হ্যারি লিখেছে কেন সে ‘স্পেয়ার’ বা বাড়তি। কারণ আমি আমার ঠাকুরমা নই। আমি আমার বাবা নই। আমি আমার দাদা উইলি (উইলিয়াম) নই। আই ওয়াজ্ থার্ড ইন লাইন বিহাইন্ড দেম। ক্রমশ দাদার পুত্রদের সংখ্যা যত বেড়েছে, ততই বেড়েছে সিংহাসন থেকে হ্যারির দূরত্ব। এবং রাজবাড়িতে হ্যারি পদে পদে বুঝতে পেরেছে, তার কোনও দাম নেই এই বাড়িতে। একদিন তো বাপ চার্লস তাকে জিজ্ঞেস করল, ঠাট্টার ভঙ্গিতে, তুই আমার ছেলে? তোর বাপটা কে বলত?
আমার গদ্যে কোনও বাড়তি থাকবে না– বলেছিলেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। সত্যি বলতে, হেমিংওয়ের ভাষা আজীবন সচেতন ‘বাড়তি’ ছাঁটাইয়ের সোনালি ফসল। কিন্তু সব লেখক তো হেমিংওয়ের মতো অমন নির্মমভাবে ‘বাড়তি’ শব্দ ফেলে দিতে পারেন না। ‘বাড়তি’ শব্দ, তবু তারাও তো কলম থেকে ঝরে পড়েছিল। সুতরাং তাদেরও মন আছে, অভিমান আছে, ব্যথাবোধ আছে। মনে হয় লেখকদের। বেশিরভাগ লেখকই তাই লেখার মধ্যে ‘বাড়তি’ শব্দের জন্যও কিছু আদর, কিছু কদরের জায়গা রেখে দেন। ‘বাড়তি’-দের আদর দিয়ে মাথায় তুলেছেন শেক্সপিয়র আর রবীন্দ্রনাথ। ‘স্পেয়ার’-দের ‘ডিয়ার’ করেই মহাদরে রেখে দিয়েছেন নিজেদের লেখায়।
ব্রিটিশ রাজবাড়িতে কিন্তু ‘বাড়তি’-দের একেবারে কদর নেই। তারা সত্যিই আজীবন আদরের উপবাসে ভোগে। রাজা বা রানির যে-সন্তানটি ‘নেক্সড্ টু দ্য থ্রোন’ তারই আদর। বাকিরা যে যতদূরে সিংহাসন থেকে, তার কদর তত কম। চোখের সামনে আমরা দেখেছি রানি এলিজাবেথের অপূর্ব সুন্দরী বোন মার্গারেটকে। ছোট থেকে তাকে বুঝিয়ে দেয়া হল, দিদিকে টপকে রানি হওয়ার তার কোনও চান্সই নেই। সে অমন সেক্সি সুন্দরী হয়েও, ‘বাড়তি’। সুতরাং মার্গারেট তার শরীরের ‘বাড়তি’ সৌন্দর্যের জায়গাগুলো যতদূর সম্ভব মুক্ত করে মাতাল প্রদর্শনে লন্ডনের রাত-পার্টি মাতাতে লাগল। মার্গারেটের আড়াল-সরানো ‘বাড়তি’-র ছবিও বেরল ‘লাইফ’ ম্যাগাজিনে: ‘দ্য রয়েল সিক্রেট’ ক্যাপশন নিয়ে।
কে তুলেছে এই ‘বাড়তি’ আড়াল সরানো ছবি? লর্ড স্নোডাউন। মার্গারেটের তখন বন্ধু, পরে কয়েক দিনের স্বামী! রাজবাড়িতে বাড়তির অপমান সহ্য করতে-করতে মার্গারেট হয়ে গেল নিঃসঙ্গ অ্যালকোহলিক। এবং বাঁচল না বেশিদিন। আরও এক রয়্যাল বাড়তি-কে দেখছি চোখের সামনে। যদিও সে রাজকুমার, জন্ম থেকে অপমানিত হয়েছে রাজবাড়িতে। কারণ রাজা চার্লস গত হলে তার রাজা হওয়ার কোনও উপায় নেই। রাজা হবে তার দাদা প্রিন্স উইলিয়াম। রাজকুমার হ্যারি জন্ম থেকেই ‘বাড়তি’।
বিশ বছরের হ্যারি অবশ্য প্রথম জানল তার বাপ (তখন প্রিন্স চার্লস) তার মা প্রিন্সেস ডায়ানাকে কী বলেছিল তার জন্মর পরেই। ডায়ানা তখন সদ্যজাত হ্যারিকে কোলে করে বসে। চার্লস যাচ্ছে তার গার্লফ্রেন্ড ক্যামিলার কাছে। যাওয়ার পথে দেখা করতে এল বউ ডায়ানার সঙ্গে। এবং বিপুল বিদ্রুপে বলল ডায়ানাকে : ‘Wonderful! Now you’ve given me an Heir and a Spare my work is done’. চার্লসের মুখের কথাটি হুবহু উদ্ধৃত করেছে হ্যারি তার আত্মজীবনী ‘স্পেয়ার’-এ। আর উদ্ধৃতির পাশে কী গভীর অভিমানে ও ব্যথায় লিখেছে :
‘A joke Presumably. Many a True word
Spoken in jest as Pa had gone off to meet his girl friend.’
হ্যারি লিখেছে কেন সে ‘স্পেয়ার’ বা বাড়তি। কারণ আমি আমার ঠাকুরমা নই। আমি আমার বাবা নই। আমি আমার দাদা উইলি (উইলিয়াম) নই। আই ওয়াজ্ থার্ড ইন লাইন বিহাইন্ড দেম। ক্রমশ দাদার পুত্রদের সংখ্যা যত বেড়েছে, ততই বেড়েছে সিংহাসন থেকে হ্যারির দূরত্ব। এবং রাজবাড়িতে হ্যারি পদে পদে বুঝতে পেরেছে, তার কোনও দাম নেই এই বাড়িতে। একদিন তো বাপ চার্লস তাকে জিজ্ঞেস করল, ঠাট্টার ভঙ্গিতে, তুই আমার ছেলে? তোর বাপটা কে বলত?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ব্রিটিশ রাজবাড়িতে কিন্তু ‘বাড়তি’-দের একেবারে কদর নেই। তারা সত্যিই আজীবন আদরের উপবাসে ভোগে। রাজা বা রানির যে-সন্তানটি ‘নেক্সড্ টু দ্য থ্রোন’ তারই আদর। বাকিরা যে যতদূরে সিংহাসন থেকে, তার কদর তত কম। চোখের সামনে আমরা দেখেছি রানি এলিজাবেথের অপূর্ব সুন্দরী বোন মার্গারেটকে। ছোট থেকে তাকে বুঝিয়ে দেয়া হল, দিদিকে টপকে রানি হওয়ার তার কোনও চান্সই নেই। সে অমন সেক্সি সুন্দরী হয়েও, ‘বাড়তি’।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আমার আত্মজীবনীতে আমি সব লিখেছি। দিনের পর দিন আমার অনাদরের কথা। আমার অপমানের কথা। আমাকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশার কথা। এই কারণেই, অনেক গভীর অভিমান ও বেদনা থেকে আমার আত্মজীবনীর নাম দিলাম ‘স্পেয়ার’। ‘বাড়তি’। Day by day, I felt more sluggish, More hopeless. More lost. এই রাজবাড়িতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি এখান থেকে পালাতে চাই। পালানোর ইচ্ছেটা ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠছে। কোনওরকমে নিজেকে সামলে রেখেছি। শুনতে বেশ লাগছে নিশ্চয়ই, আমি রাজার প্রাসাদে আছি। একই বাড়িতে, যে বাড়িতে আমার ঠাকুরমা কুইন এলিজাবেথ থাকেন। কিন্তু আপনারা কি জানেন, আমি কত খারাপ একটা ঘরে থাকি, যেখানে না-ঢোকে বাতাস, না-ঢোকে আলো। মাঝেমধ্যে মনে হয়, ঠাকুরমার ঘরে গিয়ে তাঁর কাছে নালিশ করি। তাঁকে জানাই আমার দুর্দশার কথা। আমি নিশ্চিত, আমার মা বেঁচে থাকলে আমার এমন দুরাবস্থা হত না। মা-কে মনে পড়ে। মা কি জানে, রাজপ্রাসাদে ‘বাড়তি’ হিসেবে আমি প্রতিদিন কত কষ্ট পাই! একটা কথা জানাচ্ছি, একটা লোক রোজ রাত্রে তার লম্বা গাড়িটা আমার জানলার সামনে ইচ্ছে করে পার্ক করে। ওই জানলা দিয়ে একটু আলো-বাতাস আসতে পারে। সেটা ওই লোকটা ব্লক করে দেয়। আমার কোনও অধিকার নেই, ঠাকুরমার কাছে ওই লোকটার ব্যাপারে পর্যন্ত কোনও নালিশ করার। আমি নাকি রাজকুমার! এই ‘বাড়তি’ রাজকুমার হওয়া যে কত অপমানের তা আমি হাড়ে-হাড়ে বুঝছি। আমি না-ঘরকা, না-ঘাটকা! যে লোকটা হ্যারির জানলার সামনে রোজ গাড়ি পাঠ করে, একদিন হ্যারি তাকে খুব মোলায়েম ভদ্র ভাষায় একটি নোট লিখল : You might perhaps pull your car forward a few inches. ওমা, সেই লোকটা উত্তরে বলল হ্যারিকে, ‘সাক এগস্’। ডিম চোষ! এবং ঠাকুরমা রানি এলিজাবেথকেও বলল, আপনার নাতি হ্যারিকে আপনিও বলুন, বসে বসে ডিম চুষতে। ‘ডিম’ মানে আমাকে আমার কোন অঙ্গটি চুষতে বলছে, বুঝছেন তো? এত বড় সাহস আমাকে বলছে, গাড়িটা কয়েক ইঞ্চি এগিয়ে পার্ক করতে! ঠাকুরমা অবশ্য আমাকে বলেনি, সাক এগস। এই ভাষা ঠাকুরমা বলবে না, জানতুম।
তবে তার চেয়েও খারাপ ঘটনা ঘটল আমার জীবনে, লিখেছে হ্যারি। হ্যারি লিখেছে, দাদা উইলি, বউদি কেটের ছেলে হল। জর্জ – জর্জ জন্মানোর পরে আমার খুব আনন্দ। আমি কাকা হয়েছি! খবরের কাগজের রিপোর্টাররা আমাকে জিজ্ঞেস করতে লাগল, আমার দুঃখ আরও বেড়েছে কি না?
আমি তো অবাক! দুঃখ কেন? আমি তো কাকা হয়েছি। ওরা বলল, দুঃখ হচ্ছে না এ-কথা ভেবে যে, দ্য বেবি হ্যাজ মুভড ইউ ওয়ান লিঙ্ক ডাউন দ্য চেন অফ সাকসেশন? এইভাবে বেঁচে থাকা যায়?
সত্যি যায় না। বুঝতে পেরেছি, রাজবাড়িতে আমার সম্মানের জায়গাটাই নেই। এমনকী, দেশেও নেই। তার উপর যেখানে যাই, একই প্রশ্ন? এমনকী, ভিড়ের মধ্যে কেউ চিৎকার করে ওঠে: প্রিন্স হ্যারি, হোয়াই ওন্ট হি ম্যারি!
সত্যিই তো, আমার ক্রমশ বয়স বেড়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে নর্থ পোলে একবার ঘুরে এসেছি। এবার ভাবলাম, জন্মদিন থেকে পালাতে সাউথ পোলে চলে যাই।
সাউথ পোল! খবরের কাগজে কেউ লিখল, সাউথ পোল ওয়জ্ ইভন্ কোল্ডার।
ইচ্ছে হল চিৎকার করে বলি, আই হ্যাভ অলরেডি ফ্রোজন্ মাই পেনিস।
ইতিমধ্যে মার্কিন অভিনেত্রী মেঘানকে বিয়ে করেছি। এবং দেশ ছেড়েছি। ইংল্যান্ডে স্পেয়ার বা ‘বাড়তি’-র জন্য কোনও ভালবাসা নেই। আছে শুধু পদে পদে অপমান। বাবা চার্লস তো বলেই দিয়েছে, আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখলেও আমার আমেরিকান বউ মেঘানকে বাবা বা ঠাকুরমা, কেউ সহ্য করতে পারেনি। কারণ মেঘানের মা-র গায়ের রং বাদামি। মেঘানের গায়ের রংও আমাদের মতো লালচে নয়। ঠাকুমা তো আমার দুই সন্তানের জন্মের পর প্রথম প্রশ্ন করেছে, কতটা কালো? ব্রিটিশ রাজপরিবারে স্থান পাওয়ার মতো লাল টুকটুকে হয়েছে কি? সুতরাং এদেশে সত্যি থাকা যায় না।
অতএব আমি ইংল্যান্ড ছেড়ে আমেরিকাবাসী। এবং আমার আত্মজীবনীর শেষ লাইন: ফ্লাই অ্যাওয়ে! উড়ে পালাও। পালাও তুমি। থেকো না ‘বাড়তি’-র অপমান আজীবন বয়ে চলতে!