বাঙালির সমাজ জীবনে বিশ শতকের শেষাংশ থেকে একুশের প্রথম দুই দশকে শঙ্খ ঘোষ উল্লিখিত হতেন ‘বাংলার বিবেক’ নামে। তার একটি প্রধান কারণ তাঁর বিবৃতির সম্পাদনা। কতটা বলতে হবে, কী ভাষায় বলতে হবে, কোন মুহূর্তে বলতে হবে এবং সর্বোপরি কী বার্তায় তাকে সূচিমুখ করে তুলতে হবে, সে বিষয়ে তাঁর নৈপুণ্য ছিল সর্বজনবিদিত। ‘ভাষ্য শব্দের তর্জনী’র প্রথম পর্ব। লিখছেন অভীক মজুমদার।
১.
এই ৫ ফেব্রুয়ারি ছিল আমার মাস্টারমশাই শঙ্খ ঘোষের ৯২তম জন্মদিন। এ বছর, ২০২৪ সালে, দিনটা ছিল সোমবার। আগের দিন রবিবার একথা-সেকথা ভাবতে ভাবতে মনখারাপ ছিল খুব। স্মৃতি নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলাম। আমি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে পড়েছি স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর মিলিয়ে ১৯৮৭ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত। খ্যাতিমান বহু শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়ে তখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনটি ঝলমল করছে। আমার স্যর, আমার সবথেকে প্রিয় মাস্টারমশাই, শঙ্খ ঘোষ ছিলেন সেই নক্ষত্রমণ্ডলীতে নিজস্বতায় সমুজ্জ্বল, অনন্য দীপ্তিতে সবার থেকে একটু আলাদা। তাঁর অকৃপণ বদান্যতায় ওই মানুষটিকে ঘিরে আমার অজস্র স্মৃতি। স্মৃতির মিছিল।
স্যরের বইপত্র যেখানে থাকে, সেখানে গিয়ে দাঁড়ালাম। একটা-দুটো বই হাতে নিয়ে ওল্টাতে ওল্টাতে ভাবছিলাম ক্লাসরুমের বেঞ্চিতে শেখার পরেও কত কিছু শিখেছি তাঁর কাছে। তাঁর সান্নিধ্যে। কখনও কখনও তাঁর আহ্বানের মধ্যেই ছিল সেই স্বর্ণিল ইশারা! আজকাল মনে হয়, ইচ্ছে করেই তিনি আমার মতো এক অকৃতীকে ডেকেছিলেন, দু’-একটি বিষয় হাতে-ধরে শেখানোর চেষ্টা করেছিলেন। ভাগ্যিস করেছিলেন!
তিন নম্বর তাকে একটি বই। ‘রবীন্দ্র-রচনাবলী’, ষোড়শ খণ্ড। গ্রন্থপরিচয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকার। সেই বইয়ের প্রথম সাদা পাতার মাঝামাঝি, দেখলাম স্যরের হাতের লেখা। ওপরে চিরাচরিত শ্রী। তলায় ‘অভীকের বই’। তারপর– ‘নববর্ষ ১৪০৯।’ চোখ দুটো টলটল হয়ে এল। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ভাষায় বলা চলে, ‘দূরেরটা বিলক্ষণ স্পষ্ট/ শুধু কাছেরটাই ঝাপসা দেখায়।’ চোখে কি কিছু পড়ল?
চলচ্ছবি ফুটে উঠতে শুরু করে। গত শতকের একদম শেষ বছর সেটা। ১৯৯৯। স্যর ডাকলেন সাহায্য করতে একটা ‘বড়’ কাজে। কী কাজ? রবীন্দ্র-রচনাবলির। উডবার্ন পার্ক রোডে ‘নেতাজি ইনস্টিটিউট অব এশিয়ান স্টাডিজ’-এর বাড়িতে সেই কাজের মূল দপ্তর। শুনে তো নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারিনি! শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে রবীন্দ্র-রচনাবলির কাজ করব আমি? কী কাণ্ড!
সেই কাজের সূত্রে আর একজন শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে আমার পরিচয় হল। তিনি– সম্পাদক শঙ্খ ঘোষ। এত কাছ থেকে তাঁর সম্পাদনার রীতি-পদ্ধতি দেখার সুযোগ এর আগে আমার হয়নি। পরে হয়েছে একাধিকবার। যথাসময়ে সে-প্রসঙ্গে যাব। শঙ্খ ঘোষের সম্পাদনাকর্ম নিয়ে খুব বেশি আলোচনা এমনকী, উল্লেখ খুব বেশি চোখে পড়েনি। তাঁর সাক্ষাৎকার সংকলন ‘কথার পিঠে কথা’-তেও কবিতালেখা, কবিতাপড়া, শিশুসাহিত্য, গান, রাজনীতি, সমাজনীতি এমনকী অনুবাদ বা ভ্রমণ নিয়ে প্রশ্ন-প্রতর্ক বিস্তৃত, কিন্তু সম্পাদক শঙ্খ ঘোষকে প্রশ্নবাণে বিব্রত করতে প্রায় কেউ চেষ্টাই করেননি। অথচ, একথাও মনে রাখতে হবে, অনেক দিন ধরেই কবি শঙ্খ ঘোষ সম্পাদনার কাজে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। তাঁর বেশ কিছু সম্পাদনা যথেষ্ট স্বীকৃত এবং গুরুত্বপূর্ণ। যেমন ধরা যাক, ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে চারখণ্ডে প্রকাশিত ‘সতীনাথ গ্রন্থাবলী’। এছাড়া কবি অরুণ মিত্রকে শ্রদ্ধার্ঘ্য ‘কবি অরুণ মিত্র’ (১৯৮৬), রবীন্দ্র-কবিতার উদযাপিত সংকলন ‘সূর্যাবর্ত’ (১৯৮৯), জীবনানন্দ দাশের শতবর্ষের পরিকল্পনায় প্রস্তুত ‘এই সময় ও জীবনানন্দ’ (১৯৯৬) প্রভৃতি নানা ধরনের সারস্বত গ্রন্থন। এই নামগুলিকে যদি বলি মূলস্রোতের বইপত্র, তার পাশে রাখতেই হবে, ‘বিপ্লবী কবি চেরাবান্ডারাজু-র কয়েকটি নির্বাচিত কবিতার বাংলা রূপান্তর’ (১৯৮০) যেটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘বিপ্লবী লেখক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের প্রস্তুতি সম্মেলনের আহ্বায়ক পরিষদ-পরিচালিত সংহতি প্রকাশনী’-র উদ্যোগে। নাম-পত্রে উল্লেখ ছিল ‘গুরুতররূপে পীড়িত কবি চেরাবান্ডারাজুর চিকিৎসার্থে এই সংকলনের সমূহ লভ্যাংশ ব্যয় করা হবে।’ পরিবেশক ছিলেন ‘কথাশিল্প’। এই ছোট্ট পুস্তিকাটি, কোথাও উল্লেখ নেই, সম্পাদনা করেছিলেন শঙ্খ ঘোষ। নামটিও চমৎকার– ‘ঢেউয়ে ঢেউয়ে তলোয়ার’।
২.
‘সম্পাদনা’ শব্দের দিকে একবার পথ-চলতি তাকিয়ে নেওয়া ভালো। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ অভিধানে জানাচ্ছেন, সম্পাদক শব্দের অর্থ ‘গ্রন্থের সঙ্কলয়িতা ও সংস্কারক’। তাহলে সম্পাদনার দু’টি প্রধান অভিমুখ– সংকলন এবং সংস্কার সাধন। এই প্রসঙ্গে মনে হয়, শব্দটির নিহিত অর্থ এবং তার প্রয়োগ নিয়ে শঙ্খ ঘোষ আজীবন সচেতন ছিলেন। সম্পাদনা মানুষের যাপনের ওতপ্রোত শব্দ। তবে, সিংহভাগের ক্ষেত্রেই সে হল অচেতন এক ক্রিয়া। অথবা অর্ধমনস্কতা নির্মিত। বিষয়টি বিশদে বলি। তাত্ত্বিকভাবে দেখলে আশৈশব আমাদের শেখানো হয় এই সম্পাদনাই। সবক’টাই হয়তো অর্থহীন সামাজিক প্রথা নয়। পশুপাখির জগতে সেই মিলনের প্রশিক্ষণ নেই। মানুষের আছে। শঙ্খ ঘোষের মতো মানুষের ক্ষেত্রে সেই সম্পাদনার চিহ্ন দৈনন্দিনে তথা অভিব্যক্তির বিবিধ বিভঙ্গে নিরবচ্ছিন্নভাবে ক্রিয়াশীল। ধরা যাক, একই কথা বন্ধুমহলে আমরা যে ভাষায় বলি, নিশ্চয়ই বাবা-মা অথবা অগ্রজদের/প্রণম্যদের সে ভাষায় বলি না। শুধু ভাষাই বা কেন, অঙ্গভঙ্গি থেকে লিখন, খাদ্য থেকে পোশাক– নানা মাত্রায় নিজস্ব ‘রুচি’ অনুযায়ী সম্পাদনা নিরন্তর চলতে থাকে। বাঙালির সমাজজীবনে বিশ শতকের শেষাংশ থেকে একুশের প্রথম দুই দশকে শঙ্খ ঘোষ উল্লিখিত হতেন ‘বাংলার বিবেক’ নামে। তার একটি প্রধান কারণ তাঁর বিবৃতির সম্পাদনা। কতটা বলতে হবে, কী ভাষায় বলতে হবে, কোন মুহূর্তে বলতে হবে এবং সর্বোপরি কী বার্তায় তাকে সূচিমুখ করে তুলতে হবে, সে বিষয়ে তাঁর নৈপুণ্য ছিল সর্বজনবিদিত। অন্যদিকে, কাব্যগ্রন্থ এবং প্রবন্ধ গ্রন্থের পরিকল্পনা এবং বিন্যাসে তিনি প্রয়োগ করতেন সম্পাদনার প্রখর দৃষ্টি। তাঁর নিজস্ব বইগুলির নির্মাণ বিশ্লেষণ করলেই একথা স্পষ্ট হবে। সেই ‘দিনগুলি রাতগুলি’ থেকে ‘কালের মাত্রা ও রবীন্দ্রনাটক’ থেকে একের পর এক গ্রন্থ জুড়ে তার বিস্তার। শুধু সংযোজন-বিয়োজনই নয়, পত্রিকাপাঠ থেকে গ্রন্থভুক্তির পথিমধ্যে বহু সম্পাদনার চিহ্ন কখনও-কখনও লক্ষ করা যায়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলতে হবে, ‘বিপুলা পৃথিবী’ শীর্ষক কবিতাটির কথা। ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রথম রচনা এবং গ্রন্থভুক্ত রচনা পাশাপাশি রেখে দেখুন। আবার, বেশ কিছু প্রবন্ধ লেখকের জ্ঞাতসারেই গ্রন্থভুক্ত হয়নি। যেমন ধরা যাক, সুকুমার রায়ের হাসির জগৎ নিয়ে লেখা নিবন্ধ, ১৯৮৭ সালে ১১ অক্টোবর যেটি প্রকাশিত হয় ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য়। তবে, সবচেয়ে বড় কথা, শঙ্খ ঘোষের শব্দ-নিঃশব্দের অত্যাশ্চর্য জাদুবিদ্যা, কত কম বলতে হবে, মুখের কথায়, সভায়, কবিতায় কিংবা ক্রোধে– সে এক পরম শিক্ষণীয় সম্পাদনারই ভাষ্য। শূন্যের ভিতরে এত ঢেউ তো সেই প্রযত্নেরই বহিঃপ্রকাশ। নীরবতাকে বাঙ্ময় করে তোলে আর উল্টোদিকে শব্দকে মজবুত করে নৈঃশব্দ্যে! প্রেমের প্রগলভতাকে তিনি শিকড়ে বেঁধেছেন প্রবল নির্বাক অনুভবে। এই আঁতাঁত (Tension) সম্পাদনারই ফসল। কবিতার মিতকথনেও তাঁর জুড়ি মেলা ভার। জীবন আর শিল্পরূপচর্চা– উভয় ক্ষেত্রেই তিনি স্বল্পবাক। প্রতিটি শব্দ, পঙক্তি, বাক্য নির্বিকল্প সুষমায় অলংকৃত।
৩.
যা বলছিলাম, লেগে পড়লাম রবীন্দ্র-রচনাবলির কাজে। মূলত, আমার দায়িত্ব ছিল বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে গিয়ে পত্রিকায় এবং প্রথম সংস্করণ গ্রন্থের লেখাপত্র মিলিয়ে দেখা এবং নানা বিষয় টুকে নিয়ে আসা। আজ এতদিন পর আলগোছে কথাটা লিখতে বা পড়তে যতটা সরল আর সহজ মনে হচ্ছে, বাস্তবে ততটা সহজ ছিল না। মনে রাখতে হবে, এটি ছিল ‘গ্রন্থপরিচয়’ খণ্ডের উপাদান সংগ্রহের দায়িত্ব। এই গ্রন্থপরিচয় বা ষোড়শ খণ্ডটিতে কবিতা, গান, নাটক, উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ– প্রতিটি সাহিত্যবর্গ অনুযায়ী গ্রন্থ এবং প্রাসঙ্গিক তথ্যাদির পরিবেশনা। এখানে তথ্যের প্রতিই দৃষ্টিনিবন্ধ, মূল অভিমুখ নির্দিষ্ট, রচনার উৎকর্ষ পরিমাপ বা মান বিষয়ক মন্তব্য গৌণ। এসব কাজে আমার মাস্টারমশাই কেমন দায়বদ্ধ এবং শ্যেনচক্ষু তার প্রমাণ আছে পূর্বে প্রকাশিত ‘উর্বশীর হাসি’ কিংবা ‘নির্মাণ আর সৃষ্টি’ গ্রন্থের মধ্যে। বিশ শতকের শেষ বছরে, আমি, অকিঞ্চিৎকর এক সাহিত্যপাঠক সেই তন্নিষ্ঠ, একাগ্র কর্মপ্রবাহের মধ্যে হাবুডুবু খেতে শুরু করলাম। উল্লেখ করে রাখি, ষোড়শ খণ্ড বা গ্রন্থপরিচয় খণ্ডের একেবারে অন্তিমে ছিল একটি ‘সংযোজন’ অংশ। সেখানে, কয়েকটি আনুষঙ্গিক তথ্য এবং লেখাপত্র। তারপর ষোড়শ খণ্ডে ব্যবহৃত লেখকদের গ্রন্থপঞ্জি, রচনাবলির খণ্ডানুযায়ী সূচি, বর্তমান খণ্ডের বর্ণনাক্রমিক সূচি। অন্যদিকে, সূচনাংশে মুদ্রিত আছে সম্পাদকমণ্ডলীর নাম। সভাপতি রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত এবং অন্যান্য ছ’জন বিদগ্ধ, মান্য রবীন্দ্রগবেষক সে তালিকায় উপস্থিত। কোথাও কোনও উল্লেখ নেই, শব্দ বা তথ্য নেই, কিন্তু আমি অন্তত হলফ করে বলতে পারি, চরম ব্যস্ততায়, বহু পরিশ্রমে পুরো খণ্ডটি একার হাতে গড়ে তুলেছিলেন শঙ্খ ঘোষ। অবশ্যই উল্লেখ করব, নেতাজি ইনস্টিটিউটে তাঁকে সাহায্য করতেন কয়েকজন উজ্জ্বল গবেষক এবং ভূমিকা থেকে জানতে পারি কয়েকটি খ্যাতনামা ব্যক্তিবর্গের নাম, যাঁরা ছিলেন স্যরের সহায়ক। এঁদের পাশে, বুঝতেই পারছেন, নিষ্প্রভ এবং প্রমাদপ্রবণ উত্তর তিরিশের এক অপোগন্ড, রবীন্দ্রনাথ, উনিশ শতক এবং বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা নিয়ে প্রাণপণ লড়ে যাচ্ছে।