লোকসভা ভোটের আগে তড়িঘড়ি উত্তরাখণ্ডের বিধানসভায় ৭৪০ পাতার অভিন্ন দেওয়ানি বিধির খসড়াটি পাশ করিয়ে নেওয়ার পিছনে যে বিজেপির মেরুকরণের লক্ষ্যটিও রয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। ইতিমধ্যেই উত্তরাখণ্ড সরকারের পদক্ষেপের প্রতিবাদে মুখ খুলেছে মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড, যারা শরিয়ত আইনের সংরক্ষণ ও প্রয়োগ করে। যত এই প্রতিবাদ জোরালো হবে, তত উত্তরাখণ্ডের বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করা অভিন্ন দেওয়ানি বিধিটির সমর্থনে সোচ্চার হবে সংঘ পরিবার। দু’পক্ষের সংঘাতে মেরুকরণের রাস্তা প্রশস্ত হবে।
সনাতনী রামরাজ্যের দিকে আরও একটা পদক্ষেপ ঘটে গেল কিছুটা নীরবেই। অযোধ্যার রামমন্দির উদ্বোধনের রেশ কাটতে না কাটতেই অদূরে দেরাদুনের বিধানসভায় পাশ হয়ে গেল অভিন্ন দেওয়ানি বিধি। যাতে বেড়ি পরানো হচ্ছে, দু’জন প্রাপ্তবয়স্কের একত্রবাস বা লিভ-ইন সম্পর্কে। বিধিতে বলা হয়েছে, সরকারের অনুমোদন ছাড়া যুগলে একত্রবাস করলে হবে জেল, জরিমানা।
উত্তরাখণ্ডের পর এবার ধীরে ধীরে অন্য বিজেপি শাসিত রাজ্যে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির বিল তৈরির প্রস্তুতি শুরু হয়ে যাবে। রাজনৈতিক মহলের ধারণা, গোটা দেশে এই বিধি লাগু এখন সময়ের অপেক্ষা। ৩৭০ ধারা বিলোপ, অযোধ্যায় বিতর্কিত জমিতে রামমন্দির নির্মাণের মতো দেশে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করা আরএসএসের দীর্ঘদিনের লালিত একটি স্বপ্ন। ব্রিটিশ আমলে হিন্দু ও মুসলিমদের জন্য তৈরি হয়েছিল পৃথক পারিবারিক, বিবাহ, বিচ্ছেদ ও সম্পত্তির উত্তরাধিকার সংক্রান্ত আইন। দেশের বৈচিত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামো রক্ষা করতে সংবিধান প্রণেতারা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের এই ব্যক্তিগত ও পারিবারিক অধিকারের জায়গায় রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ চাননি। কিন্তু আরএসএস স্বাধীনতার পর থেকেই মুসলিমদের এই সংক্রান্ত পার্সোনাল ল তথা শরিয়ত আইন (১৯৩৭) রদের দাবিতে সরব থেকেছে। ১৯৬১ সালে পাকিস্তানে আইয়ুব খানের আমলে বহুবিবাহ ও তালাক প্রথা নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ার পর এপারে আরএসএসের স্বর আরও চড়েছে। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এসে তিন তালাক নিষিদ্ধ করেছেন। উত্তরাখণ্ডের অভিন্ন দেওয়ানি বিধিতে এবার বহুবিবাহ ও ‘নিকাহ হালালা’ নিষিদ্ধ হচ্ছে।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন: ন্যায়ে ফিরল ভারত, সুপ্রিম কোর্টের রায় বিলকিসের হাসির পক্ষে
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
লোকসভা ভোটের আগে তড়িঘড়ি উত্তরাখণ্ডের বিধানসভায় ৭৪০ পাতার অভিন্ন দেওয়ানি বিধির খসড়াটি পাশ করিয়ে নেওয়ার নেপথ্যে বিজেপির মেরুকরণের লক্ষ্যটিও রয়েছে। ইতিমধ্যেই উত্তরাখণ্ড সরকারের পদক্ষেপের প্রতিবাদে মুখ খুলেছে মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড, যারা শরিয়ত আইনের সংরক্ষণ ও প্রয়োগ করে। যত এই প্রতিবাদ জোরালো হবে, তত উত্তরাখণ্ডের বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করা অভিন্ন দেওয়ানি বিধিটির সমর্থনে সোচ্চার হবে সংঘ পরিবার। দু’পক্ষের সংঘাতে মেরুকরণের রাস্তা প্রশস্ত হবে।
অভিন্ন দেওয়ানি বিধির খসড়া খুলে দিয়েছে লিভ-ইন সম্পর্ক নিয়ে বিতর্কের রাস্তাও। লিভ-ইন সম্পর্ক নিয়ে বিধিতে বলা হয়েছে, বিয়ের মতো লিভ-ইন সম্পর্কও সরকারি রেজিস্ট্রারের কাছে নথিভুক্ত করতে হবে। একসঙ্গে থাকতে শুরু করার এক মাসের মধ্যে নথিভুক্তি করাতে না পারলে দু’জনেরই হবে ছ’মাসের জেল অথবা ২৫ হাজার টাকা জরিমানা, কিংবা দুটোই। রেজিস্ট্রার খতিয়ে দেখবেন দু’জনের বয়স ২১ হয়েছে কি না। যদি ২১ না হয়, তাহলে লাগবে বাবা-মায়ের সম্মতি। দু’জনের কেউ বিবাহিত কি না, আগে কোনও সম্পর্ক ছিল কি না, সেসবও খতিয়ে দেখবেন ওই জেলা রেজিস্ট্রার। তিনি অনুমতি দিলে তবেই একত্রবাস করা যাবে। তথ্যের ক্ষেত্রে প্রতারণা করলেও হবে জেল, জরিমানা।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
নরেন্দ্র মোদি বা সংঘ পরিবারের যে রামরাজ্যের আখ্যান, তাতে একদিকে রয়েছে যেমন ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র করার প্রকল্প, তেমন অন্যদিকে আছে একটি সনাতনী রক্ষণশীল সমাজ তৈরি করার লক্ষ্য। যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিজেপির তরফে বিজ্ঞানকে অস্বীকার করে সব ঘটনার পৌরাণিক ব্যাখ্যা হাজির করা হয়, ঠিক সেই মূল্যবোধ থেকেই সবরকম উদার ভাবনা ও আধুনিকমনস্কতার বিরোধিতা করা হয়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
একত্রবাসের এই শর্ত দেখে বিরোধীরা বলতে শুরু করেছে, বিজেপি এবার দেশবাসীর বেডরুমে ঢুকে পড়ার রাস্তা তৈরি করল। প্রশ্ন উঠেছে, একত্রবাস বা লিভ-ইন সম্পর্ক কেন সরকারকে জানাতে হবে? এটা কি নাগরিকের ব্যক্তিগত পরিসরে সরকারের ঢুকে পড়া নয়? যদি লিভ-ইন সম্পর্ক সরকারি রেজিস্ট্রারের কাছে নথিভুক্তি করাতে হয়, তাহলে বিয়ের সঙ্গে এর তফাত কী রইল? বলা হয়েছে, লিভ-ইন সম্পর্কেও যুগলের সন্তান আইনি স্বীকৃতি পাবে এবং বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে মহিলা সঙ্গী ভরণপোষণের দাবি জানাতে পারবেন। এই দু’টি ইতিবাচক প্রস্তাব। কিন্তু বাকি শর্তের বাঁধনে কার্যত একত্রবাসকে কী নিষিদ্ধ করে ফেলা হচ্ছে না? এমনকী বলা হয়েছে, লিভ-ইন সম্পর্ক ভেঙে গেলে তাও নথিভুক্ত করতে হবে। প্রয়োজনে পুলিশি তদন্তও হবে।
নরেন্দ্র মোদি বা সংঘ পরিবারের যে রামরাজ্যের আখ্যান, তাতে একদিকে রয়েছে যেমন ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র করার প্রকল্প, তেমন অন্যদিকে আছে একটি সনাতনী রক্ষণশীল সমাজ তৈরি করার লক্ষ্য। যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিজেপির তরফে বিজ্ঞানকে অস্বীকার করে সব ঘটনার পৌরাণিক ব্যাখ্যা হাজির করা হয়, ঠিক সেই মূল্যবোধ থেকেই সবরকম উদার ভাবনা ও আধুনিকমনস্কতার বিরোধিতা করা হয়। আধুনিক সমাজে যখন দু’টি মানুষের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানটি ক্রমশ অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে, তখন অভিন্ন দেওয়ানি বিধির মাধ্যমে তাকেই আরও শক্তিশালী করার চেষ্টা চলছে। সন্তানকে স্বীকৃতি ও বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে মহিলা সঙ্গীকে ভরণপোষণের দাবি করার সুযোগ দেওয়ার মতো দু’টি প্রগতিশীল ধারার মোড়কে একত্রবাস তথা লিভ-ইনকেও বিয়েতে পর্যবসিত করা হচ্ছে। আসল উদ্দেশ্য একত্রবাসের ধারণাকে সমাজ থেকে বিদায় দেওয়া। উত্তরাখণ্ডের বিধিতে বলা হয়েছে, সে রাজ্যে যারা পর্যটক বা অস্থায়ীভাবে বাস করতে যাবে, তাদের ক্ষেত্রেও ধারাগুলি প্রযোজ্য।
রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর হয়তো অভিন্ন দেওয়ানি বিধির এই একত্রবাস সংক্রান্ত ধারাগুলি কোর্টের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। কারণ কোর্টে নাগরিকের ব্যক্তিগত বিষয়ে গোপনীয়তার অধিকার রক্ষার প্রসঙ্গটি আসবে। সমকামী সম্পর্কের ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ কীভাবে হবে, তাও স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। বহুক্ষেত্রে দুই সহপাঠী বা সহকর্মী রুমমেট হিসাবে থাকেন। সেটাও কি একত্রবাস হিসেবে বিবেচিত হবে? সেখানেও কি পুলিশ ঢুকে যাবে? যে কেউ যে কারও বিরুদ্ধে একত্রবাসের অভিযোগ তুলতে পারে। তার নিষ্পত্তি কীভাবে হবে? বিরোধীরা সঠিকভাবেই বলেছেন, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি রাষ্ট্রের হাত ধরে বিজেপিকে নাগরিকের বেডরুমে ঢোকার সুযোগ করে দেবে।
তাৎপর্যপূর্ণভাবে উত্তরাখণ্ডে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির পাইলট প্রকল্প থেকে জনজাতি সমাজকে বাদ দেওয়া হয়েছে। বহু জনজাতি সম্প্রদায়ে বহুবিবাহ স্বীকৃত। মেরুকরণের স্বার্থে বিজেপির শরিয়ত আইন নিয়ে যত আপত্তি। কিন্তু ভোটের স্বার্থে জনজাতির বহুবিবাহ প্রথায় সমস্যা নেই। জনজাতিদের মধ্যে বহুবিবাহ কেন জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে উৎসাহ দেয় না, সেখানে কেন নারীর অধিকার চিন্তার বিষয় নয়, এইসব প্রশ্নের উত্তর আপাতত নেই।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved