জ্যোতির ঘরের দরজা বন্ধ। সে বন্ধ দরজার সামনে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়াল। দূর থেকে সন্ধ্যাশাঁখের শব্দ ভেসে আসছে। এই সময়ে তো জ্যোতি সঙ্গীতচর্চা করে। কিংবা ছাদে পায়চারি। জ্ঞানদার বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। কাদম্বরী কি ঘরে? না কি, সে তার পুতুলের ঘরে, রবির সঙ্গে?
২৫.
জ্যোতিরিন্দ্রর বিয়ের পর্ব চুকেছে, বেশ কিছুদিন হল। এবং এই ঘটনার পর থেকে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির রূপও যেন ভিতর থেকে বদলে যাচ্ছে। দেখা দিচ্ছে কিছু অপ্রত্যাশিত এবং অনস্বীকার্য অন্তরস্রোত। মূল যে পরিবর্তনটি চোখে পড়ার মতো, তা হল জ্ঞানদানন্দিনীর নতুন রূপ। তিনি ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, জোড়াসাঁকোর বাড়ির হর্তা-কর্তা-বিধাতা হয়তো এখনও বাবামশায় দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কিন্তু এই বাড়ির অন্দরমহলে তাঁর আধিপত্যও কিছু কম নয়।
জ্ঞানদার জীবনে হঠাৎ এক ট্রাজেডিই হয়তো তাঁকে আকস্মিক এমন উচ্চকিত করে তুলেছে, ব্যবহারে, মুখের ভাষায়, এবং ব্যক্তিত্বের প্রকাশে। ট্রাজেডিটি হল, জ্ঞানদা প্রথম মা হল একটি মৃত সন্তান প্রসব করে!
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে প্রায় কোনওদিনই আঁতুড় ঘর খালি যায় না। প্রতিদিন ওই অন্ধকার কুৎসিত ঘরটার মধ্যে কেউ না কেউ জন্মাচ্ছে। বা জন্মে জীবনের প্রথম ক’টাদিন একঘরে হয়ে কাটাচ্ছে। জ্ঞানদার মৃত সন্তান প্রসব এ-বাড়িতে কোনও সমবেদনার জন্ম দিল না। খবরটা আঁতুড় ঘরের চৌকাঠ পর্যন্ত পৌছনোর আগেই মরে গেল। দাসীরা ছাড়া আঁতুড় ঘরে জ্ঞানদা দেখা পেল না কোনও সমব্যথীর। এক দাসীর হাতে জ্ঞানদার হাতে এল সন্ধ্যাবেলায় একটি চিরকুট– ‘ভেবে নাও সর্বদা তোমার সঙ্গে আছি। তোমার জ্যোতি।’ আঁতুড় ঘর থেকে বেরিয়ে জ্ঞানদা তার বিষণ্ণ, বিপন্ন অসহায় একাকিত্বের কান্নার সবটুকু কাঁদল নতুনের বুকে, নিবিড় সমব্যথী বেদনার মধ্যে। জ্ঞানদার মনে হল, নতুনের ওই আলিঙ্গন কোনও প্রাগৈতিহাসিক গুহার মতো, আদিম উত্তাপে অনন্য, অকুণ্ঠ!
কিছুদিনের মধ্যেই একটা অদ্ভুত চিঠি এল জ্ঞানদার হাতে। পত্রের লেখক তার স্বামী, সত্যেন্দ্র। সত্যেন্দ্র বোম্বাই থেকে লিখেছে, ‘তুমি যে অন্য বাড়িতে থাকিবার ইচ্ছা করিতেছ, তাহা হইতে পারিলে তো মন্দ নয়– কিন্তু তুমি একলাটি গিয়া কী করিয়া এক পৃথক বাড়িতে থাকিবে? বাবামহাশয় তোমার জন্য কলিকাতার বাড়িতে আসিবেন না, কে বলিল? তোমার প্রতি তজ্জন্য লোকের বিরক্ত হইবার কোনও কারণ নাই।’
জ্ঞানদা চিঠির এই অংশটি দু’-তিনবার পড়ল। এবং ক্রমশ বুঝতে পারল, সত্যেন্দ্রর পক্ষে তার অন্তরের ব্যথা, অভিমান, নিঃসঙ্গতা, কিছুই বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। সত্যেন্দ্রর কেন মনে হচ্ছে না, জ্ঞানদাকে তার কর্মস্থানে নিয়ে যাওয়ার কথা? একবার ডাক দিলে নতুনকে সঙ্গে নিয়ে সে তো সেখানে গিয়েই থাকতে পারে। তারপরেই জ্ঞানদার মনে হল, জ্যোতি তো বিবাহিত। জ্যোতিকে সঙ্গে নিলে তার ন’বছরের বউটিকেও তো সঙ্গে নিতে হবে। হঠাৎ এক ঝাঁক অভিমান উড়ে এল জ্ঞানদার বুকের মধ্যে। সে মনে মনে ভাবল, তার স্বামী যদি সত্যিই তাকে ডাকে, সে একলাই চলে যাবে। জ্যোতিকে ছেড়ে থাকতে তার যত কষ্টই হোক। জ্ঞানদা সত্যেন্দ্রর কাছ থেকে এই চিঠি পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই এক চরম ঘটনা ঘটল!
খবরটা জানা মাত্র জ্ঞানদা ঝড়ের মতো ছুটে গেল জ্যোতির ঘরে। জ্যোতির ঘরের দরজা বন্ধ। সে বন্ধ দরজার সামনে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়াল। দূর থেকে সন্ধ্যাশাঁখের শব্দ ভেসে আসছে। এই সময়ে তো জ্যোতি সঙ্গীতচর্চা করে। কিংবা ছাদে পায়চারি। জ্ঞানদার বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। কাদম্বরী কি ঘরে? না কি, সে তার পুতুলের ঘরে, রবির সঙ্গে?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
জ্ঞানদা চিঠির এই অংশটি দু’-তিনবার পড়ল। এবং ক্রমশ বুঝতে পারল, সত্যেন্দ্রর পক্ষে তার অন্তরের ব্যথা, অভিমান, নিঃসঙ্গতা, কিছুই বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। সত্যেন্দ্রর কেন মনে হচ্ছে না, জ্ঞানদাকে তার কর্মস্থানে নিয়ে যাওয়ার কথা? একবার ডাক দিলে নতুনকে সঙ্গে নিয়ে সে তো সেখানে গিয়েই থাকতে পারে। তারপরেই জ্ঞানদার মনে হল, জ্যোতি তো বিবাহিত। জ্যোতিকে সঙ্গে নিলে তার ন’বছরের বউটিকেও তো সঙ্গে নিতে হবে। হঠাৎ এক ঝাঁক অভিমান উড়ে এল জ্ঞানদার বুকের মধ্যে। সে মনে মনে ভাবল, তার স্বামী যদি সত্যিই তাকে ডাকে, সে একলাই চলে যাবে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
দরজায় ঠুকঠুক শব্দ করে জ্ঞানদা। ভিতর থেকে কোনও সাড়া নেই। আবার ঠুকঠুক শব্দ করে জ্ঞানদা বন্ধ দরজার গায়ে। কোনও সাড়াশব্দ নেই।
–নতুন, বেশ জোরেই ডাকে জ্ঞানদা।
–একটু দাঁড়াও, আসছি, জ্ঞানদার মনে হয় কেমন যেন ঘোরের মধ্যে আছে জ্যোতি।
জ্ঞানদার কান্না পায়। হঠাৎ তার বুকের মধ্যে হু-হু করে ওঠে একাভাব। কী জ্বালা! কী অসহ্য কষ্ট! জ্যোতিরিন্দ্র দরজা খোলে! জ্ঞানদার মনে হয়, জ্যোতি নিজের মধ্যে নেই।
–এসো, জ্যোতি ডাক দেয় ভিতরে।
জ্ঞানদা মুহূর্তে জ্যোতির ঘরে ঢোকে। তার চোখ খোঁজে কাদম্বরীকে। কিন্তু ঘর ফাঁকা। লেখার টেবিলে জ্যোতির খোলা কলম খাতার উপর রাখা। টেবিলে ছড়ানো বই।
–তুমি লিখছিলে?
–হ্যাঁ ডুবে ছিলাম, একটা ফরাসি ভ্রমণকাহিনি বাংলায় অনুবাদ করছি।
হঠাৎ যেন জ্ঞানদার বুকের মধ্যে দপ করে নিভে যায় সেই হু-হু একাভাব! খুশির বাতাসে নিভে যায় সব জ্বালা-যন্ত্রণা। জ্ঞানদা আনন্দে জড়িয়ে ধরে জ্যোতিকে। তারপর তার বুকে মুখ গুঁজে কাঁপতে থাকে। কিছুতেই সেই কম্পন থামতে চায় না।
–কী যে করো তুমি, হঠাৎ কী হল, মেজবউঠানকে বুক থেকে আলগা করে দরজাটা ভেজিয়ে দেয় জ্যোতি।
তারপর জ্ঞানদার হাত ধরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় বসায়। একটু ধাতস্থ হও। তারপর বলো, কী এমন ঘটল!
–বাবামশায় এ-বাড়ি ত্যাগ করেছেন, তুমি কী জানো নতুন!
–বাবামশায় যে এই কাজটা করতে চলেছেন, আন্দাজ করতে পেরেছিলুম। কিন্তু সেজন্য তোমার এমন উত্তেজনা, দিশাহারা ভাব কেন?
–আমার খুব একা লাগছে নতুন। এবং অসহায় লাগছে। যেন কোনও বন্ধু নেই আমার।
জ্ঞানদা নীরবে তাকায় জ্যোতির দিকে। তার গাল বেয়ে নামে কান্নাধারা।
–বাবামশায় বাড়ি ছাড়লেন বলে তুমি এইভাবে কাঁদছ বউঠান! আর বাবামশায়ের বাড়ি ছাড়ার কারণ নাকি তুমি! বাবামশায়কে তোমার এই কান্নাটা যদি দেখাতে পারতাম!
–আমি বাবামশায়ের জন্য কাঁদছি না নতুন! আমার ভেতরটা হু-হু করছে। আমি নিজেকে সামলাতে পারছি না। তুমি না হয় লেখাপড়ার মধ্যে ডুবে আছ। আমি কী নিয়ে থাকব বলো। তার উপর বাবামশায় যে বাড়ি থেকে বিদায় নেবার জন্য পার্কস্ট্রিটে বাড়ি নিয়েছেন, সে খবর তো আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। আর সব্বার চোখ আমার দিকে। সেই দৃষ্টিতে তিরস্কার, ধিক্কার ছাড়া কিছু নেই। আমার দোষটা কোথায় বলো তো?
বাবামশায়কে তুমি খুব একটা গভীর জায়গায় চ্যালেঞ্জ করেছ। মেজবউঠান, তুমি হয়তো না জেনেই বিদ্রোহিনী!
–কীভাবে? কোথায় দেখলে আমার বিদ্রোহ?
–তুমি চাওনি শ্যামলালের মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে হোক।
–না চাইনি। কিন্তু সে তো তোমার মেজদাদাও চায়নি।
–মেজদাদা পুরুষমানুষ। তবু বাবামশায়ের মুখের ওপর ‘না’ বলতে পারেনি। আর আমি তো প্রতিবাদের কোনও সাহসই দেখাতে পারিনি। মাথা নীচু করে সব মেনে নিয়েছি। বাবামশায়ের কাছে তোমার অন্য মত অপমানকর মনে হয়েছে। তাছাড়া…
–তাছাড়া?
–বাবামশায় তোমার আমার সম্পর্কটা কোন পথে যাচ্ছে, সেটুকু বুঝতে পারেননি, তা নয়।
–কী বলছ তুমি ঠাকুরপো?
–একটা কথা জানবে, বাবামশায়ের সঙ্গে এ-বাড়ির দেয়ালও কথা বলে। কিছুই গোপন থাকে না।
– এই কারণে বাবামশায় জোড়াসাঁকোর পাট উঠিয়ে পার্কস্ট্রিটে চললেন?
–তোমার-আমার সম্পর্ক একটা কারণ। আরও অনেক কারণই থাকতে পারে।
–যেমন?
–বাবামশায় তো আজকাল কলকাতায় থাকেনই না। থাকেন হিমালয়ের অজ্ঞাতবাসে। অথচ সমস্ত খবর ঠিক পৌঁছে যায় তাঁর কাছে। জোড়াসাঁকোর বাড়ির প্রতি বাবামশায়ের আর টান নেই। তাছাড়া তিনি জানেন, তাঁকে সবাই ভয় পায়। ভালবাসে ক’জন?
–মা?
–মা-র সঙ্গে বাবামশায়ের কোনও সম্পর্ক আছে বলে তোমার মনে হয় বউঠান? মা-র সঙ্গে এ-বাড়ির কারও কোনও সম্পর্ক আছে? থাকা সম্ভব?
–সত্যি নতুন, এত বড় একটা সংসার, রান্নাঘরে গেলে বোঝা যায় নিত্যি কতগুলো মানুষের পাত পড়চে! কিন্তু ভালোবাসা বলে কি কিছু আছে? এমনকী সমব্যথা, দয়ামায়া, করুণা? এসবও কি আছে?
–কেন, তোমার আমার মধ্যে ভালোবাসা নেই মেজবউঠান? জ্যোতিরিন্দ্রর এই প্রশ্নের সামনে চমকে ওঠে জ্ঞানদা। তার মুখে কোনও কথা নেই।
–মেজবউঠান, আরও একটি জায়গায় ভালোবাসা জন্মেছে, এই বাড়িতেই, সত্যিকারের ভালোবাসা।
–কোথায় গো? জ্ঞানদা অবাক।
–যাও না কাদম্বরীর পুতুলের ঘরে। সেখানে দেখবে কাদম্বরী আর রবি সংসার পেতেছে। ভালোবাসার ডলস হাউস!
(চলবে)
…মেজবউঠাকরুণ-এর অন্যান্য পর্ব…
মেজবউঠাকরুণ ২৪: কাদম্বরীকে ‘নতুন বউঠান’ বলে উঠল সাত বছরের রবি
মেজবউঠাকরুণ ২৩: ঠাকুরপো, তোমাকে সারা বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছি, আর তুমি ছাদে একা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে!
মেজবউঠাকরুণ ২২: কাল থেকে আমিও রবির মতো একা হয়ে যাব না তো ঠাকুরপো?
মেজবউঠাকরুণ ২১: জ্ঞানদার মধ্যে ফুটে উঠেছে তীব্র ঈর্ষা!
মেজবউঠাকরুণ ২০: স্বামী সম্বন্ধে জ্ঞানদার মনের ভিতর থেকে উঠে এল একটি শব্দ: অপদার্থ
মেজবউঠাকরুণ ১৯: কাদম্বরী ঠাকুরবাড়িতে তোলপাড় নিয়ে আসছে
মেজবউঠাকরুণ ১৮: নতুনকে কি বিলেত পাঠানো হচ্ছে?
মেজবউঠাকরুণ ১৭: চাঁদের আলো ছাড়া পরনে পোশাক নেই কোনও
মেজবউঠাকরুণ ১৬: সত্যেন্দ্র ভাবছে জ্ঞানদার মনটি এ-বাড়ির কোন কারিগর তৈরি করছে
মেজবউঠাকরুণ ১৫: জ্ঞানদার কাছে ‘নতুন’ শব্দটা নতুন ঠাকুরপোর জন্যই পুরনো হবে না
মেজবউঠাকরুণ ১৪: জ্যোতিরিন্দ্রর মোম-শরীরের আলোয় মিশেছে বুদ্ধির দীপ্তি, নতুন ঠাকুরপোর আবছা প্রেমে আচ্ছন্ন জ্ঞানদা
মেজবউঠাকরুণ ১৩: বিলেতে মেয়েদের গায়ে কী মাখিয়ে দিতে, জ্ঞানদার প্রশ্ন সত্যেন্দ্রকে
মেজবউঠাকরুণ ১২: ঠাকুরবাড়ির দেওয়ালেরও কান আছে
মেজবউঠাকরুণ ১১: ঠাকুর পরিবারে গাঢ় হবে একমাত্র যাঁর দ্রোহের কণ্ঠ, তিনি জ্ঞানদানন্দিনী
মেজবউঠাকরুণ ১০: অসুস্থ হলেই এই ঠাকুরবাড়িতে নিজেকে একা লাগে জ্ঞানদানন্দিনীর
মেজবউঠাকরুণ ৯: রোজ সকালে বেহালা বাজিয়ে জ্ঞানদার ঘুম ভাঙান জ্যোতিঠাকুর
মেজবউঠাকরুণ ৮: অপ্রত্যাশিত অথচ অমোঘ পরিবর্তনের সে নিশ্চিত নায়িকা
মেজবউঠাকরুণ ৭: রবীন্দ্রনাথের মায়ের নিষ্ঠুরতা টের পেয়েছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী
মেজবউঠাকরুণ ৬: পেশোয়াজ অন্দরমহল আর বারমহলের মাঝখানের পাঁচিলটা ভেঙে দিল
মেজবউঠাকরুণ ৫: বাঙালি নারীশরীর যেন এই প্রথম পেল তার যোগ্য সম্মান
মেজবউঠাকরুণ ৪: বৈঠকখানায় দেখে এলেম নবজাগরণ
মেজবউঠাকরুণ ৩: চোদ্দোতম সন্তানকে কি ভুল আশীর্বাদ করলেন দেবেন্দ্রনাথ?
মেজবউঠাকরুণ ২: তোমার পিঠটা কি বিচ্ছিরি যে তুমি দেখাবে না বউঠান?
মেজবউঠাকরুণ ১: ঠাকুরবাড়ির বউ জ্ঞানদাকে ঘোমটা দিতে বারণ দেওর হেমেন্দ্রর