রাস্তায় তখন একটাই ল্যাম্পপোস্টের আলো। টিমটিম করে জ্বলত। রাতে ঘুমনোর সময় আলো নিভিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ, তখনও আমরা মাঝেমধ্যে খেলাচ্ছলে মেনে চলতাম। সুইচের ভূমিকায় অভিনয় করত একটা গুলতি। যদিও গুলতি দিয়ে কখনও আলো জ্বালাতে পারতাম না। ওয়ান-ওয়ে। গুলতির মাথায় হাঁড়ি ভাঙার টুকরো লাগিয়ে ব্যর্থ টিপ অব্যর্থ হতে বেশি সময় লাগত না। ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে আসত পাড়ায়। অন্ধকার ততক্ষণই অন্ধকার, যতক্ষণ না সয়ে যাচ্ছে চোখ। তারপর তো দেখা যায় ঠিক, স্পষ্ট-অস্পষ্ট।
২.
গত পর্বে আপনাদের নিয়ে এসেছিলাম আমার ছেলেবেলার পাড়ায়। কুমোরটুলিতে। দেখিয়েছিলাম সেই ঘর, যে-ঘর এ-লেখা লিখতে লিখতেই আরও একবার অবিকল ’৭৩ সালের মতো হয়ে উঠেছিল। যে ঘরে, বাস্তবে, আমি ঢুকতে পারব না আর। পাঠক, আপনাকে ধন্যবাদ, এই দ্বিতীয়বার আপনার জন্যই আমি ফিরে যেতে পারলাম শৈশবে। দেখাসাক্ষাৎ হল অনেক চলে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া মানুষের সঙ্গে। পুরনো আঙুল দিয়ে পুরনো মাটি ছুঁয়ে এলাম। দেখলাম, সেই আমাকে, যে-আমি অবিন্যস্ত পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছিলাম। যে-আমি ঝুঁকে পড়ছিলাম, প্রায় অজান্তেই, শিল্পের দিকে। ছবি কী, প্রতিমা কী– এই সমস্ত তাত্ত্বিক ব্যাপার-স্যাপারের থেকে বহু দূরে আমার মন ভেসে বেড়াচ্ছিল আমার আঙুল থেকে মাটিতে। সেদিন, শুধুই প্রতিমা, শুধুই পুতুল আমি গড়ছিলাম না। গড়ছিলাম আমি নিজেকেই।
সেই মাটির গন্ধ আপনারা পেয়েছিলেন তো? সেই ছেলেটিকে আপনারা চিনতে পারছেন তো? আমার সারা গায়ে সেই মাটির গন্ধ ম-ম করছে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আজ একটু ফুটপাথে আসি। ফুটপাথ আমার কাছে ছোটবেলার বিছানা। আমার বেশ কিছু বন্ধুরও। বহু রাত সেখানে আমি ঘুমিয়েছি। বাবা আমাকে ডেকে দিতেন ভোরবেলা। আমি লম্ফ জ্বালিয়ে ঘুমন্ত মেজদির পাশে পড়তে বসতাম। কিন্তু সে কথা বলব না আজ। বলব, একটা দিনের কথা, যেদিন আমি দেখতে পেয়েছিলাম তারাখসা । যেদিন আমি বুঝতে পেরেছিলাম, কী খুঁজব আমি জীবনে। বহু কিছু খুঁজে বেড়ানোর মধ্যে এই একটা জিনিসের চিরুনিতল্লাশি আমি আজও চালিয়ে যাচ্ছি। আজীবন খুঁজেও চলব।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আসুন, আজ একটু ফুটপাথে আসি। ফুটপাথ আমার কাছে ছোটবেলার বিছানা। যেখানে আমি শৈশব কাটিয়েছি। আমার বন্ধু-পরিজনদের সঙ্গে। বহু রাত সেখানে আমি ঘুমিয়েছি। বাবা, আমাকে ডেকে দিতেন ভোরবেলা। আমি হ্যারিকেন জ্বালিয়ে ঘুমন্ত মেজদির পাশে বসে পড়তে বসতাম। গ্রাজুয়েশনের সময়ও আমি এভাবেই পড়াশোনা চালিয়েছিলাম। কিন্তু সেকথা বলব না আজ। বলব, একটা দিনের কথা, যেদিন আমি দেখতে পেয়েছিলাম তারা-খসা । যেদিন আমি বুঝতে পেরেছিলাম, কী খুঁজব আমি জীবনে। বহু কিছু খুঁজে বেড়ানোর মধ্যে এই একটা জিনিসের চিরুনি-তল্লাশি আমি আজও চালিয়ে যাচ্ছি। আজীবন খুঁজেও চলব। কোনও সার্চ ইঞ্জিন, ইন্টারনেট, গোয়েন্দা দফতর, নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণার বিজ্ঞপ্তি আমাকে পৌঁছে দেবে না সেই অভীষ্ট লক্ষ্যে। বলছি, সেদিনের কথা।
রাস্তায় তখন একটাই ল্যাম্পপোস্টের আলো। টিমটিম করে জ্বলত। রাতে ঘুমনোর সময় আলো নিভিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ, তখনও আমরা মাঝেমধ্যে খেলাচ্ছলে মেনে চলতাম। সুইচের ভূমিকায় অভিনয় করত একটা গুলতি। যদিও গুলতি দিয়ে কখনও আলো জ্বালাতে পারতাম না। ওয়ান-ওয়ে। গুলতির মাথায় হাঁড়ি ভাঙার টুকরো লাগিয়ে ব্যর্থ টিপ অব্যর্থ হতে বেশি সময় লাগত না। ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে আসত পাড়ায়। অন্ধকার ততক্ষণই অন্ধকার, যতক্ষণ না সয়ে যাচ্ছে চোখ। তারপর তো দেখা যায় ঠিক, স্পষ্ট-অস্পষ্ট। আমরা দেখতে পেতাম– তারও আগে অবশ্য শুনতে পেতাম, দূর থেকে ভেসে আসা এক পুরনো সুর। হরিধ্বনি। কখনও কীর্তন। কাছেই কাশী মিত্র ঘাট। শ্মশান। একের পর এক অন্ত্যেষ্টিযাত্রার দল। শ্মশানবন্ধুদের পায়ের শব্দ। তাদের ছড়িয়ে দেওয়া খই উড়ে এসে পড়ত ফুটপাথে শুয়ে থাকা আমাদের গায়ে। সঙ্গে পয়সার আওয়াজ। সেই অন্ধকারে মনে হত, শরীরে ফুটে উঠছে নক্ষত্রমালা। এই ফুটপাতই আকাশ, মহাকাশ, নক্ষত্রমালা– আমার জন্য মাটিতে নামিয়ে এনেছিল। শুধু মাটি না, মাটি স্পর্শ করা আমার ও বন্ধুপরিজনদের শরীরে সেই নক্ষত্র আমি দেখতে পেয়েছিলাম। এই হল জীবনানন্দ কথিত ‘কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়’।
কেউ মারা গেলে নক্ষত্র হয়ে যায়– একথা ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি। বিখ্যাত মানুষ মারা গেলে তাঁরা নিজেরাই সখচিত নক্ষত্র। কিন্তু বহু মানুষ আছে, যারা বিখ্যাত নয়। তারা তো এই পৃথিবীতেই বীজ খেতে এসেছিল। জন্মগ্রহণ করেছিল। এই পৃথিবীতে কিছু-না-কিছু ঠিক করেই গিয়েছে তারা। আকাশের সেই সখচিত উজ্জ্বল নক্ষত্রর বাইরেও বহু অল্প আলোর নক্ষত্রও লুকিয়ে রয়েছে। রয়েছে এই পৃথিবীতেই।
আমি পৃথিবীর সেই নক্ষত্রগুলি খুঁজে চলেছি সেইদিন থেকে। শবদেহের শেষযাত্রায় উড়ো খই এসে পড়ার মুহূর্ত থেকে।
…আরও পড়ুন ত্রিনয়ন ও ত্রিনয়ন…
প্রথম পর্ব: ছোট থেকেই মাটি আমার আঙুলের কথা শুনত