সাহিত্য অকাদেমির সচিব রামকুমার মুখোপাধ্যায় এখানে তুলে এনেছেন ভারতীয় ভাষায় রবীন্দ্র-সৃষ্টির অনুবাদের প্রসঙ্গ, খুঁজে দেখেছেন উত্তর-পূর্ব ভারতে রবীন্দ্রনাথের অবস্থানকে, আবার রবীন্দ্রনাথের একাধিক ছোটগল্প ও উপন্যাসের বিশ্লেষণী পাঠও এ বইয়ে উপস্থিত।
সেটা ১৯১৭ সালের গোড়ার কথা। আমেরিকার নেব্রাস্কার লিঙ্কন শহরে বক্তৃতা দিতে গিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানকার অধিবাসীদের তরফেই মিলল এক আশ্চর্য উপহার, শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের ছাত্রদের জন্য। বিদ্যালয়ের ভাণ্ডারে উপহার আসা যদিও নতুন নয়, তাছাড়া তার ব্যয়নির্বাহের জন্য বারে বারে হাত পাততে হয়েছে কবিকেও। কিন্তু এই উপহার সর্বতোভাবেই অভিনব, গুরুত্বপূর্ণও। এবার একটি আস্ত ছাপাখানা পাওয়া গেল উপহার হিসেবে। কিন্তু সেই উপহার দেশে আনার পথে দেখা গেল অনেক বাধাবিপত্তি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আঁচ তখন তুঙ্গে উঠেছে। ব্রিটিশশাসিত ভারতে অন্য দেশ থেকে কোনও কিছু আমদানি করা সহজ নয়। তার ওপর আবার মুদ্রণযন্ত্র! তলোয়ারের পাশাপাশি কলমকেও বরাবরই সাবধানী দূরত্বেই রাখতে চায় যে কোনও শাসক। এর আগে জালিয়ানওয়ালাবাগ কাণ্ডের প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের প্রতিক্রিয়া তখনও তাজা। এই সফরেও ‘ন্যাশনালিজম’ প্রসঙ্গটি নিয়ে নাড়াচাড়া করেছেন তিনি। বিশ্বজোড়া জাতীয়তাবাদের হুংকার যে নরমেধ-যজ্ঞের সূচনা করেছে, সেই আবহে রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতামালা শুরু হয়েছে ‘The Cult of Nationalism’ দিয়ে। এদিকে, সে এমন এক সময়, যখন রাশিয়ায় শোনা যাচ্ছে সমাজতন্ত্রের পদধ্বনি, আবার ভারতেও গান্ধীর হাত ধরে ঘনিয়ে উঠছে সত্যাগ্রহের প্রস্তুতি, সেই বছরেই চম্পারণ সত্যাগ্রহের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের ঔপনিবেশিক রাজনীতিতে সরাসরি আত্মপ্রকাশ করছেন গান্ধী। এই টালমাটাল রাজনৈতিক প্রতিবেশে মুদ্রণের অনুমতি দিতে নারাজ ব্রিটিশ সরকার। ততদিনে সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করে আইন পাশ করেছে তারা। কড়া নজরদারি চলছে প্রকাশনার ওপরেও।
‘নাইটহুড’ সম্মান ফেরানোর পর রবীন্দ্রনাথের লেখার উপরেও যে সেই অদৃশ্য প্রহরা জারি ছিল, তার সাক্ষ্য দেয় কবির ব্যক্তিগত চিঠি। এই সফরেই, ১৯১৬ সালের ২৮ অক্টোবর তিনি শিকাগো থেকে রথীন্দ্রনাথকে লিখেছেন সেন্সরের হাতে ‘অন্যায় বাধা’-র কারণে ঠিক সময়ে চিঠি না পৌঁছনোর কথা। অতএব ছাপার যন্ত্রে ধুলো জমে, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় মরচে পড়ে; বিদেশ থেকে কেনা টাইপ ও আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র অব্যবহৃত হয়ে পড়ে থাকে, ‘বিশ্ববিদ্যাসংগ্রহ গ্রন্থমালা’-র প্রকাশ ও তার বিক্রির হিসেবি পরিকল্পনা করেও ব্যর্থ হন রবীন্দ্রনাথ; কিন্তু সরকারের অসম্মতি জগদ্দল পাথরের মতো স্থির হয়ে থাকে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………
মুদ্রণ শুরুর আগে যেমন সরকারের টালবাহানা কম ছিল না, তেমনই কাজ শুরু হওয়ার পরেও কাজের ভালোমন্দ খুঁটিনাটি বিচার নিয়ে কবির অনুমোদন মেলা ভার ছিল। ১৯২৪ সালের ২১ নভেম্বর প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, শান্তা চট্টোপাধ্যায়কে লিখছেন ‘Talks in China’ বইটি প্রকাশের পরেও কবির নির্দেশে তা প্রত্যাহার করে নেওয়ার কথা। ছাপার ভুল খুব সামান্য হলেও মার্জিন কম থাকা এবং পৃষ্ঠার অঙ্কে ব্র্যাকেট দেওয়ার কারণেই বইটির সজ্জা পছন্দ হয়নি রবীন্দ্রনাথের।
………………………………………………………………………………………………………………………………………
‘কবির ছাপাখানা কবির প্রকাশনা’ গ্রন্থে এই টালবাহানার পর্যায়টিকেই তথ্য সাজিয়ে তুলে ধরেছেন রামকুমার মুখোপাধ্যায়। বিশ্বভারতীর প্রকাশনা বিভাগের একসময়ের অধিকর্তা রামকুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখায় সেই ইতিহাস প্রাঞ্জল হয়ে থাকবে, এ আশ্চর্যের নয়। ছাপাখানা আমদানি ও মুদ্রণের অনুমোদন আদায় করা, সুকুমার রায়ের সাহায্যে শান্তিনিকেতনের কর্মীদের কাজ শেখার বন্দোবস্ত, এসব কথার পাশাপাশি বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ গড়ে ওঠার প্রেক্ষাপটটিকেও তিনি ঠাঁই দিয়েছেন এ-বইয়ে। জানিয়েছেন, মুদ্রণ শুরুর আগে যেমন সরকারের টালবাহানা কম ছিল না, তেমনই কাজ শুরু হওয়ার পরেও কাজের ভালোমন্দ খুঁটিনাটি বিচার নিয়ে কবির অনুমোদন মেলা ভার ছিল। ১৯২৪ সালের ২১ নভেম্বর প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, শান্তা চট্টোপাধ্যায়কে লিখছেন ‘Talks in China’ বইটি প্রকাশের পরেও কবির নির্দেশে তা প্রত্যাহার করে নেওয়ার কথা। ছাপার ভুল খুব সামান্য হলেও মার্জিন কম থাকা এবং পৃষ্ঠার অঙ্কে ব্র্যাকেট দেওয়ার কারণেই বইটির সজ্জা পছন্দ হয়নি তাঁর। বইয়ের সৌন্দর্য, সৌকর্যের বিষয়ে যে কবির বরাবরই সজাগ দৃষ্টি ছিল, এর আগেও তা বারে বারেই ধরা পড়েছে। ১৯০৯ সালে ইন্ডিয়ান প্রেস থেকে প্রকাশিত ‘চয়নিকা’-য় ‘ছাপা ভালো, কাগজ ভালো, বাঁধাই ভালো’ বলে শংসাপত্র দেওয়ার পরেও নন্দলাল বসুর ছবি নিয়ে রীতিমতো অপছন্দ প্রকাশ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সুতরাং কোনও একটি বইয়ের নিখুঁত নির্মাণের নেপথ্যে যে বহু অভিমুখ থাকে, শান্তিনিকেতন প্রেস প্রতিষ্ঠার সময়ে সেই সবক’টি বিষয়কেই এক সূত্রে গেঁথে নিতে চেয়েছিলেন তিনি। রঙ্গমঞ্চে যেমন তিনি দৃশ্যপটের মধ্যযুগীয় সাজসজ্জা ঝেড়ে ফেলেছিলেন, তেমনই বইয়ের প্রচ্ছদ ও নামলিপিতেও পুরনো ভারী অলংকরণ মুছে ফেললেন রবীন্দ্রনাথ, তাঁর কাছে ওই গতানুগতিক রীতিকে মনে হল ‘নিজের বই সম্বন্ধে লেখকের গদগদ স্নেহের প্রকাশ’। পরিবর্তে তিনি এমন এক রুচিশীল প্রচ্ছদ ও অলংকরণ চাইলেন যা জাপানি তলোয়ারের খাপের মতো সাদা ও অলংকারহীন। ‘সহজ পাঠ’, ‘বিচিত্রিতা’, ‘মহুয়া’, ‘চিত্রলিপি’, ‘গীতবিতান’– এমন একাধিক বইয়ে ধরা রইল গ্রন্থনির্মাণ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভাবনার সে অনাড়ম্বর আভিজাত্য।
………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: ভেসে যায় ভেলা ইতিহাস ছুঁয়ে ছুঁয়ে
………………………………………………………………………………………………………………………………………
এ বইয়ের নামে কেবল ছাপাখানা ও প্রকাশনার প্রসঙ্গ থাকলেও, বস্তুত এই বইটি নানা রবীন্দ্রনাথের একখানি মালা। সাহিত্য অকাদেমির সচিব রামকুমার মুখোপাধ্যায় এখানে তুলে এনেছেন ভারতীয় ভাষায় রবীন্দ্র-সৃষ্টির অনুবাদের প্রসঙ্গ, খুঁজে দেখেছেন উত্তর-পূর্ব ভারতে রবীন্দ্রনাথের অবস্থানকে, আবার রবীন্দ্রনাথের একাধিক ছোটগল্প ও উপন্যাসের বিশ্লেষণী পাঠও এ বইয়ে উপস্থিত। তবে সেই বহুমাত্রিকতার ইশারা বইয়ের নামকরণে থাকলেও হয়তো মন্দ হত না। এমন একটি তথ্যনির্ভর বইয়ে মুদ্রণপ্রমাদের দিকটিতেও আরও সতর্ক থাকার প্রয়োজন ছিল। বিশেষ করে রথীন্দ্রনাথের নাম বারেবারে রবীন্দ্রনাথ হয়ে যাওয়া কাম্য ছিল না।
কবির প্রকাশনা, কবির ছাপাখানা
রামকুমার মুখোপাধ্যায়
লালমাটি
২৫০ টাকা