‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ তখন সরকারিভাবে বন্ধ, কিন্তু গান থামেনি। তরুণ তুর্কীরা গিটার হাতে নেমে পড়েছে। নেতা, গৌতম চট্টোপাধ্যায়। পাশে বাপি, তাপস দাস, ঋত্বিকা সাহানী, দেবজ্যোতি মিশ্র, সুব্রত, জয়জিৎ, সুরজিৎ, অন্তরা। এ. মুখার্জি স্টলের সামনে ডেরা বাধা হল। সৃষ্টি প্রকাশনীর সামনে রঞ্জন ঘোষাল ঘোষণা করলো দেড় মাইল লম্বা স্টেজ বানাবে, ময়দানের ধারে। সেখানে মহীন গান গাইবে।
বইমেলা একসময় আমাদের বিশেষ আবেগের জায়গা ছিল। পরিবেশবিদ সুভাষ দত্ত সেই আবেগে জল ঢেলে দিলেন। এত ধুলো ওঠে ১৫ দিন কলকাতা শহরে, পলিউশনের মাত্রা ছাড়া অবস্থা তৈরি করে এবং কেস হয়। শোনা যায়, কেসটার ফয়সলা গিল্ডের পক্ষেই যেত। এবং ময়দানেই থাকত বইমেলা। কিন্তু তার পক্ষে কেউ কোর্টে নাকি হাজিরাই দেয়নি। এবং বইমেলা বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ বহু বছর এই ময়দান চত্বরে, রবীন্দ্র সদন চত্বরে তা আসাধারণভাবে ঘটত। ময়দানের ধুলো যা উড়ত, তার থেকে অনেক বেশি ধুলো সারা শহর জুড়ে, সারা বছর ওড়ে। কে শোনে কার কথা! এত আওয়াজ, এত তাণ্ডব, এত বেলাল্লাপনা, এত ফ্যাশন প্যারেড– ওই অভিজাত অংশে নৃত্য করে বেড়ায়। এই ময়দানে যাতায়াতের বিশেষ সুবিধে ছিল মেট্রো, ছিল ময়দানে গাড়ি রাখার বিশাল ব্যবস্থা।
আমাদের যদিও তখন বয়স অনেক কম ছিল। পুরো মেলা ঘুরতে, বই নাড়াচাড়া করতে, নানা সাংস্কৃতিক গুলতানি দিতে দিতে সন্ধেগুলো কেটে যেত। অপূর্ব ছিল সেই পরিবেশ। বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার ও সিনে-ফটোগ্রাফারকে একবার কোনও সংস্থা বিশেষ বরাত দেয়, বইমেলা তার চোখে আলোকচিত্র ধরে রাখার জন্য। তিনি ‘তেরো নদীর পারে’-র বারীন সাহা। এ-ও আমরা দেখেছি, স্বাতী-সুনীল মাঝমাঠে দাঁড়িয়ে, অকাতরে সই বিলোচ্ছেন। আমি হাঁটছি, কবি দীপক মজুমদারের পাশে-পাশে। লোকে চমকে উঠছে। কানে কানে ফিসফিস করছে। কারণ দীপক এক বিতর্কিত চরিত্র। সবে গ্রিস থেকে ফিরেছেন। হাংরি ধরা এবং ছাড়া– এসব কাহিনি হাওয়ায় উড়ছে। হাংরি-র সমীর রায়চৌধুরি শহরে ডেরা বেঁধেছেন, দক্ষিণে। তাঁকে নিয়েও গল্প। সুবিমল মিশ্র বড় বড় সাদা চুল নিয়ে, একটা সাদা কাগজ হাতে আমার পিছনে ছুটছে। আবেদন, একটা মুখাবয়ব এঁকে দিতে হবে। কারণ, পরের দিন সে তার বড় বড় চুল কেটে ফেলবে। তার স্মৃতি ধরে রাখতে চায়। ‘কৌরব’-এর কমল চক্রবর্তী একটা ম্যাগাজিনের পিছনের সাদা অংশ ধরে দাঁড়িয়ে। দ্রুত একটা মুখ এঁকে দিলাম। এমনই হাজারো স্মৃতি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
যে বছর বইমেলা পুড়ে গেল, সুবিমলের কালো বইও পুড়ে গেল। আগের দিন সংগ্রহ করে রেখেছিলাম। আমার বড় ক্যানভাস, এক জায়গায় টাঙানো ছিল। ঘটনাচক্রে ওইদিকে আগুন এসে তাকে পুড়িয়ে দেয়নি। এই বইমেলায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় গলায় মিনিবুক ঝুলিয়ে ফেরি করতেন। আমি হাজারও ছবি এঁকে এঁকে মেলায় ঘুরতাম।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
মৃদুল দাশগুপ্তর বইমেলাধুলো: জোড়হস্তে কফি হাউসের টেবিলে টেবিলে বইমেলায় যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন গিল্ডকর্তারা
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
যে বছর বইমেলা পুড়ে গেল, সুবিমলের কালো বইও পুড়ে গেল। আগের দিন সংগ্রহ করে রেখেছিলাম। আমার বড় ক্যানভাস, এক জায়গায় টাঙানো ছিল। ঘটনাচক্রে ওইদিকে আগুন এসে তাকে পুড়িয়ে দেয়নি। এই বইমেলায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় গলায় মিনিবুক ঝুলিয়ে ফেরি করতেন। আমি হাজারও ছবি এঁকে এঁকে মেলায় ঘুরতাম। মহীনের ঘোড়াগুলি তখন সরকারিভাবে বন্ধ, কিন্তু গান থামেনি। তরুণ তুর্কীরা গিটার হাতে নেমে পড়েছে। নেতা, গৌতম চট্টোপাধ্যায়। পাশে বাপি, তাপস দাস, ঋত্বিকা সাহানী, দেবজ্যোতি মিশ্র, সুব্রত, জয়জিৎ, সুরজিৎ, অন্তরা। ‘এ. মুখার্জী’ স্টলের সামনে ডেরা বাঁধা হল। ‘সৃষ্টি প্রকাশনী’র সামনে রঞ্জন ঘোষাল ঘোষণা করল দেড় মাইল লম্বা স্টেজ বানাবে, ময়দানের ধারে। সেখানে মহীন গান গাইবে। সৃষ্টির অমল সাহা, টাকার থলি নিয়ে এগিয়ে আসতে চাইল, সৃষ্টিও গেল, অমল সাহাও দেহ রাখলেন। মহীন আর গাইল না।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সুশোভন অধিকারীর বইমেলাধুলো: চটের ওপর বসে মন দিয়ে কার্ড এঁকে চলেছেন একমাথা ঝাঁকড়া চুলের পূর্ণেন্দু পত্রী
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সবই ঘটছে বইমেলাকে ঘিরে। সুভাষ দত্তের কল্যাণে এ-সবেরই সলিল সমাধি হল। সল্টলেকের সেন্ট্রাল পার্কে গিয়ে সাপেরা, পাখিরা সবাই বাস্তুচ্যুত হল, আমরা ঢুকে পড়লাম, হইহই করতে করতে। বই মাথায় উঠল, এটা একটা গান-মেলা হয়ে গেল, বাউলরা হাঁক পাড়ল ‘ভোলা মন রে’ বলে। ততদিনে সবাই গত হয়েছেন, সুনীল, শ্যামল, সন্দীপন, দীপক, শক্তি, ভূমেন, প্রকাশ, বিজন, গণেশ, তুষার, রঘু। ম্রিয়মাণ, অন্ধকার হয়ে গেছে বইমেলা, আমাদের আবেগের বইমেলা। একান্ত নিজস্ব, উৎসব ছিল তখন। বই উৎসব, কত প্রেম ছিল। কত ঘোর ছিল।