরিয়ারের শুরুতে, এমনকী স্টারডমের গোড়াতেও, কমল আর রজনীকান্ত– দু’জনেই দু’হাতে লোফালুফি করেছেন নায়ক ও খলনায়কের ভূমিকা।
সত্যি বলতে, ‘এক দুজে কে লিয়ে’-র আগেও হিন্দিতে কাজ করেছেন কমল। বালাচন্দরেরই হাতে, ‘আরঙ্গেত্রম’-এর রিমেক, ‘আয়না’-য়। কোনও কারণে, ক্রেডিটে নাম ছিল না তাঁর। তবে, সে আফসোস সুদে-আসলে পুষিয়ে দিয়েছিলেন গুরুই। তেলুগু ‘মারো চরিত্র’-র হিন্দি রিমেক, ‘এক দুজে কে লিয়ে’-কে আজও ক্লাসিক মানেন পণ্ডিতেরা। যদিও, কমল হাসান নিজের প্রিয় ৭০টা ভারতীয় সিনেমার তালিকায় রেখেছেন অরিজিনালকেই। আর, কারণও ব্যাখ্যা করেছেন তিনি। বলেছেন, দুটোই বালাচন্দরের ডিরেকশন হলেও, ‘মারো চরিত্র’-র সিম্পলিসিটিটা হিন্দিতে নেই।
শেষে, শুরুর ওই গানটা, আরেকবার– ‘তেরে মেরে বিচ মেঁ ক্যায়সা হ্যায় ইয়ে বন্ধন…’ ব্রিটনি স্পিয়ার্সের জনপ্রিয়তম গান, ‘টক্সিক’-এর বেস টিউনে পাবেন ওই গান। হ্যাঁ, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য, দেওয়া-নেওয়া, বালাচন্দর ও ব্রিটনি– সৃষ্টির ধুন এভাবেই অন্তরিক্ষে ঘোরে।