নানা মহার্ঘ্য উপকরণ দিয়ে রাজার রাঁধুনির দল দৈনিক শতেক রকমের নিত্য নতুন রান্না করে। মহারাজ তার স্বাদ ও গুণাগুণ বিচার করেন। অর্থাৎ, শুধু অর্থ নয়, খাওয়ার পেছনে তিনি বহু সময় ও মনোযোগ ব্যয় করেন। ফলে রাজকাজে প্রায়শই গাফিলতি ঘটে। বিরক্ত প্রজারা এমন আহার-বিলাসী রাজার নাম দিয়েছে ‘ভোজনশুদ্ধিক’– কর্তব্যের শুদ্ধতার চেয়ে তাঁর ভোজনের শুদ্ধতার প্রতি নজর বেশি।
২৫.
জাতক জন্ম সিঁড়ির মতো। ধাপে ধাপে নিষ্কলুষ বোধির উচ্চতায় পৌঁছনোর এক দীর্ঘ যাত্রাপথ। সেই পথে কিছু ভুল থাকবে, সীমাবদ্ধতা থাকবে। সেসব উত্তীর্ণ হওয়ার মধ্যে দিয়েই তো এই জন্ম জন্মান্তরের আরোহণ।
যেমন এবারের জন্মে বোধিসত্ত্ব এক প্রায় সর্বগুণান্বিত পুরুষ। বারাণসীরাজ ব্রহ্মদত্তের জ্যেষ্ঠ পুত্র হিসেবে তিনি যথাকালে সিংহাসন লাভ করলেন, তার আগে তক্ষশিলায় তাঁর নানা বিদ্যায় পারদর্শিতা অর্জন, শাসক হিসেবেও তিনি প্রজাদের আস্থাভাজন। তবু ওই যে ‘প্রায়’-এর কথা বললাম, সে তাঁর এক দুর্বলতার জন্য। খাওয়ায় তাঁর দুর্বলতা।
সাধারণ খাদ্যরসিক নন, তিনি অপরিমিত আহার করেন– শুধু পরিমাণের দিক থেকে নয়, অর্থব্যয়ের দিক থেকেও। প্রজারা বলাবলি করে, রাজার খাদ্যের জন্য নাকি রাজকোষ থেকে দৈনিক লক্ষ মুদ্রা ব্যয় হয়। নানা মহার্ঘ্য উপকরণ দিয়ে তাঁর রাঁধুনির দল দৈনিক শতেক রকমের নিত্য নতুন রান্না করে। মহারাজ তার স্বাদ ও গুণাগুণ বিচার করেন। অর্থাৎ, শুধু অর্থ নয়, খাওয়ার পেছনে তিনি বহু সময় ও মনোযোগ ব্যয় করেন। ফলে রাজকাজে প্রায়শই গাফিলতি ঘটে। বিরক্ত প্রজারা এমন আহার-বিলাসী রাজার নাম দিয়েছে ‘ভোজনশুদ্ধিক’– কর্তব্যের শুদ্ধতার চেয়ে তাঁর ভোজনের শুদ্ধতার প্রতি নজর বেশি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
রাজা যেখানে মহা আড়ম্বরে একশো রকমের চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় সাজিয়ে খেতে বসেছেন, লম্বা লম্বা পা ফেলে লোকটি বিনা বাধায় সটান সেখানে গিয়ে দাঁড়ালো। এবং তারপর বিনা বাক্য ব্যয়ে ডান হাত বাড়িয়ে সে রাজার থালা থেকে এক খাবলা ভাত তুলে মুখে পুরলো।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
তা একদিন দুপুরে রাজসভা মুলতুবি রেখে মহারাজ খেতে বসেছেন। বিচারপ্রার্থীদের ভিড় তখনও অনেকটাই। তাঁরা জানেন, রাজ-আহারের এই বিরতি অল্পে শেষ হওয়ার নয়। খাওয়ার নেশায় রাজা আদৌ আজ আর কাজে ফিরবেন কি না তারও স্থিরতা নেই। বহু ক্রোশ দূর থেকে আসা, খিদে-তেষ্টায় কাহিল প্রজাদের ধৈর্যে বাঁধ দিতে রাজকর্মচারীরা নানা প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
এমন সময় সমবেত নাগরিকদের ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন চেঁচিয়ে উঠল, পথ ছাড়ো, আমাকে এখনই মহারাজের সঙ্গে দেখা করতে হবে।
লোকটির উশকোখুশকো চুল, মলিন পোশাক, ধূলি ধূসরিত পা। গরমে, তেষ্টায় মাথা বিগড়ে গেল নাকি? কয়েকজন মজা করে বলল, কেন হে, তোমার কী রাজকার্য আছে?
সে কোমরে হাত দিয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে, উজ্জ্বল চোখদুটি মেলে বলল, আমি দূত।
তাই শুনে চমকে উঠে সকলে তাকে পথ ছেড়ে দিল।
দু’-একজন রাজকর্মচারী তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, মহারাজের ভোজন শেষ হলে দেখা করলে হয় না? ভিড়ের মধ্যে থেকে দু’-একজন মুখ লুকিয়ে টিপ্পনী কাটল, কোন মহারাজের দূত হে তুমি?
কিন্তু লোকটি কোনও কথাই কানে তোলে না। সে কেবল বলছে, খাওয়ার মাঝেই রাজার সঙ্গে আমায় দেখা করতে হবে।
বোধিসত্ত্বের কাছে খবর গেল। উচ্চশিক্ষিত রাজা বললেন, দূতকে আটকানো কূটনীতিতে অবিধেয়। নিয়ে এসো তাকে।
রাজা যেখানে মহা আড়ম্বরে একশো রকমের চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় সাজিয়ে খেতে বসেছেন, লম্বা লম্বা পা ফেলে লোকটি বিনা বাধায় সটান সেখানে গিয়ে দাঁড়ালো। এবং তারপর বিনা বাক্য ব্যয়ে ডান হাত বাড়িয়ে সে রাজার থালা থেকে এক খাবলা ভাত তুলে মুখে পুরলো।
রাজার দেহরক্ষীরা ঝনঝন শব্দে খাপ থেকে তরোয়াল বার করল।
রাজার ন্যায়-অন্যায় বোধ খুব সজাগ। তিনি চোখের ইশারায় তাদের নিরস্ত করলেন: দূত অবধ্য।
রাজা এবং তাঁর সশস্ত্র সেপাইরা কিছুটা বিস্মিত, কিছুটা বিব্রত চোখে দেখল, দূত হিসেবে আত্মপরিচয় দেওয়া লোকটি একবার এই থালা থেকে, আবার ওই বাটি থেকে, তারপর সেই পিরিচ থেকে নানা খাদ্য পানীয় গলাধঃকরণ করছে।
বেশ অনেকটা খেয়ে নেওয়ার পর আঙুল চাটতে চাটতে লোকটি নিরুদ্বিগ্ন চোখে এবার সরাসরি রাজার দিকে চাইল।
রাজা একটু ইতস্তত করে বললেন, মহাশয়, আপনি কোথাকার দূত?
উদরের।
লোকটির সংক্ষিপ্ত, সপাট উত্তর শুনে রাজার ভুরু কুঁচকে গেল, সেটি কোন দেশ? কে বা কারা আপনাকে পাঠিয়েছেন?
আমি এই পেটের দূত, লোকটি তার আপাতত সন্তুষ্ট উদরের ওপর হাত দুটো রেখে বলে, ক্ষুধা আর তৃষ্ণা আমায় পাঠিয়েছে।
দীর্ঘ জ্ঞানচর্চা রাজাকে মেধাবী করেছে, মরমী করেছে। তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তারপর লোকটির দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললেন, আপনি আমার চোখ খুলে দিলেন। আমি নিজেকে সংশোধন করে নিচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রীকে বললেন, আজকের সব রান্না গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে বলুন; আর চলুন, রাজসভায় যাই, অনেক কাজ বাকি পড়ে আছে।
* * * * * *
আমিও বললাম সম্পাদকমশাইকে, এবার বরং থামি, অনেক কাজ বাকি পড়ে আছে। এমন সাপ্তাহিক কলাম লেখার অভিজ্ঞতা আমার এই প্রথম। আমার ওপর ভরসা রাখার জন্য পত্রিকা কর্তৃপক্ষকে কৃতজ্ঞতা। আপনারা–পাঠিকা-পাঠকরা, যাঁরা নিয়মিত উৎসাহ দিয়ে গেছেন তাঁদের কাছে আমি ঋণী। আর একজনের কথা বলি। মূল জাতক কাহিনির আদি অনুবাদক ঈশানচন্দ্র ঘোষের মহার্ঘ্য বইটি সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন বেলুড় বিদ্যামন্দির মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ স্বামী মহাপ্রজ্ঞানন্দজী। তাঁকে প্রণাম।
আমার এই অর্ধ বছর ব্যাপী জাতক যাপন আমাকে এক অন্য রকম গদ্য আয়ত্ত্ব করার সুযোগ দিয়েছে। দিয়েছে অদ্যাবধি অপরিচিত এক পড়ুয়া গোষ্ঠী। এই চর্চা থেকে আর কিছু নিতে পেরেছি কি না– কোনও পারমার্থিক সম্পদ অর্জন হল কি না, তা হয়তো পরে বুঝতে পারব। আপাতত এগিয়ে চলি।
বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি।
(দূত জাতক)
………………………………………………………………………………….. সমাপ্ত ……………………………………………………………………………….
…নব জাতক-এর অন্যান্য পর্ব…
নব জাতক পর্ব ২৪: দিনের পর দিন, মাসের পর মাস বিচারসভা ফাঁকা, প্রজা সুখে রয়েছে না আস্থা হারাচ্ছে– রাজা বিচলিত
নব জাতক পর্ব ২৩: দুষ্টসঙ্গে অপরিণামদর্শী হয়ে মানুষ কেমন নিজের ধ্বংস নিজেই নিয়ে আসে
নব জাতক পর্ব ২২: এই জন্মে বোধিসত্ত্ব এক লোভের ফাঁদে পা দিলেন
নব জাতক পর্ব ২১: গাছতলায় শুয়ে রাত কাটাতে হল সারীপুত্রের মতো সম্মাননীয় শ্রমণকেও
নব জাতক পর্ব ২০: আফসোস যে শ্রেষ্ঠী-বালিকার পরিচয় অজ্ঞাত থেকে গেল
নব জাতক পর্ব ১৯: ছদ্মবেশে প্রজার সুখ দেখতে বেরিয়ে লজ্জিত হয়ে পড়লেন রাজা
নব জাতক পর্ব ১৮: ব্রাহ্মণের সন্তান হলেই ব্রাহ্মণ হওয়া যায় না
নব জাতক পর্ব ১৭: এত ছোট চারাই যদি এমন হয়, বড় বৃক্ষ হলে না জানি কেমন বিষাক্ত হবে
নব জাতক পর্ব ১৬: প্রকৃত চরিত্রবানের পিছনে তলোয়ারের আতঙ্ক রাখার দরকার হয় না
নব জাতক পর্ব ১৫: নেপথ্য থেকে যে নেতৃত্ব দেয়, তাকে অস্বীকার করা যায় না
নব জাতক পর্ব ১৪: প্রাণীহত্যার মতো নির্মম আয়োজনে দেবতার সন্তুষ্টি হয় কী করে!
নব জাতক পর্ব ১৩: এক হাজার দস্যুর লাশ আর রত্ন পেটিকা
নব জাতক পর্ব ১২: সীতা যখন রামের বোন, দিতে হয়নি অগ্নিপরীক্ষাও
নব জাতক পর্ব ১১: শাসকের পৃষ্ঠপোষকতায় কোনও সন্ত্রাসবাদীকে সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনা সে-ই বোধহয় প্রথম
নব জাতক পর্ব ১০: নিকটজনের অন্যায্য আবদারে রাজধর্মে বিচ্যুত হওয়া যায় না
নব জাতক পর্ব ৯: লকলকে লোভের আগুনে সদুপদেশ খাক হয়ে যায়
নব জাতক পর্ব ৮: যেখানে মৃত্যু প্রবেশ করতে পারে না, শুধু জীবনের জয়গান
নব জাতক পর্ব ৭: অভয় সরোবর সত্ত্বেও কেন ব্যাধ ফাঁদ পেতেছিল সুবর্ণহংসের জন্য?
নব জাতক পর্ব ৬: জন্ম-জন্মান্তরের বিষয়-আকাঙ্ক্ষা যখন হেলাফেলা করা যায়
নব জাতক পর্ব ৫: পলাশ গাছ ছায়া দিত কালো সিংহকে, তবু তারা শত্রু হয়ে গেল
নব জাতক পর্ব ৪: দৃষ্টি ক্ষীণ হলেও, অন্তর্দৃষ্টি প্রবলভাবে সজাগ
নব জাতক পর্ব ৩: শূকরের তাকানোয় বাঘের বুক দুরুদুরু!
নব জাতক পর্ব ২: আরও আরও জয়ের তৃষ্ণা যেভাবে গ্রাস করে অস্তিত্বকে
নব জাতক পর্ব ১: খিদে মেটার পরও কেন ধানের শীষ নিয়ে যেত পাখিটি?