Robbar

প্রতি ‘রোববার’-এ আমাদের যেন দেখা হয়

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 23, 2023 8:57 pm
  • Updated:December 23, 2023 9:02 pm  

এই ‘রোববার’ আমায় দিয়েছিল একটা ‘ভালোবাসার বারান্দা’, একটা বড়দের লাইব্রেরি– যা প্রতি রোববার খোলা। আমার স্কুলের কয়েকজন সিনিয়র যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের ছাত্র ছিলেন। তাঁদের কাছে শোনা গল্পে নবনীতা দেবসেন ছিলেন এক মিথ। ভালোবাসার বারান্দায় রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে বসলে আমার মনে হত ওসবই মিথ্যে, অতিকথন। এ যেন রবিবারে, দুপুরের খাওয়া আর বিকেলে চারটের সিনেমার মধ্যিখানে বসে আচার খেতে খেতে শোনা মা-কাকিমাদের গল্প। সেই গল্পের পরিসরে কখনও কখনও ঢুকে পড়ত ওঁর হাঁপানির দমকা কাশি, ইনহেলার আবার কখনও প্রথম তুষারপাত দেখার অভিজ্ঞতা। আমি হলফ করে বলতে পারি, আমার সেইসব সিনিয়র সামনে থেকে নবনীতাকে দেখে, কথা বলে, ক্লাস করে যত না চিনেছেন, তার চেয়ে ঢের বেশি আমি নবনীতাকে চিনি। আঠেরো, পাঠেরও সিরিজের এই লেখা শ্রীময় ভট্টাচার্যর।

সুমন চট্টোপাধ্যায় নিরুদ্দেশ, এ যে আমার কত সহস্রবার মনে হয়েছে! কিন্তু কী যেন এক ভয়ে আমি কাউকে একথা বলতে পারিনি। সাহসে কুলিয়ে ওঠেনি। বারবারই মনে হয়েছে চট্টোপাধ্যায় থেকে কবীর এর মধ্যে অন্তত এক সুমন দূরত্ব। কবীরের গলা চট্টোপাধ্যায়ের চেয়ে একটু বেশি ঘড়ঘড়ে। কবীর আপন খেয়ালে থাকতে পছন্দ করেন। তবে তা অবশ্যই বাংলা খেয়াল। আর চট্টোপাধ্যায় তো ছিলেন নাগরিক কবিয়াল। অতএব মোদ্দা কথা হলো, যে সুমন চট্টোপাধ্যায়, সে নিরুদ্দেশ।

কিন্তু এই যে কথা একান্ত আমার, সেই ভাবনায় প্রথম সিলমোহর দিলেন আরেক চট্টোপাধ্যায়। তিনি অ-কিঞ্চিৎ, তিনি অনিন্দ্য। সুমন প্রসঙ্গে তিনি লিখলেন

‘তবুও তিনি নাছোড় এক পারফর্মার। তবুও তিনি পয়সা ফেলে শেখাতে পারেন ভানুমতির খেল। বব ডিলান তাঁরই জন্য অনুষ্টুপ ছন্দে ব্যালাড বাঁধেন পিট্ সিগার তাঁর বন্ধুর জন্য গিটার পাঠিয়ে দেন I’

এভাবেই আমার সমস্ত না লিখতে পারা আবেগ একে একে অনুবাদ করছিলেন অনিন্দ্য, তাঁর প্রতিটি ‘নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণা’য়। ফি রোববার, ফ্রি রোববার-এর পাতায়। এই কলামেই তো আমার আলাপ শুভ্র আর নিলয়ের সঙ্গে। যে শুভ্র লিখে ফেলেছিল, অমোঘ এক একাকিত্বের বয়ান–

‘শহর থেকে দূরে শহরতলি মনে পড়ে,

যাওয়া সবাই মিলে, ফেরা ভীষণ একা হয়ে,

সব কিছু হারিয়ে সেই স্মৃতির আড়ালে,

না যাব না ছেড়ে তোমায়…’

অনিন্দ্যই জানান, ওদের একটা ব্যান্ড ছিল,  নাম ‘ইনফিউশন’। ১৯৯৮ সালে হঠাৎই ওরা চলে যায় কলকাতা ছেড়ে। বসতি তোলে ‘আকাশের একটু খানি পরে। হ্যাঁ জবর দখল’। শুধু নিলয় শুভ্রই নয়, এরকম আরও অনেকের, অনেক কিছুর হারিয়ে যাওয়ার জরুরি খবর আমি পেয়েছি ‘রোববার’-এর পাতায়।

Robbar 08 May,2022 e-Paper, Robbar 08 May,2022, e-Paper, Robbar 08 May,2022 e Paper, e Newspaper Robbar 08 May,2022, Robbar 08 May,2022 e Paper, Robbar 08 May,2022 ePaper

আমার জীবনের প্রথম ১৫টি বসন্তে রবিবারগুলো ছিলো না-লেখাপড়ার। ষোলো-র ডিসেম্বর পরবর্তী প্রতি রবিবার সু-লেখা পড়ার। অনুবাদে আমি বরাবরই কাঁচা। তাই মধ্যম পুরুষ আর প্রথম পুরুষ এর ইংরেজি যে কী করে সেকেন্ড পার্সন এবং থার্ড পার্সন হয়, তা আমি বুঝি না। কিন্তু যিনি ফার্স্ট পার্সন তিনি যে উত্তম, তা নিয়ে আজ আর আমার কোনও সন্দেহই নেই। ঋতুপর্ণ ঘোষ যেদিন মারা যান, সবাই বলেছিল বাংলা চলচ্চিত্রের একটা অধ্যায় শেষ হয়ে গেল। কিন্তু আমার মনকেমন জুড়ে ছিল অনেক অনেক না লিখে ওঠা ‘ফার্স্ট পার্সন’। এর ঠিক পরের রবিবার, ‘রোববার’-এর যে সংখ্যা বেরয়,  তাতে ফার্স্ট পার্সন-এর জন্য বরাদ্দ পাতাটি একদম ফাঁকা ছিল। এই প্রথম কোনও ফার্স্ট পার্সন পড়তে এত সময় লেগেছিল আমার। আসলে এই কলামটি ছিল আমার ‘বাংলা ভাষার মাদুর’, যাতে বসে গেরস্থালির গপ্প করতে করতে আমি বুঝতে শিখেছিলাম ‘বড় কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি আমরা। একটার পর একটা দিন নতুন করে তীব্র হতে তীব্রতর কশাঘাতের চিহ্ন রেখে বিদায় নিচ্ছে।’ যদ্দুর মনে পড়ে, শেষ ‘ফার্স্ট পার্সন’ লেখা হয়েছিল এই মাদুর নিয়েই। মাদুর যে নম্রতার শিক্ষক, সে নিয়ে লিখেছিলেন ঋতুপর্ণ। এই সংযমের শিক্ষা, আমার নিভৃত জীবনচর্চার প্রথম পাঠ ‘রোববার’।

Robbar 20 February, 2022 e-Paper, Robbar 20 February, 2022, e-Paper, Robbar 20 February, 2022 e Paper, e Newspaper Robbar 20 February, 2022, Robbar 20 February, 2022 e Paper, Robbar 20 February, 2022 ePaper

আজন্ম শুনে এসেছি সব বাঙালিই কবি কিন্তু সব কবি বাঙালি নন। বিশ্বাস করিনি। ‘গোঁসাইবাগান’ আমার সে অবিশ্বাসে খানিক চিড় ধরিয়েছিল। বরাবরই গদ্য পড়তে বেশি ভালো লাগে আমার। কবিতার মারপ্যাঁচ বিশেষ বুঝি না, এবং এই যে বুঝি না– সেই নিয়ে কুণ্ঠা তো ছিলই না বরং ওইসব দুর্বোধ্য কবিতার কবিদের প্রতি এক ঠাট্টার মনোভাবও পোষণ করেছি আকৈশোর। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া বাকি যে কজন কবির নাম আমি আমার ১৫ বছর বয়স অবধি জানতাম, তাঁরা কেউই রেহাই পাননি আমার এই নির্বোধ ঠাট্টার হাত থেকে। রবীন্দ্রনাথ বাদ, কারণ তিনি ঠাকুর, কবি নন। আজ বলতে দ্বিধা নেই, ‘গোঁসাইবাগান’, আমার সেই ঠাট্টার বারান্দায় এক নিঃশব্দ থাপ্পড়। কানধরে আমায় বাংলা কবিতার পায়ের কাছে এনে বসিয়েছিলেন জয়। শুনিয়েছিলেন এক আশ্চর্য অভিমানের গল্প।

‘‘সে অভিমান হল এই যে, আমি যে আমার সারাজীবনটা ঢেলে দিচ্ছি কবিতায়, ঢেলে দিচ্ছি আমার সব জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা, পড়বার আগে তুমি কেন আরেকটু প্রস্তুত হয়ে আসবে না?… পাঠক বলবে, তুমি কবি, তুমি কেন আমার হৃদয় জিতে নেবে না?… এই ভাবে দুয়ের মধ্যে ফাটল তৈরি হয়। দু’জন দু’দিকে সরে যান। মধ্যে পড়ে থাকে একাকিত্ব। কবিও একাকী হয়ে পড়েন। পাঠকও।’’

এই একাকিত্ব থেকে বেরিয়ে আসার যে বনপথ, তাই ই আমার ‘গোঁসাইবাগান’।

Robbar Feb 19, 2017 e-Paper, Robbar Feb 19, 2017, e-Paper, Robbar Feb 19, 2017 e Paper, e Newspaper Robbar Feb 19, 2017, Robbar Feb 19, 2017 e Paper, Robbar Feb 19, 2017 ePaper

এছাড়াও এই ‘রোববার’ আমায় দিয়েছিল একটা ‘ভালোবাসার বারান্দা’, একটা বড়দের লাইব্রেরি– যা প্রতি রোববার খোলা। আমার স্কুলের কয়েকজন সিনিয়র যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের ছাত্র ছিলেন। তাঁদের কাছে শোনা গল্পে নবনীতা দেবসেন ছিলেন এক মিথ। ভালোবাসার বারান্দায় রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে বসলে আমার মনে হত ওসবই মিথ্যে, অতিকথন। এ যেন রবিবারে, দুপুরের খাওয়া আর বিকেলে চারটের সিনেমার মধ্যিখানে বসে আচার খেতে খেতে শোনা মা-কাকিমাদের গল্প। সেই গল্পের পরিসরে কখনও কখনও ঢুকে পড়ত ওঁর হাঁপানির দমকা কাশি, ইনহেলার আবার কখনও প্রথম তুষারপাত দেখার অভিজ্ঞতা। আমি হলফ করে বলতে পারি, আমার সেইসব সিনিয়র সামনে থেকে নবনীতাকে দেখে, কথা বলে, ক্লাস করে যত না চিনেছেন, তার চেয়ে ঢের বেশি আমি নবনীতাকে চিনি। ভালোবাসার বারান্দা-র শেষ লেখায় লিখেছিলেন,

‘যেসব মানুষ আমাকে একবারও চোখে দ্যাখেনি, দূর দূর গ্রাম থেকে ছুটে আসতে চাইছে একবার শেষ দ্যাখা দেখতে– আরে, এটাই শেষ দ্যাখা, তোমায় কে বলল?’

ধুলোখেলা - A Bengali Magazine Archive: Robbar Magazine - 2010, 7th February

আমার বিশ্বাস এই ‘তুমি’ সম্বোধনও আমায় উদ্দেশ্য করেই। আর সত্যিই তো দেখাসাক্ষাৎ শেষ হয়নি আমাদের। এই তো খানিক আগেই আপনাকে দেখলাম, ‘রোববার’-এ, আপনার বাড়ির বারান্দায়। হাসলেন আমায় দেখে। পাঠকের বিশ্বাস না হয় তো চোখ বুলিয়ে নেবেন তারাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তোলা সেই অসাধারণ ফ্রেমে।

‘রোববার’ আমার বড় হওয়ার সাক্ষী, আমার বুড়ো হওয়ার সাক্ষী। আর আমি, রোববার-এর সতেরো পেরিয়ে আঠেরোয় পড়ার সাক্ষী। জন্মদিন ভালো কাটুক। এসব মিটে গেলে, আমরা কোনও এক রোববার দেখে দেখা করবো। অথবা বরং এরকম একটা কথা থাক, যে আমাদের যেদিন দেখা হবে, সেদিনই রোববার। এভাবে সবারই কখনও না কখনও রোববার করে নেবো আমরা। সব্বার না হলেও আমাদের দু’জনেরই না হয় হবে সেসব ‘রোববার’।