রেশমি ঠিক করল একা সটান সুমিতকে গিয়ে বলবে, ‘কথা আছে।’ সুমিত বিগলিত হয়ে নিশ্চয়ই বলবে ‘কী কথা?’ তখন ঝেড়ে কাপড় পরিয়ে দেবে রেশমি। লোকটা তো জানে না যে মা থেকে শুরু করে ছাত্রী বা বন্ধুরা, তাকে দেখলেই পোস্টমাস্টারের প্রসঙ্গ পেড়ে বসে। কেন বসে? তাকে দেখে কি কিছু বোঝা যায়?
২২.
সুমিত সম্পর্কে ঠিক স্বাভাবিক হতে পারছে না রেশমি।
লোকটার কথা মনে হলেই রাগ হচ্ছে। আবার নিজেই কোথাও অনুভব করছে রাগটা উঁকি মারছে অনুরাগের পর্দা সরিয়েই। অথচ সুমিত যেন তার মাথা থেকে বেরোতে চাইছে না। সকালে হয়ত বারান্দায় বসে চা খাচ্ছে, মা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী রে, তোর পোস্ট মাস্টারের খবর কী?’ সঙ্গের মেয়েগুলো তো কারণে অকারণে সুমিতের কথা তোলে, খবর দেয়। ‘জানো দিদি, পোস্টমাস্টারবাবুকে দেখলাম কাল কত রাতে ফিরছিলেন।’ রেশমি ঝাঁঝিয়ে ওঠে, ‘তাতে আমার কী? আমাকে বলছিস কেন? গেছিল কোথাও পড়িয়ে দেশোদ্ধার করতে।’ বাহা, বুধনি, নবনীতা, ওরা কি কিছু আন্দাজ করে? রেশমির নিজেরও তো রাস্তা দিয়ে হাঁটলে মনে হয় উল্টোদিক থেকে এখন যদি সুমিত আসত, বেশ ভালো হত। কথা বলত রেশমি, ডাঁট নিয়ে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
একটা প্রশ্নের ভুলভুলাইয়ায় ঘুরছে রেশমি। নিজের কাছেই স্পষ্ট নয়। সুমিতকে নিয়ে তার দুর্বলতাটা কতটা এগোবে? সুমিতকে বলবে? তার মন জানবে? নাকি, সুমিত কিছু বলবে, তার অপেক্ষা করবে। সুমিতকে নিয়ে তার ভাবনাটা কতটা বাস্তবসম্মত? আবার, যখন সুমিতের উপর চটেছে, তখন ভেবেছে, মনের দরজাটা কি পুরোপুরি বন্ধ করে দেবে?
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
হ্যাঁ, সুমিতকে নিয়ে ভাবনাটা নিজের মধ্যে খানিকটা পল্লবিত করে ফেলেছিল রেশমি। এই জঙ্গলমহল এলাকায় এসে পোস্টমাস্টারের ছাত্র পড়ানো, রক্তদান কিংবা স্বাস্থ্যশিবির, জনসংযোগে মিশে থাকা বেশ ভালো লাগছিল রেশমির। কিন্তু সব গোলমাল পেকেছে সুমিতের ওই ভিতু ভিতু ভাবে। এটা একদম নিতে পারছে না রেশমি। আরে যখন এই হামলা, হত্যা, সন্ত্রাস, তখন মানুষের পাশে না দাঁড়িয়ে পালাচ্ছে সুমিত। বরং মাওবাদীরা এসে বিদ্যুৎদের গুন্ডাবাহিনীর বিরুদ্ধে মানুষের মনোবল বাড়াচ্ছে। সুমিতের উপর রেশমির দুর্বলতাটাই এখন বিপরীতমুখী রাগের কাজ করছে।
সমস্যা হল সুমিতকে ঘিরে ভালোলাগাটা এতটাই গভীরে চলে গিয়েছে যে রেশমি নিজে বিভ্রান্ত। রাগ যেটা হচ্ছে, তাতে সুমিতকে ভোলা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে প্রবল একটা ঝগড়া হোক, রেশমি মনখুলে চিৎকার করে সুমিতকে তার ভুলটা বলুক আর তারপর সুমিত সেটা শুধরে বেশ নায়ক নায়ক আচরণ করুক। এই যে এখন রটে আছে এমনি আপদে বিপদে পোস্টমাস্টারকে পাওয়া যায়, কিন্তু বড় গোলমাল হলে তিনি উধাও। এতে যেন রেশমির নিজেরই লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়। লোকটাকে ধরেবেঁধে মানুষ করতে হবে।
রেশমি ঠিক করল একা সটান সুমিতকে গিয়ে বলবে, ‘কথা আছে।’ সুমিত বিগলিত হয়ে নিশ্চয়ই বলবে ‘কী কথা?’ তখন ঝেড়ে কাপড় পরিয়ে দেবে রেশমি। লোকটা তো জানে না যে মা থেকে শুরু করে ছাত্রী বা বন্ধুরা, তাকে দেখলেই পোস্টমাস্টারের প্রসঙ্গ পেড়ে বসে। কেন বসে? তাকে দেখে কি কিছু বোঝা যায়? মা সেদিন বললেন, ‘ছেলেটাকে কিন্তু বেশ ভালোই লাগে। ওর বাড়িতে কে কে আছে?’ রেশমি একটু লজ্জায় পড়ে বলেছে, ‘সে আমি কী করে জানব?’ মা বলেছেন, ‘শুনলাম তো বিয়ে থা হয়নি।’ রেশমি আরও জোরে বলেছে, ‘তাতে আমার কী?’ কিন্তু পরে ভেবেছে মা-ও কি খোঁজখবর নিতে নেমেছেন? মায়েরও নেটওয়ার্ক খুব ভালো।
একটা প্রশ্নের ভুলভুলাইয়ায় ঘুরছে রেশমি। নিজের কাছেই স্পষ্ট নয়। সুমিতকে নিয়ে তার দুর্বলতাটা কতটা এগোবে? সুমিতকে বলবে? তার মন জানবে? নাকি, সুমিত কিছু বলবে, তার অপেক্ষা করবে। সুমিতকে নিয়ে তার ভাবনাটা কতটা বাস্তবসম্মত? আবার, যখন সুমিতের উপর চটেছে, তখন ভেবেছে, মনের দরজাটা কি পুরোপুরি বন্ধ করে দেবে? না, রেশমি নিজের মধ্যেই কোনও স্পষ্ট উপসংহারে পৌঁছতে পারেনি। বরং, মনে হয় সুমিতকে ঘাড় ধরে ভুলগুলো শুধরোতে বাধ্য করবে সে। অধিকার থাকবে তার।
রাতে ঘুম আসতে দেরি। ভাবনায় সুমিত। ঘুম ভেঙে গেলে আবার মাথায় সুমিত। রেশমি আবিষ্কার করছে নিজেকে নতুন করে, সুমিতের বাইরে বেরোতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু যার জন্য এই ভাবনা, সেই লোক কি অনুভব করছে কিছু? হ্যাঁ, নাকি না? রেশমি আবার ভাবনায় ডোবে। জানলা দিয়ে একরাশ জ্যোৎস্না পাঠিয়ে মজা দেখতে থাকে পূর্ণিমার চাঁদ।
( চলবে)
…পড়ুন কুসুমডিহার কাব্য-এর অন্যান্য পর্ব…
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২১: কুসুমডিহা এক বুক আশঙ্কা নিয়ে দিন কাটায়
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২০: মানুষকে একজোট করতে চায় রেশমি
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৯: দূত এবং দূতের দূত মারফত খবর গিয়েছে কুসুমডিহায়
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৮: টিলার ওপরের মহিলাদের নিয়ে পুলিশের কৌতূহল প্রবল
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৭: পল্টু জবার পিছনে খরচ বাড়িয়ে ইদানীং এদিক-ওদিক হাত পেতে ফেলছে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৬: কমরেড ব্রহ্মা কতদিন পালিয়ে বেড়াবে?
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৫: প্রতিমাকে পাওয়া গেল কুসুমডিহায়, মিথ্যে ধর্ষণের মামলায় ফাঁসি হয়েছে তাঁর বরের
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৪: এখন খবরের শীর্ষে কুসুমডিহায় মাওবাদী হামলা আর কমরেড ব্রহ্মা
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৩: কমরেড ব্রহ্মা তাহলে যেখানেই থাকুন, কুসুমডিহার ওপর নজর রেখেছেন
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১২: থমথমে কুসুমডিহাতে টহল দিচ্ছে পুলিশ
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১১: ছদ্মপরিচয়ে কুসুমডিহাতে প্রবেশ পুলিশ ফোর্সের
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১০: শান্ত কুসুমডিহা এখন হিংস্র হয়ে ফুঁসছে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৯: কুসুমডিহাতে পুলিশ, নেতা, বুদ্ধিজীবী, মহিলা কমিশন, মিডিয়ার ভিড়
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৮: জঙ্গলমহলের তল্লাট থেকে উত্তাপ ছড়াল কলকাতার মিডিয়াগুলির স্টুডিওতেও
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৭: কুসুমডিহাতেই দেখিয়ে দেব আমরা মরে যাইনি
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৬: পরিচয় যত বাড়ছে, সুমিত অনুভব করছে এলাকা গরম হচ্ছে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৫: পশ্চিমগড়ের মৃতদেহর খবর এখনও কলকাতা সংস্করণে জায়গা পায়নি
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৪: সভা আর প্রচার মানেই বন্দুক ধরা নয়
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৩: ‘বন্দুক হাতে নেওয়া প্রত্যেকটা মেয়েকে সমর্থন করি’
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২: সিস্টেমের দোষেই কুসমডিহাতে ফের অমঙ্গলের পদধ্বনি, সুমিতকে বোঝাল রেশমি
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১: জঙ্গলমহলের কুসুমডিহার নতুন পোস্টমাস্টার সুমিত, জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করে পারবে!