‘কাশ্মীরের মেয়েরা কি ইদানীং কলেজে পড়তে যাচ্ছে?’ জবাবটা খাড়া করে উঠতে পারার আগেই তিনি তাঁর বক্তব্য আরও খোলসা করলেন, ‘৩৭০ ধারা উঠে যাওয়ার পর থেকে তো ওখানে অজস্র কলেজ খোলা হয়েছে। ৩৭০ ধারা যখন বহাল ছিল, সেই সময়ের তুলনায় মেয়েরা এখন কলেজে যাওয়ার ব্যাপারটায় অনেক বেশি নিরাপদ বোধ করছে।’ তারপর তিনি বলে যেতে লাগলেন, কীভাবে ‘সন্ত্রাসবাদীরা’ মেয়েদের কলেজে যেতে বাধা দিত, আর কীভাবে তাদের জোর করে বিয়ে করতে বাধ্য করত।
২০২৩-এর ডিসেম্বর মাসের কথা। আমার সহযাত্রী আইনজগতের কিছু মানুষ। আমি যে কাশ্মীরের মেয়ে, সেকথা জেনে এক ভদ্রমহিলার কৌতূহল মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। চোখে খেলে গেল আগ্রহের ঝিলিক। একেবারে গোড়াতেই তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘কাশ্মীরের মেয়েরা কি ইদানীং কলেজে পড়তে যাচ্ছে?’
জবাবটা খাড়া করে উঠতে পারার আগেই তিনি তাঁর বক্তব্য আরও খোলসা করলেন, ‘৩৭০ ধারা উঠে যাওয়ার পর থেকে তো ওখানে অজস্র কলেজ খোলা হয়েছে। ৩৭০ ধারা যখন বহাল ছিল, সেই সময়ের তুলনায় মেয়েরা এখন কলেজে যাওয়ার ব্যাপারটায় অনেক বেশি নিরাপদ বোধ করছে।’ তারপর তিনি বলে যেতে লাগলেন, কীভাবে ‘সন্ত্রাসবাদীরা’ মেয়েদের কলেজে যেতে বাধা দিত, আর কীভাবে তাদের জোর করে বিয়ে করতে বাধ্য করত।
এ অভিজ্ঞতার জেরে আমার মনে প্রশ্ন জেগেছিল, তাঁর এই ধারণার সূত্রগুলো কী কী— হয়তো হোয়াটসঅ্যাপে ছড়িয়ে-পড়া মেসেজ, কিংবা সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত মহিলাদের পক্ষে পশ্চাৎপদ কাশ্মীরের ছবি। যখন দেখি যে ৩৭০ ধারা তুলে নেওয়ার জেরে মেয়েদের উন্নত জীবনযাত্রার আখ্যানটি দেশের সংসদ থেকেও প্রচারিত হয়, তখন তা শুধু আমার হতাশাকে আরও খানিকটা উসকে দেয়।
২০১৯-এর পর থেকে এমন অভিজ্ঞতা আর কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ৩৭০ ধারা উঠে যাওয়ার পর কাশ্মীরের মেয়েরা কতদূর লাভবান হয়েছেন, তার বিজ্ঞাপন অনেকেই বারবার জাহির করেছেন। এবং খুব সম্ভবত তার নেপথ্যে কাজ করেছে ভুল তথ্য। এই গোটা বিষয়টার নেপথ্যে আছে কাশ্মীরি মেয়েদের লড়াইকে দখল করে নেওয়ার প্রবণতা, তাঁদের নিছক রাজনৈতিক আখ্যানের সাবুদ হিসেবে হাজির করার ঝোঁক। তবু যতবার এসব কথা কানে আসে, আরও তীব্র হয়ে ওঠে আমার রাগ; একথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, কাশ্মীরের মেয়েদের নিছক বস্তুসর্বস্ব করে তোলা হচ্ছে— হয় তারা রূপের জন্য তারিফযোগ্য, আর নয়তো বিদ্বেষ ও দুরভিসন্ধির শিকার।
পিতৃতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য আড়াল থেকে অনুপ্রেরণা জোগায় এই রাগ– কাশ্মীরের মেয়েদের বহু বছরব্যাপী রাজনৈতিক সক্রিয়তা আর প্রতিরোধের ইতিহাসকে মুছে ফেলতে দেখার রাগ। ৩৭০ ধারা বাতিল হয়ে যাওয়ার ফলে কাঠামোগত সমস্যাগুলোর কোনও সুরাহা আদপেই হয়নি, শুধু একটা একপেশে উদ্যোগকে নারী-কল্যাণের মুখোশ পরিয়ে হাজির করা হয়েছে। যে মেয়েরা এতদিন ধরে নিজেদের অধিকারের দাবি জানিয়ে লড়াই করেছেন, তাঁদের সেই লড়াইকে স্রেফ উপেক্ষা করে যাওয়া হয়েছে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
রাজ্যটি এক ঝটকায় ১৯২০-র দশক থেকে পৌঁছে গেছে ২০৪০ সালে– বাস্তবের এহেন নির্ভেজাল বিকৃতির ফলে আমার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির খাত বদলের উদ্যোগটি আরও জটিল হয়ে উঠেছে, আরও কঠিন হয়ে উঠেছে ‘কাশ্মীর’ নামক রাজ্যটির মেয়েদের অবস্থার উন্নতি আর সত্যিকারের প্রগতির পক্ষে সওয়াল করার কাজ। সেই মহিলার কথার কোনও জবাব সেদিন দিইনি বটে, কিন্তু তাঁর কথাগুলো আমার মন থেকে মুছে যায়নি। আমার কি উচিত ছিল তাঁর সঙ্গে বিতর্ক চালানো, ধারণা আর বাস্তবের ফারাকটা মুছে দিতে চেষ্টা করা? তবু এই ভাবনার তলা দিয়েও চোরাস্রোতের মতো বয়ে চলে ভয়– এসব কথা নিয়ে সোচ্চার হয়ে উঠলে হয়তো সেই বিশেষ পরিসরটিতে আমার নিরাপত্তা বিপন্ন হত।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সেই ভদ্রমহিলার প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে সেই মুহূর্তে বুঝতে পেরেছিলাম, আমার জবাবটা বোধহয় তাঁর পূর্ব-ধারণার সঙ্গে খাপ খাবে না। তবু একটা ভাবনা মনের মধ্যে উসকে উঠেছিল– কোথায় পেলেন তিনি এসব ধারণা? ৩৭০ ধারা তুলে নেওয়ার ফলে যে সমাজে এবং জনজীবনে মেয়েদের অবস্থানের উন্নতি ঘটেছে, তাঁদের নাগালে এসেছে বিবিধ পরিষেবা, সে আখ্যানই হয়তো তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিটি গড়ে দিয়েছে।
আর এই আখ্যানটি গড়ে উঠেছে এ দেশের সংসদে বসে-থাকা বিভিন্ন ব্যক্তির নিখুঁত তত্ত্বাবধানে। ২০১৯ সালে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সগর্বে জানিয়েছেন, ভারতের অন্যান্য রাজ্যের নারীসমাজ যে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন, জম্মু-কাশ্মীরের মহিলারা এতদিন তা থেকে বঞ্চিত ছিলেন; আর একপেশেভাবে ৩৭০ ধারা বাতিলের পর তাঁদের ক্ষমতায়নের পথ খুলে যাবে। সরকারের হাতে বোনা এই আখ্যান দাবি করে যে, ৩৭০ ধারা বাতিল করার পদক্ষেপটির অন্যতম লক্ষ্য লিঙ্গসাম্যের প্রচার ও প্রসার; আর সে দাবি ডাহা মিথ্যে!
আমার নিজের মতে, ৩৭০ ধারা বাতিলের পর মতপ্রকাশের পরিসর আরও সংকুচিত হয়ে এসেছে, আর তার ফলে আমার লড়াইয়ে যোগ হয়েছে আরও একটা মাত্রা। আজ দেখতে পাচ্ছি, আমার সামনে রয়েছে এই সর্বব্যাপী কিংবদন্তির ফানুস ফাটিয়ে দেওয়ার কাজ। যে ভদ্রমহিলার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল, তাঁর চোখে যেমন কাশ্মীর এক আদিম সমাজ, যেখানে ৩৭০ ধারা বহাল থাকাকালীন মেয়েরা বহু সুযোগ-সুবিধার নাগাল পাননি। তাঁর মতে হঠাৎ একপেশেভাবে এই ধারা বাতিল করে দেওয়ার জেরে রাজ্যটি এক ঝটকায় ১৯২০-র দশক থেকে পৌঁছে গেছে ২০৪০ সালে– বাস্তবের এহেন নির্ভেজাল বিকৃতির ফলে আমার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির খাত বদলের উদ্যোগটি আরও জটিল হয়ে উঠেছে, আরও কঠিন হয়ে উঠেছে ‘কাশ্মীর’ নামক রাজ্যটির মেয়েদের অবস্থার উন্নতি আর সত্যিকারের প্রগতির পক্ষে সওয়াল করার কাজ। সেই মহিলার কথার কোনও জবাব সেদিন দিইনি বটে, কিন্তু তাঁর কথাগুলো আমার মন থেকে মুছে যায়নি। আমার কি উচিত ছিল তাঁর সঙ্গে বিতর্ক চালানো, ধারণা আর বাস্তবের ফারাকটা মুছে দিতে চেষ্টা করা? তবু এই ভাবনার তলা দিয়েও চোরাস্রোতের মতো বয়ে চলে ভয়– এসব কথা নিয়ে সোচ্চার হয়ে উঠলে হয়তো সেই বিশেষ পরিসরটিতে আমার নিরাপত্তা বিপন্ন হত।
যতবার এইসব মিথ্যা আখ্যানের মুখোমুখি হই, আরও তীব্র হয়ে ওঠে আমার রাগ। তবু তার নিচেই ওত পেতে থাকে ভয়, মুখ খুললে না জানি কোন প্রতিক্রিয়ার সামনে পড়তে হবে, সেই ভয়, রাজনৈতিক অভিসন্ধি আর সামাজিক পক্ষপাতের চাপে গুটিয়ে আসা পরিসটির আরও প্রান্তে সরে যাওয়ার ভয়। আর এইসব জটিলতায় ভরা পথ পার হতে হতে আমার ভেতরে কোথাও থানা গেড়ে বসে থাকে আমার রাগ। কাশ্মীরের মেয়েদের জন্য ন্যায়বিচার আর সত্যিকারের প্রগতি অর্জনের লক্ষ্যে সঠিক খাতে বয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকে সে।
অনুবাদ: প্রসিত দাস
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved