যতদিন সমাজে এই অসাম্যের অস্তিত্ব, ততদিন সাম্যের প্রতি আমাদের আকাঙ্ক্ষাটিও চিরন্তন। তবে কি সাম্য এবং অসাম্যের সহাবস্থান? তবে কি সমাজে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হলেই কেল্লাফতে? সে-সবের উত্তর খুঁজতে চাইছে না এ-লেখা। রাকেশ শর্মার কথানুসারে, এ-লেখা বুঝতে চাইছে, সাম্যবাদের ধারণা পৃথিবী ছাড়িয়ে মহাকাশে পৌঁছেছে। একটা মহাজাগতিক চিন্তায় পরিণত হয়েছে সে।
মহাকাশ থেকে কেমন দেখায় পৃথিবীকে? অমুক বলছে, একটি উজ্জ্বল বস্তুপিণ্ডের মতো। তমুক বলছে, না। মহাশূন্যে পৃথিবী যেন একটি ঘন নীল বিন্দু।
সম্প্রতি উইং কমান্ডার রাকেশ শর্মা বললেন, পৃথিবীর মাধুর্য যেমনই হোক, সে মাধুর্যের ওপর কোনও কাঁটাতার নেই! এমন সময়, পুরনো রেডিওয় বেজে উঠতেই পারে অঞ্জন দত্তর গান। ‘কোথায় তুমি টানবে বলো দেশের সীমারেখা, আমার জানলা গিয়ে গোটা পৃথিবী…’
৩ এপ্রিল, ১৯৮৪। সোভিয়েত রকেট ‘সয়ুজ টি-১১’-এ চড়ে মহাকাশে পাড়ি দিয়েছিলেন রাকেশ শর্মা। ইতিহাসের পাতায়, প্রথম ভারতীয় মহাকাশচারী! সেই ঐতিহাসিক অভিযানের বয়স ৪০ পার হল গতকাল, ৩ এপ্রিল, ২০২৪-এ। পঁচাত্তর পেরনো রাকেশ শর্মা জানালেন, পৃথিবীর দূরবর্তী গ্রহসমূহে যেন নরক নির্মিত না হয়! ধরা যাক, মঙ্গল গ্রহে যে বহুমূল্য খনিজের সন্ধান পাওয়া গেল, কিংবা চাঁদে উৎপাদিত ফসলের সমবণ্টন প্রয়োজন পৃথিবীর প্রতিটি দেশে। যে কোনও ঔপনিবেশিক ধারণা মাথায় গেঁথে, মহাকাশ-সংক্রান্ত গবেষণা অসম্ভব। অর্থাৎ মহাশূন্যে, অনন্তে, সাম্যবাদের প্রাথমিক চিন্তাগুলি যদি ছড়িয়ে যায়, তবে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে আমাদের পৃথিবীই! মানবজাতি।
একটা নভেম্বর বিপ্লব। একটা ভিয়েতনামের যুদ্ধ। একটা চিনে কৃষি-বিপ্লব। একজন চে-গেভারা। যেন আশরীরে ধারণ করছিলেন বিপ্লবের বারুদ। ইত্যাদি দেখে-শুনে-পড়ে আমাদের মনে হয়েছিল, পৃথিবী সাম্যবাদের দিকে বাঁক নেবে। আসলে তা হয়নি। একবিংশ শতাব্দীতে পৃথিবী ঘোরতর ঘুরে গেছে ডানদিকে। রাষ্ট্রপুঞ্জ যেদিন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছিল, তার এক সপ্তাহের মধ্যেই ইজরায়েলি বাহিনী গুঁড়িয়ে দিয়েছে গাজার হাসপাতাল— আল শিফা। রাশিয়া অবলীলায় বোমা ফেলেই চলেছে ইউক্রেনে। দিল্লির রাস্তায় একজন মুসলিম, নামাজ পড়তে শুরু করলে আগ্রাসী হয়ে ওঠে তাঁর দেশেরই পুলিশ। এই দীর্ঘায়িত অসাম্যের দুনিয়ায় রাকেশ শর্মা কেন বললেন এ-কথা?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
পৃথিবীর দূরবর্তী গ্রহসমূহে যেন নরক নির্মিত না হয়! ধরা যাক, মঙ্গল গ্রহে যে বহুমূল্য খনিজের সন্ধান পাওয়া গেল, কিংবা চাঁদে উৎপাদিত ফসলের সমবণ্টন প্রয়োজন পৃথিবীর প্রতিটি দেশে। যে কোনও ঔপনিবেশিক ধারণা মাথায় গেঁথে, মহাকাশ-সংক্রান্ত গবেষণা অসম্ভব। অর্থাৎ মহাশূন্যে, অনন্তে, সাম্যবাদের প্রাথমিক চিন্তাগুলি যদি ছড়িয়ে যায়, তবে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে আমাদের পৃথিবীই! মানবজাতি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
মহাকাশ নয়, সামান্য ‘বার্ডস আই ভিউ’ থেকেই যদি আমাদের চারপাশে তাকাই, দেখব, পৃথিবী অগাধ। একই তো মানুষ। একই তো শ্রম। ঘামও এক। রক্তও। রক্তের অন্তর্গত লোহিত রক্তকণিকা বা শ্বেত রক্তকণিকা– সেগুলোও আলাদা নাকি! মানচিত্রে যা-কিছু বিভেদ, যা-কিছু বর্ডার– আদতে তৈরি করেছে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের খিদের জন্যেই প্যালেস্তাইনে মৃতের সংখ্যা ৩২ হাজার। রাষ্ট্রের খিদের জন্যেই চালু হল, সিএএ। মোক্ষম প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে, ‘আপনার দেশ কোথায়?’ এবং রাষ্ট্রের খিদের জন্যেই ভারতবর্ষ আজ অসাম্যের তালিকায় ফার্স্ট!
দেশের মোট সম্পদের ৪০.১% শীর্ষ এক শতাংশ ধনীর জিম্মায়। অর্থনৈতিকভাবে যে অসাম্য তৈরি হবেই, সমগ্র ভারতে, সেটায় কোনও সন্দেহ আছে কি? এখানেই প্রসঙ্গ তৈরি হয় ব্যক্তিগত সম্পত্তির। এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে বইতে থাকে। আড়েবহরে বৃদ্ধিও পায় বটে। সেটাই ব্যক্তিগত সম্পত্তির মৌলিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য!
কার্ল মার্কসের চিন্তাবলি নিয়ে রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের একটি লেখার কথা বলি। তিনি প্রশ্ন তুলছেন, ‘‘মার্কস-এর চিন্তায় ‘ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপ’-এর প্রয়োজনীয়তা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে? তার কারণ এই: ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিলোপ না-হওয়া পর্যন্ত শ্রমের সঙ্গে মানুষের বিচ্ছেদ কিছুতেই ঘুচবে না। একমাত্র তার ভেতর দিয়েই মানব সমাজ তার প্রকৃত সত্তা ফিরে পাবে, অনন্বয়মুক্ত হবে।’’
অনন্বয়মুক্ত হয়নি। তাই দরিদ্রের ওপর করের বোঝা ধনীর চেয়ে অধিক। আর কী আশ্চর্য! যতদিন সমাজে এই অসাম্যের অস্তিত্ব, ততদিন সাম্যের প্রতি আমাদের আকাঙ্ক্ষাটিও চিরন্তন। তবে কি সাম্য এবং অসাম্যের সহাবস্থান? তবে কি সমাজে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হলেই কেল্লাফতে? সে-সবের উত্তর খুঁজতে চাইছে না এ-লেখা। রাকেশ শর্মার কথানুসারে, এ-লেখা বুঝতে চাইছে, সাম্যবাদের ধারণা পৃথিবী ছাড়িয়ে মহাকাশে পৌঁছেছে। একটা মহাজাগতিক চিন্তায় পরিণত হয়েছে সে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: লাদাখে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদের মোকাবিলা করতে সমতলের পদ্ধতি চলবে না
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এই পোড়া ধরাধামে অসাম্য সর্বত্র। অর্থে। ধর্মে। লিঙ্গে। বর্ণে। জাতে। এবং ভাতেও! উগ্র হিন্দুত্ববাদ যেমন ফ্যাসিজিমে পরিণত হয়ে, প্রতিটি মানুষের সমানাধিকারের গোড়ায় আঘাত করতে চাইছে! যেমন বিভ্রান্তিকর সিনেমা তৈরি করে অসাম্যের জন্ম দিচ্ছে মননে! তেমন এও তো ঠিক যে, আমরা বিশ্বাস করছি– আজকের নিপীড়িত শ্রেণি একদিন মাথা তুলে দাঁড়াবে। সেজন্যেই এত ঢাকঢোল পিটিয়ে ভোট হবে। এও তো এক ধরনের সমান অধিকারেরই নিদর্শন। সাম্যের প্রক্রিয়া! সে কারণেই আল মাহমুদের কবিতায় যেন ধ্রুবতারার মতো ফুটে থাকে একটি লাইন: ‘আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন।’
ফিরে আসি রাকেশ শর্মার কথায়। বলছেন, ভেদাভেদ মুছে আমরা বাইরে বেরতে অক্ষম। পৃথিবীর মানচিত্র রক্তমাখা। একদল অত্যাচার করবে। একদল মুখ বুজে অত্যাচার সহ্য করবে। তাই বিশ্বসম্পদ সমবণ্টিত হয়নি কখনও। তিনি চাইছেন, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সম্পদের সুষম বণ্টন। এক অসাম্যের পৃথিবীতে বেঁচে, একজন মহাকাশচারী সাম্যবাদের কথা বললেন। সাম্যবাদের স্বপ্ন যেমন মাটিতে, ভূ-মণ্ডলে! সেই ভীষণ স্বপ্ন পাড়ি দিয়েছে মহাকাশেও। স্বপ্নউড়ানের সাক্ষী– রাকেশ শর্মা। প্রথম ভারতীয়। ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে নিশ্চয়ই। রাষ্ট্রনায়কেরা লক্ষ্য রাখছেন তো?
প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশের সময় সম্পাদকের বক্তব্য ছিল কিঞ্চিৎ দ্বিধাজড়িত। একটি পৃথক গ্রন্থ হিসাবেই সংখ্যাটিকে ভাবছিলেন তাঁরা। সম্পাদকের নিবেদনে সেই সংশয় স্পষ্ট– ‘আগামীবারে এই বই আরও বিরাট আকারে বাহির করিবার ইচ্ছা রহিল।... তবে এর সাফল্যের সবটাই নির্ভর করিতেছে চিত্র-প্রিয়দের সহানুভূতির উপর।...’