ছোটবেলায় ছবি দেখেই কাশীধামে যাওয়ার কথা ভেবেছিলেন ম্যাক্সমুলার সাহেব
Published by: Robbar Digital
Posted on: February 18, 2024 9:25 pm
Updated: February 19, 2024 11:33 am
কাশীতে প্রচলিত এক ‘কহাবত’ হল, ‘হর কঙ্করমে শঙ্কর’, সত্যিকথা বলতে কি কাশীতে শিবের মন্দির যে কত তার ইয়ত্তা নেই। শুধু কি শিব, আরও কত না দেবদেবীর মূর্তি, মন্দির তার গোনাগুণতি নেই। চলতি কথায় বলা হয়ে থাকে বার্ধক্যে বারাণসী, কিন্তু বারাণসীর পুণ্যতীর্থে নিত্য আসা যাওয়া করেন নানা বয়সের, নানা অভিপ্রায়ে কত না মানুষ। শুরু হল কৌশিক দত্ত-র নতুন কলাম ‘তীর্থের ঝাঁক’। আজ প্রথম পর্ব।
কৌশিক দত্ত
১.
ঋগ্বেদ অনুযায়ী ‘তীর্থ’ শব্দের অর্থ অবতরণের ক্ষেত্র, এপার থেকে ও-পারে যাওয়ার ঘাট আর তার উদ্দেশ্যেই যাওয়া। কিন্তু সাধারণভাবে দেবস্থানে যাত্রাকেই তীর্থযাত্রা বোঝায়। দেব অনুগ্রহ লাভের অন্যতম উপায় হিসেবে ভারতীয়রা আত্মপীড়নকেই চিরকাল অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে এসেছেন। ফলে দেবস্থানে যাত্রার পথ মসৃণ বা সুগম্য হলে যেন দেবতার কৃপা খানিক কম হয়ে যায়, সেই বোধে কঠিন কৃচ্ছ্রসাধন করাই ছিল তীর্থযাত্রার সার্থকতা। দীর্ঘ পথ, তার দুর্মর, বিপদ সম্ভাবনাকে মাথায় নিয়েই কখনও একা, কখনও বা দল বেঁধে মানুষ তীর্থ যাত্রা করতেন। নদী, জঙ্গল, পাহাড়, বালিয়াড়ি ভেঙে কোনও এক নির্জনে দেব-সান্নিধ্যের আশে মানুষ ছুটে যেতেন, অনেক সময় আবার সেখানে পৌঁছে, অপার তৃপ্তি আর আনন্দ আতিশয্যে আত্মবিসর্জন দিতেন পর্বতশীর্ষ থেকে কিংবা সাগরের অতলে।
শ্রীচৈতন্যের জীবন ও তাঁর আধ্যাত্ম দর্শনের আবহে লেখা বইগুলিতে একাধিক্রমে যেমন জীবন-কথার বিস্তার ও দর্শনের কুজ্ঝটিকার সুলুক দেয়, তেমনই আছে তাঁর পরিব্রাজনের নানা কাহিনি। তবে সেখানে ভ্রমণ-প্রসঙ্গ গৌণ, তাই সেগুলিকে ভ্রমণ কাহিনি ভাবার বা তকমা দেওয়া ভ্রমাত্মক হবে। ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে জমিদার জয়কৃষ্ণ ঘোষালের পিতৃদেব কাশীধাম যাত্রার আয়োজন করলে, সে দলে ভিড়ে ছিলেন বিজয়রাম সেন নামের এক বৈদ্য, একাধারে তিনি কবিও। তাঁর লেখা ‘তীর্থমঙ্গল কাব্য’-কেই পণ্ডিতেরা বাংলায় প্রথম ভ্রমণকাহিনির শিরোপা দিয়েছেন। কাব্যটিতে বাংলা থেকে নদী পথে কাশীধাম যাত্রার কথা আছে, আছে নানা অঞ্চল থেকে জুটে যাওয়া নানা সম্প্রদায়ের তীর্থপর্যটক, আছে স্থান-বিবরণ, আর আছে এক গূঢ় রহস্যের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের ইঙ্গিতও।
দু’টি কথা মনে রাখতে হবে, তবেই স্পষ্ট হবে রাজনৈতিক অভিসন্ধির কথাখানি। প্রথমত, ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা, বিহার ওড়িশার দেওয়ানি লাভ করেছিল। ভেরলেস্ট সাহেব ছিলেন তার সর্বময় কর্তা, আর তাঁর প্রধানমন্ত্রী বা দেওয়ান ছিলেন গোকুলচন্দ্র ঘোষাল। দেশি কায়দাকানুন, রীতিনীতি, রাজস্ব আদায়ের কায়দাকানুন ছিল তাঁর নখদর্পণে, ঝানু প্রশাসক, কার্যত তিনিই ছিলেন আসল কর্তা। সেই গোকুলচন্দ্রের বড়দা ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র ঘোষাল। তিনি কাশী গিয়ে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠার সংকল্পে যাত্রার উদ্যোগ করলে গোকুলচন্দ্র কোম্পানির তরফে সেই যাত্রা সম্পর্কে অত্যন্ত উৎসাহী হয়ে ওঠেন। সদ্য প্রাপ্ত দেওয়ানি, দেশের বিশিষ্ট ও প্রতাপশালীদের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া, বা সাধারণ জনমানসেই বা কী ঘটে চলেছে, তার সম্পর্কে সরজমিন খোঁজতালাশই ছিল সেই গূঢ় রাজনৈতিক প্রণোদনা। যাত্রা শুরুর পর থেকেই ‘ঘাটে ঘাটে বড় বড় লোক আসি মিলিল তথায়’। আবার নানা নৌকায় ভিড়ও বাড়তে রইল পুণ্যকাতর যাত্রী দলের।
কাশীধামের অন্যতম পরিচয় এটি মুক্তিক্ষেত্র। স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেব প্রতিটি মৃত মানুষের কানে ‘তারকব্রহ্ম’ নাম শুনিয়ে মুক্তিদান করে থাকেন। আবার কথায় বলে, ‘অন্য ক্ষেত্রে কৃতং পাপং কাশীক্ষেত্রে বিনশ্যতি’। সেদিক থেকেও কাশীধাম মুক্তিক্ষেত্র। কৃষ্ণচন্দ্র ঘোষাল কাশীক্ষেত্রে পৌঁছে যথাবিহিত তীর্থকর্মাদি, যেমন মুক্তহস্তে বিপুল দান, নানা কৃচ্ছসাধন, তীর্থমাহাত্ম্য শ্রবণ করার সঙ্গে সঙ্গে নিজ পিতৃদেব কন্দর্প ঘোষালের নামানুসারে ‘কন্দর্পেশ্বর শিব’ প্রতিষ্ঠা করেন।
নৌকার সারি যেখানেই ভেড়ে, সেখানেই লোক, যাত্রী আসেন, কোনও মন্দির বা দেবস্থান থাকলে সেখানেও পুজো দিতে নাও থেকে নেমে যাত্রী দল ঘোষাল মশায়ের অনুগমন করে। তারই সঙ্গে সেই অঞ্চলের খানিক আভাস মেলে, জানা যায় দেবতার মাহাত্ম্যকথা। কোন পথে বাংলা পেরিয়ে রাজমহল, সেখান থেকে মুঙ্গের– এগিয়ে চলে নৌবহর। মুঙ্গের পেরিয়ে বেশ ক’দিনের পথে শেষে গয়াধামে বজরা পৌঁছলে ঘোষাল মশাই আর যাত্রীরা পূর্বপুরুষের তর্পণ-শ্রাদ্ধ করতে উদ্যোগ নিলেন।
‘দেব প্রতি মহাশয়ের বড়ই ভকতি/ পদব্রজে চলি পদে করিলা প্রণতি।’
তারপর ব্রাহ্মণদের নানা সামগ্রী উপহার দিয়ে তুষ্ট করে কাশী যাত্রার জন্য সকলকে আহ্বান জানালেন ঘোষাল মশাই। আর তখন,
‘গয়াতে আসিয়া যাত্রী স্থানে স্থানে ছিল।
সহস্র সহস্র যাত্রী আসিয়া মিলিল।।
মহারাষ্ট্র, কুরুক্ষেত্র উড়িষ্যা নগর।
ঢাকা আদি বঙ্গদেশের শত শত নর।।
কর্ত্তার আশ্বাসে করিল গমন।
আগে পিছে দুই সোয়ার যাত্রীর রক্ষণ।।’
অর্থাৎ জনাকয়েক যাত্রী নয়, বিশাল এক লটবহর নিয়ে কৃষ্ণচন্দ্র চললেন কাশীর উদ্দেশ্যে। যেখানে তাঁকে কেউ চিনত না, সেই গয়াধামে শুধু দান-ধ্যান করেই ক্ষান্ত হলেন না, আরও আরও যাত্রীদের আহ্বান করে নিয়ে চললেন। তীর্থযাত্রায় জনসংযোগের কর্ম নিম্পন্ন হতে থাকল।
কাশীধামের অন্যতম পরিচয় এটি মুক্তিক্ষেত্র। স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেব প্রতিটি মৃত মানুষের কানে ‘তারকব্রহ্ম’ নাম শুনিয়ে মুক্তিদান করে থাকেন। আবার কথায় বলে, ‘অন্য ক্ষেত্রে কৃতং পাপং কাশীক্ষেত্রে বিনশ্যতি’। সেদিক থেকেও কাশীধাম মুক্তিক্ষেত্র। কৃষ্ণচন্দ্র ঘোষাল কাশীক্ষেত্রে পৌঁছে যথাবিহিত তীর্থকর্মাদি, যেমন মুক্তহস্তে বিপুল দান, নানা কৃচ্ছ্রসাধন, তীর্থমাহাত্ম্য শ্রবণ করার সঙ্গে সঙ্গে নিজ পিতৃদেব কন্দর্প ঘোষালের নামানুসারে ‘কন্দর্পেশ্বর শিব’ প্রতিষ্ঠা করেন। বিজয় রাম সেন পয়ার ছন্দে তাঁর কাব্যে তাঁর পোষক কৃষ্ণচন্দ্র ঘোষালের প্রশংসা যেমন করেছেন, যেমন তীর্থ ও পথের বেশ খানিক বর্ণনা দিয়েছেন, তেমনই তাঁর কাব্যে ধরা পড়েছে নানা অঞ্চলের মানুষজনের কথা, তৎকালীন সামাজিক অবস্থার কথাও।
কাশীধামের মাহাত্ম্য-কথা অসংখ্য বইতেই বলা আছে। তার মধ্যে স্কন্দপুরাণের চতুর্থ ভাগে কাশীখণ্ড সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। সেই কাশীখণ্ডের বঙ্গানুবাদ করিয়েছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র ঘোষালের পুত্র সুবিখ্যাত জয়নারায়ণ ঘোষাল। কাব্যশক্তির অধিকারী না হওয়ায় সাহায্য নিয়েছিলেন বাঁশবেড়িয়ার জমিদার, রাজা উপাধিধারী নৃসিংহ দেবের। সে-কাব্যের পরেই আবার জয়নারায়ণ ঘোষাল রচনা করেছিলেন ‘কাশীপরিক্রমা’ নামে এক উপাদেয় গ্রন্থ। দীনেশ চন্দ্র সেন তাঁর ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ বইতে এই বই সম্পর্কে লিখেছেন, ‘রাজা বাহাদূরের লিপি কৌশল–তাহার সত্যপ্রিয়তা’। বাঁক খাওয়া গঙ্গার অর্ধবৃত্তাকার কাশীর অবস্থান শিব-ললাটে অর্ধচন্দ্রের সাথে তুলনা করেছেন কবি। কাশীস্থ বাড়িঘর, লোক, তীর্থিদের বর্ণনা, পাণ্ডা-পুরোহিতদের ক্রিয়াকর্ম সবেরই সরস বর্ণনা এই বইয়ে রসিয়ে বলেছেন কবি। অহল্যাবাঈ যে কাশী বিশ্বনাথের মন্দিরখানি নতুন করে তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন, সেকথা জানিয়েও লিখেছেন, ‘কনক কলস শোভে মন্দির উপর/ তিন লক্ষ্য ব্যয়ে যেই না হৈল কাতর’। এও জানিয়েছেন,
‘এই মত প্রতি মাসে প্রায় হয় দ্বন্দ
ক্ষণমাত্র গড়াগড়ি যায় কত স্কন্ধ’।
কাশীর গুন্ডা, খুনখারাপি সম্পর্কে এমন সরস বর্ণনা উল্লেখের দাবি রাখে বই কি। আর আছে কাশীর বিখ্যাত বেনারসী শাড়ির কথাও।
পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন নগর এই কাশীধাম। প্রতিদিন হাজার হাজার পুণ্যলোভা-মানুষ ভারতের নানা প্রান্ত থেকে বিশ্বনাথের মন্দিরে ছুটে আসছেন সেই কবে থেকেই। শুধু ভারতবাসীই নয়, এসেছেন এবং আজও আসেন বহু বিদেশি। কাশীধামের শুধু ছবি দেখেই কাশী যাওয়ার কথা ছোটবেলায় ভেবেছিলেন প্রাচ্যবিদ ম্যাক্সমুলার সাহেব। যদিও কোনওদিনই তিনি ভারতে আসেননি। নিত্যদিন কত না সাধুসন্ত এই তীর্থে আসেন এবং অনেকেই পাকাপাকিভাবে বাস করতেও থাকেন, গড়ে তোলেন আখড়া, মঠ। কাশির চলমান শিব বলে খ্যাত তৈলঙ্গ স্বামীর মত উচ্চকোটির সাধক তাঁদের অন্যতম। কাশীতে প্রচলিত এক ‘কহাবত’ হল, ‘হর কঙ্করমে শঙ্কর’, সত্যিকথা বলতে কি কাশীতে শিবের মন্দির যে কত তার ইয়ত্তা নেই। শুধু কি শিব, আরও কত না দেবদেবীর মূর্তি, মন্দির তার গোনাগুনতি নেই। চলতি কথায় বলা হয়ে থাকে বার্ধক্যে বারাণসী, কিন্তু বারাণসীর পুণ্যতীর্থে নিত্য আসা যাওয়া করেন নানা বয়সের, নানা অভিপ্রায়ে কত না মানুষ। তাঁরা কেউ আসেন তীর্থ দর্শনে, কেউ বা সাধুসন্তের অলৌকিক বিভূতি দর্শনে, আবার কেউ বা আসেন উত্তরবাহিনী গঙ্গার অপূর্ব দৃশ্য, অসংখ্য ঘাট, আর অবসন্ন দিনাবসানে গঙ্গা আরতি দর্শনে।