এদেশে এখনও অবধি নাস্তিক কিংবা অন্যধারায় বিশ্বাসী মানুষের জন্য কোনওরকম ক্রিমেনসন সিস্টেম চালু করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু কেন? শুধুমাত্র তিনি অন্য ভাবধারায় বিশ্বাসী বলে? এই উত্তর কারও কাছে নেই। হয় ইসলাম কিংবা না-হয় সনাতন ধর্মের প্রথাগত রীতিনীতি মেনে তাঁর দেহটির শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়। কিন্তু, এই কার্যের মাধ্যমে তাঁর প্রতি কিংবা তাঁর বিশ্বাসের প্রতি কি যথেষ্ট ন্যায়বিচার করা হচ্ছে? নিশ্চয়ই নয়।
অভীক পোদ্দার
একজন ব্রাহ্মণ চিরকাল নিরামিষ খাদ্যগ্রহণ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর, তাঁরই দেহর ওপর প্রকাশ্যে মাংসের পদ রাখা হল! কিংবা একজন মুসলমান, যিনি সারাটা জীবন নিষ্ঠাভরে পালন করেছেন ধর্ম-কর্ম, তাঁর মৃত্যুর পর সমস্ত শরীরে মাখিয়ে দেওয়া হল সাদা চন্দন! এমনটা সত্যি হলে কী ঘটবে?
এখনকার শিক্ষিত সমাজ রে-রে করে উঠবেন। হয়তো-বা, ধর্মীয় দাঙ্গা-টাঙ্গাও বেঁধে যেতে পারে। কিন্তু, আমি যদি বলি এরকমটা তো প্রতিনিয়ত ঘটছে। কই এবেলা তো কোনওপ্রকার প্রতিবাদ হচ্ছে না!
এদেশে এখনও অবধি নাস্তিক কিংবা অন্যধারায় বিশ্বাসী মানুষের জন্য কোনওরকম ক্রিমেনসন সিস্টেম চালু করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু কেন? শুধুমাত্র তিনি অন্য ভাবধারায় বিশ্বাসী বলে? এই উত্তর কারও কাছে নেই। হয় ইসলাম কিংবা না-হয় সনাতন ধর্মের প্রথাগত রীতিনীতি মেনে তাঁর দেহটির শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়। কিন্তু, এই কার্যের মাধ্যমে তাঁর প্রতি কিংবা তাঁর বিশ্বাসের প্রতি কি যথেষ্ট ন্যায়বিচার করা হচ্ছে? নিশ্চয়ই নয়। যেখানে আমাদের দেশের সংবিধান সর্বোচ্চ মান্যতা দেয় ‘সেকুলার’ শব্দটিকে, সেখানে সেকুলারদের শেষকৃত্যের জন্যই কোনওরকম ক্রিমেনসন সিস্টেম থাকবে না, তা আশ্চর্যের কথা!
একটি মানুষের জন্মের পর, তাঁর অমতে সামাজিক নিয়মে তাঁর নামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় একটি পদবী। সেজন্য, একপ্রকার জোরপূর্বক তাঁর সঙ্গে জুড়ে যায় একটি জাতি কিংবা ধর্ম। কিন্তু, তিনি যদি পরবর্তীতে সে-পরিচয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব না করেন, যদি আজীবন তিনি চর্চা করেন অন্য কোনও ভাবধারার, তবে নিশ্চয়ই তাতে অন্যায়ের কিছু নেই। কীভাবে, কোন ধারায় একটি মানুষ তাঁর জীবন অতিবাহিত করবেন, তা ঠিক করা তো তাঁর ফান্ডামেন্টাল রাইটস।
ঠিক তেমনই একজন মানুষের মৃত্যুর পর তাঁর শরীরটা ঠিক কোনও পদ্ধতিতে নষ্ট করা হবে– তা ঠিক করার অধিকার থাকে একমাত্র তাঁর।
কৈলাস শাংখলা, ‘টাইগার ম্যান ওফ্ ইন্ডিয়া’। আজীবন লড়াই করে গিয়েছেন পরিবেশ রক্ষার তাগিদে। শেষকালে তাঁর ইচ্ছে ছিল, যা তিনি কড়া ভাষায় ব্যক্তও করেছিলেন, তিনি মারা গেলে তাঁর দেহটি যেন কাঠ দিয়ে পোড়ানো না হয়। কারণ, তাঁর মতে, যে অসংখ্য গাছগুলো বাঁচানোর জন্য তিনি আপ্রাণ লড়ে গেছেন সারাটাজীবন, শুধুমাত্র তাঁর মরদেহটি পোড়ানোর জন্য যেন তা কেটে নষ্ট করা না হয়। এই কথাটির মধ্যে কিন্তু প্রাণের আকুতি ও যুক্তির তীব্রতা মারাত্মক প্রবল।
আবার ধরুন, বিখ্যাত গবেষক ও প্রাবন্ধিক বিনয় ঘোষ যখন মারা গেলেন, শোনা যায়, তাঁরই বাড়ির ছাদে মাইক লাগিয়ে ঘটা করে হরিনাম সংকীর্তন-সহ শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করা হয়েছিল। কিন্তু, আদতে তিনি ছিলেন আপাদমস্তক কঠোর মার্কসবাদী। ধর্মের নিয়ম-টিয়ম তিনি মানতেন তো না-ই এমনকী, সারাজীবন বিপরীতমুখী চর্চা রেখে গেছেন ত্যাগ ও সাধনার মাধ্যমে।
উপরোক্ত দু’টি ঘটনায় স্পষ্ট হয় যে, মৃত্যুর পরেও উপযুক্ত সম্মান তাঁদের অবশ্যই প্রাপ্য ছিল। আজীবন যে ত্যাগ ও চর্চা তাঁরা দেশবাসীর জন্য রেখে গিয়েছিলেন, মৃত্যুর পরে তাঁর সে-বিশ্বাসের প্রতি সঠিক সম্মান ও মর্যাদা দিতে আমরা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছি।
হিন্দুধর্মের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় দেহটিকে আগুনে পোড়ানোর মাধ্যমে। ইসলামধর্মে দেহটিকে মাটির ভেতর গোর দেওয়া হয়। এবং তা হয় নির্দিষ্ট বিশ্বাস ও চর্চা মেনে। কিন্তু, একজন নাস্তিক যিনি জন্মসূত্রে প্রথম লগ্নে না চেয়েও হিন্দু ছিলেন, তিনি যদি ইচ্ছা প্রকাশ করেন তাঁর মৃত্যু ঘটলে তাঁর দেহটি যেন মাটিতে গোর দেওয়া হয়, এবং তা কোনও নিয়মরীতি না মেনে, তবে সে-ক্ষেত্রে উপায় কী? মুসলিমরা তো আর রাজি হবেন না তাঁদের কবরস্থান কোনও নাস্তিকের জন্য বরাদ্দ করতে। কিংবা, এর উল্টোটা ধরুন, একজন নাস্তিক যিনি জন্মসূত্রে প্রথম লগ্নে না চেয়েও মুসলিম ছিলেন, তিনি যদি পরে ইচ্ছা প্রকাশ করেন মৃত্যুর পরে তাঁর দেহটি যেন আগুনে পুড়িয়ে নষ্ট করে দেওয়া হয়, এবং সেটাও কোনও নিয়মরীতি না মেনে, তাহলে কি হিন্দুরা তাঁদের পবিত্র শ্মশান উক্ত ব্যক্তির শেষকৃত্য সম্পন্ন করার জন্য উন্মুক্ত করবে? অবশ্যই নয়।
এদেশে এখনও অবধি নাস্তিক কিংবা অন্যধারায় বিশ্বাসী মানুষের জন্য কোনওরকম ক্রিমেনসন সিস্টেম চালু করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু কেন? শুধুমাত্র তিনি অন্য ভাবধারায় বিশ্বাসী বলে? এই উত্তর কারও কাছে নেই। হয় ইসলাম কিংবা না-হয় সনাতন ধর্মের প্রথাগত রীতিনীতি মেনে তাঁর দেহটির শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়। কিন্তু, এই কার্যের মাধ্যমে তাঁর প্রতি কিংবা তাঁর বিশ্বাসের প্রতি কি যথেষ্ট ন্যায়বিচার করা হচ্ছে? নিশ্চয়ই নয়।
তাহলে শেষমেশ দাঁড়াল-টা কী? সামাজিক তথাকথিত প্রচলিত রীতি না মানলেই একজন মানুষের ইচ্ছের কোনওরকম মূল্য নেই। নাস্তিকতার যে চর্চা ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে যে লড়াই তিনি লড়ে গিয়েছেন আজীবন, যার জন্য হয়তো তাঁর অসীম ত্যাগ ও অপমানও সইতে হয়েছিল প্রতি পদক্ষেপে, এইবার মৃত্যুর পরে শুধুমাত্র কোনও প্রকার সিস্টেম না থাকায় তা ধ্বংস হয়ে যাবে নিয়মের বেড়াজালে। এ-ও কি মানা যায়! তবে তো সংবিধানের ‘সেলফ ডিগনিটি’, ‘ফান্ডামেন্টাল রাইটস’ কথাগুলো ছেলেভোলানো খেলনা মাত্র। কেন অন্য যে-কোনও ধর্মের মতো এক্ষেত্রেও তাঁর বিশ্বাস, চর্চা ও মর্জি অনুসারে তা মান্যতা দিয়ে শেষকৃত্যটি পালন করা হবে না?
সেজন্য হয়তো এখন মৃত্যুপরবর্তী শরীরদান, অঙ্গদানের প্রচলন বেড়েছে। কিংবা, মাথাচাড়া দিয়েছে বেশ কিছু এজেন্সি, যারা মোটা টাকার বিনিময়ে কন্ট্রাক্ট নিয়ে সাধারণের শেষকৃত্য সম্পন্ন করছে। সেক্ষেত্রেও অবশ্য মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয় পরিবারের সদস্যদের। কারণ, তারা খবর না দিলে এই প্রক্রিয়াগুলির কোনওটিই প্রয়োগ করা ভাবে সম্ভবপর হয়ে ওঠে না।
তবে উপায়? হ্যাঁ, তা অবশ্য আছে। একটি পোর্টাল যত দ্রুত সম্ভব চালু করা দরকার। যেখানে প্রত্যেক মানুষ তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করার পদ্ধতি সম্পর্কে জানিয়ে যাবেন। এবং মৃত্যুর পরে তাঁর দেহটি কবরস্থান কিংবা শ্মশানে নিয়ে গেলে পোর্টালের মাধ্যমে তা মনিটরিং করে দেখা হবে। এরপর তাঁর ইচ্ছানুসারে পালিত হবে অন্তিম কার্যটি। এই একুশ শতকে এসেও এই তথাকথিত ‘সেকুলার’ দেশে আমরা কেন এইসব বিপরীতমুখী চর্চা করা মানুষদের জন্য উপযুক্ত সম্মানের সঙ্গে শেষকৃত্যের একটি অত্যাধুনিক পদ্ধতি নিয়ে ভাবব না?