প্রথাগত ক্রিকেট-শিক্ষা বলতে যা বোঝায়, আকাশ দীপের তা ছিল না। কোনও কোচিং সেন্টারে, কোনও কোচের তত্ত্বাবধানে ও ক্রিকেট শেখেনি। ওর এক কাকা আছে আসানসোলে, তাঁর হাত ধরেই ওর কলকাতায় আসা। সেটাও ক্রিকেটের টানেই। ছোটবেলা থেকেই টেনিস-বল ক্রিকেটটা আকাশ দীপ ভালো খেলত। এমনকী টেনিস বলের টুর্নামেন্ট খেলতে ও দুবাইতেও গিয়েছে। ক্রিকেটের হাত ধরে সেটাই ওর প্রথম বিদেশ সফর।
কিছু কিছু আনন্দের মুহূর্ত থাকে, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আকাশ দীপের ভারতীয় টেস্ট টিমে চান্স পাওয়ার খবরটাও আমার কাছে তেমনই। ছেলেটাকে তো আজকে নয়, চিনি অনেক দিন ধরেই। তাই ভারতীয় টেস্ট টিমে সুযোগ পাওয়ায় ও যত খুশি, ততটাই খুশি হয়েছি আমিও।
বাংলার হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে খেললেও আকাশ দীপ সেই অর্থে ‘বাংলার ছেলে’ নয়। ওর বাড়ি বিহারের সাসারামে। গরিব ঘর থেকে উঠে আসা। আর সেই উঠে আসাটা একপ্রকার উল্কাগতিতেই। প্রথাগত ক্রিকেট-শিক্ষা বলতে যা বোঝায়, আকাশ দীপের তা ছিল না। কোনও কোচিং সেন্টারে, কোনও কোচের তত্ত্বাবধানে ও ক্রিকেট শেখেনি। ওর এক কাকা আছে আসানসোলে, তাঁর হাত ধরেই ওর কলকাতায় আসা। সেটাও ক্রিকেটের টানেই। ছোটবেলা থেকেই টেনিস-বল ক্রিকেটটা আকাশ দীপ ভালো খেলত। এমনকী, টেনিস বলের টুর্নামেন্ট খেলতে ও দুবাইতেও গিয়েছে। ক্রিকেটের হাত ধরে সেটাই ওর প্রথম বিদেশ সফর।
জানি, জানতে চাইবেন আকাশ দীপের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হল কীভাবে? গল্পটা বলেই ফেলি। কলকাতায় ইউনাইটেড বলে একটা ক্লাব আছে, বছর কয়েক আগে কলকাতায় এসে ও ওখানেই যোগ দেয়। আকাশ দীপ যখন ইউনাইটেডে খেলছে, সেবারই প্রথম আমি বাংলার অনূর্ধ্ব-২৩-এর কোচ হই। সেই প্রথম আমারও কোচিংয়ে আসা। ফলে ‘কিছু একটা করতে হবে’, এই বাড়তি উদ্দীপনা আমার মধ্যেও কাজ করছিল। বলে রাখা ভালো, তার আগে অনূর্ধ্ব-২৩ পর্যায়ে বাংলার ফলাফল মোটেই আশানুরূপ ছিল না। সেই খারাপ সময় কাটিয়ে বাংলাকে সাফল্য এনে দিতে আমিও মরিয়া ছিলাম।
নতুনভাবে দল গড়ার ভাবনা তখন মনের মধ্যে কাজ করছে। টিমে একটা ভালো মানের জোরে-বোলারের খোঁজ করছি। তখন একজন আমাকে বলে, আকাশ দীপ বলে একটা ছেলে আছে। দারুণ বল করে। ভালো পেস আছে ছেলেটার। বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যানদেরও ও দারুণ বেগ দিয়েছে। একবার দেখবে নাকি? এসব শুনে ‘কে আকাশ দীপ, কোথাকার ছেলে’, কৌতূহলগুলো মাথাচাড়া দিল। ওর সম্পর্কে বিশদে খোঁজখবর নিলাম। জানতে পারলাম, ক্রিকেট শুধু ওর ধ্যানজ্ঞান নয়, রুজি-রোজগারও। ছোটবেলা থেকে অনেক কষ্টের মধ্য দিয়ে ওকে যেতে হয়েছে। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত সয়ে ওকে এই জায়গায় আসতে হয়েছে। আকাশের বাবার ইচ্ছা ছিল, ছেলে ক্রিকেটে সময় ‘অপচয়’ না করে চাকরি-বাকরি খুঁজুক। কিন্তু ছেলেটার এমন দুর্ভাগ্য, প্রথমে ওর বাবা মারা গেল। ছয় মাসের মধ্যে হারাল বড় দাদাকেও। তারপর পুরো পরিবারটার দায়-দায়িত্ব এসে পড়ল ছেলেটার কাঁধে। হাসিখুশি মুখ, নম্র-ভদ্র ছেলে। দেখে বোঝা মুশকিল মনের মধ্যে কতটা ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে। ঘরে দুই বোন আছে। মা আছে। পুরো সংসার দাঁড়িয়ে ওর রোজগারের ওপর। সংসারের কথা ভেবেই দুর্গাপুর, আসানসোলে পাড়া টুর্নামেন্টগুলোয় টেনিস-বল ক্রিকেট খেলত। সেখান থেকে কলকাতায়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আকাশের বাবার ইচ্ছা ছিল, ছেলে ক্রিকেটে সময় ‘অপচয়’ না করে চাকরি-বাকরি খুঁজুক। কিন্তু ছেলেটার এমন দুর্ভাগ্য, প্রথমে ওর বাবা মারা গেল। ছয় মাসের মধ্যে হারাল বড় দাদাকেও। তারপর পুরো পরিবারটার দায়-দায়িত্ব এসে পড়ল ছেলেটার কাঁধে। হাসিখুশি মুখ, নম্র-ভদ্র ছেলে। দেখে বোঝা মুশকিল মনের মধ্যে কতটা ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে। ঘরে দুই বোন আছে। মা আছে। পুরো সংসার দাঁড়িয়ে ওর রোজগারের ওপর। সংসারের কথা ভেবেই দুর্গাপুর, আসানসোলে পাড়া টুর্নামেন্টগুলোয় টেনিস-বল ক্রিকেট খেলত। সেখান থেকে কলকাতায়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
যাই হোক, খোঁজখবর নিয়ে বাংলার অনূর্ধ্ব-২৩-এর ট্রায়ালে ডাকলাম। সেখানে দেখেই বুঝলাম, ছেলেটা ‘র-মেটেরিয়াল’। একটু ঘষামাজা করলে হিরের মতো জ্বলজ্বল করবে। ক্রিকেটের ইনডোর, আউটডোর– এসবের কোনও জ্ঞান আকাশ দীপের ছিল না। শুধু জানত, বল করতে হবে। অপনেন্টের উইকেট নিতে হবে। ব্যস, এটুকুই।
ইনডোরে প্রথমদিনের ট্রায়ালে ও তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। লম্বা হাইট। স্মুথ বোলিং অ্যাকশন। এত জোরে বল করছিল, কেউ ব্যাট ছোঁয়াতে পারছিল না। মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম প্রথম দিনে। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম সেদিনই– একে আমার চাই। সমস্যা একটাই, আকাশ কোনও সিস্টেমের মধ্যে দিয়ে উঠে আসেনি। ওর ব্যাকগ্রাউন্ড আমরা জানতাম না। এর আগে অনূর্ধ্ব-১৬, কিংবা অনূর্ধ্ব-১৯ খেলেনি। এক্কেবারে সরাসরি উঠে আসা, আচমকাই।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: সাধারণের সরণিতে না হাঁটলে অসাধারণ হতে পারতেন না উৎপল
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সবকিছুই ঠিকঠাক এগোচ্ছিল। কিন্তু বিধি বাম! ছেলেটা সেবারই চোট পেল কোমরে। স্ট্রেস ফ্র্যাকচার। রিহ্যাবে থাকলে সেরে উঠবে, তাই টেনশন না করে ওকে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম ফিজিও-র তত্ত্বাবধানে। কিন্তু এর মধ্যেই একদিন একটা বিশ্রী ঘটনা ঘটল। কল্যাণীতে বাংলার ট্রায়াল ম্যাচ ছিল, অনূর্ধ্ব-২৩-এর। আমি গিয়েছিলাম। আকাশ দীপও ছিল। সেখানে কয়েকজনের ‘পরামর্শ’-এ বল করতে গিয়ে ওর চোট আরও বেড়ে যায়। সব শুনে আমার তো মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার জোগাড়। একেই আনকোরা, তার ওপর চোটগ্রস্ত। এসব শুনলে ওকে টিম-সিলেকশনে দলে রাখা মুশকিল হবে। হলও তাই। বেঙ্গালুরু-তে টিম নিয়ে যাওয়ার কথা। সিলেকশন কমিটির বৈঠকে ঝড় উঠল। আকাশ দীপের প্রসঙ্গ তুলে বললাম, একদম ‘র-ট্যালেন্ট’, নতুন এসেছে। তবে ইনজুরি আছে। আমি ওকে টিমের সঙ্গে চাই। রিহ্যাবে থাকবে টিমের সঙ্গে। শুনে অনেকেই বেঁকে বসল। আমিও অনড়। আকাশ দীপকে আমার চাই। সেইসময় আমার সমর্থনে এগিয়ে এসেছিল দাদি– সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। আর অভিষেক ডালমিয়া। দু’জনেই বলেছিল– প্যাটসি যখন চাইছে, ও টিমে থাকুক। ব্যস, আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি ওকে।
তবে বেঙ্গালুরুতে ও খেলেনি। খেলেছিল পরের ভাইজ্যাক টুরে। প্রি-সিজনের জন্য গিয়েছিল বাংলার অনূর্ধ্ব-২৩ টিম। দারদলের টুর্নামেন্ট ছিল, অংশ নিয়েছিল অন্ধ্র, মুম্বই, হিমাচল প্রদেশের মতো টিম। আকাশকে প্রথম দু’ম্যাচে খেলাইনি। খেলিয়েছিলাম মুম্বই ম্যাচে। রেজাল্ট? প্রথম সেই ম্যাচে বাংলার হয়ে খেলতে নেমেই পাঁচ উইকেট নিয়েছিল। ব্যাটে করেছিল ৫০-৫৫ রান। বিপক্ষকে একাই তছনছ করে দিয়েছিল। তারপর সৈয়দ মুস্তাক আলি টি-টোয়েন্টিতে (টুর্নামেন্টে) সিনিয়র টিমে ডাক পায় আকাশ দীপ। তখন কোচ ছিলেন অরুণলাল। প্রথম দু’ম্যাচে চার উইকেট পায়। সেখান থেকে ওর সাফল্যের জয়যাত্রা শুরু। বাংলার হয়ে রনজি কিংবা বিজয় হাজারে সব জায়গায় ওর পারফরম্যান্স নজরকাড়া। ইডেনে গুজরাতের বিরুদ্ধে ৬ উইকেট শিকার এখনও চোখের সামনে ভাসে। বাংলাকে রনজির ফাইনালে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বড় অবদান রেখেছে। আসলে প্রথম দিন থেকে ওর মধ্যে শেখার ইচ্ছা, জেতার খিদেটা ছিল। সেটাই ওকে ক্রমাগত উন্নতিতে সাহায্য করেছে। ভারতীয় ‘এ’ দলে সুযোগ পাওয়াটা ওর দীর্ঘ পরিশ্রমের ফল। আইপিএলে সুযোগ পাওয়াটাও বড় প্রাপ্তি। সেই অভিজ্ঞতা ওকে আরও পরিণত হতে সাহায্য করেছে। এত কিছুর মধ্যেও ফোকাস হারায়নি। নিজের লক্ষ্যে স্থির ছিল। তাই ফাইনালি আজ ও ভারতীয় টেস্ট টিমের শরিক।
কোচ হিসেবে ওর উত্থানটা চোখের সামনে দেখেছি। মানুষ হিসেবেও। সৎ ছেলে। বাংলাকে মন দিয়ে ভালোবাসে। মুকেশের (কুমার) পর আরও একটা বাংলার ছেলে ভারতীয় ড্রেসিংরুমে। কোচ হিসেবে ভালো লাগা তো আছেই। তবে এখানেই শেষ নয়। ওকে আরও অনেকদূর যেতে হবে। ভারতীয় দলের জার্সিতে নিজেকে প্রমাণ করতে হবে।
আমার বিশ্বাস, আকাশ দীপ পারবে। সেই আগুনটা আমি ওর মধ্যে দেখেছি।
১৯৩৭ সালে পিল কমিশন প্যালেস্তাইনে ধর্মের ভিত্তিতে ভূখণ্ড ভাগের প্রস্তাব দেয়। এটাও ভারতের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে গান্ধীজির পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব ছিল। কারণ এদেশেও তখন ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ অর্থাৎ ‘টু নেশন’ তত্ত্ব ধীরে ধীরে দানা বাঁধছে।