ঠিক ১০০ বছর আগের কথা। মোহান্ত সতীশ গিরির জীবনযাত্রা ছিল এক বিলাসী বিত্তবান জমিদারের মতো। তারই অনুষঙ্গে ছড়াতে থাকে তাঁর ইন্দ্রিয়লোলুপতার নানা নিদর্শন। একটি বিজ্ঞাপন ছড়িয়ে পড়ে নানা জায়গায়, প্রধানত দু’টি ঘটনার প্রসঙ্গে। জনৈক পশ্চিমাবাসী তীর্থযাত্রী তারকেশ্বরে এলে মোহান্ত তাঁদের রাত্রিবাসের ব্যবস্থা করে দেন। রাতের বেলায় মোহান্ত কৌশলে সেই যাত্রীকে ডেকে অন্য ঘরে নিয়ে গিয়ে তাঁর স্ত্রীকে কুপ্রস্তাব দেন। স্ত্রীলোকটি কোনও ক্রমে আত্মমর্যাদা রক্ষা করেন এবং মোহান্তের দুষ্কর্মের কথা ছড়াতে শুরু করে। অপর এক ঘটনায় এক মাড়োয়াড়ি যুবতী মোহান্তের বাড়ি থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। সে নিয়েও অনেক হইচই শুরু হয়
৮.
সারা ভারতে শিবের মন্দিরের সংখ্যা অগুনতি। তার মধ্যে ১২টি শিবলিঙ্গ জ্যোতির্লিঙ্গ রূপে খ্যাত। শঙ্করাচার্য সারা ভারতের শৈবতীর্থ ঘুরে ঘুরে যে-যে মন্দিরে বিশেষ ‘দর্শন’ ও অনুভূতি লাভ করেছিলেন, সেগুলিকে ‘জ্যোতির্লিঙ্গ’ স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। এগুলি হল কাশীর বিশ্বনাথ, হিমালয়ে কেদারনাথ, দ্বারকায় সোমনাথ, দারুকাবনে নাগেশ্বর, মহারাষ্ট্রে ভীমাশঙ্কর, ঘৃষ্ণেশ্বর, মহাকাল, ওঙ্কারেশ্বর, ত্র্যম্বকেশ্বর, হায়দরাবাদের কাছে শ্রীশৈলে মল্লিকার্জুন ও দাক্ষিণাত্যে রামেশ্বর। এছাড়াও ভারতের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে আছে অগণিত শিবমন্দির বেশ অনেক কাল ধরেই। দক্ষিণবঙ্গের অন্যতম শৈবতীর্থ তারকেশ্বরে দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে না পড়েও দীর্ঘকাল ধরেই অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য এক শৈবতীর্থ।
শিব যে অনার্য দেবতা– সেকথা সকল পণ্ডিতই মেনে নিয়েছেন। দক্ষের বৈদিক যজ্ঞে শিবের নিমন্ত্রণ পাওয়ার কথাই নয়, কিন্তু তাই বলে একসভা লোকের সামনে তাঁর ব্যাপক নিন্দায় খেপে শিবশক্তি মিলে যে মহাপ্রলয় সৃষ্টি করেছিলেন সেটিকে আর্য-অনার্য সংঘাত বলেও মান্যতা দিয়েছেন পণ্ডিতরা। অনার্য ব্যাপ্ত ভারতে আর্যজাতির অনুপ্রবেশ একসময় অনার্য দেবতাদের সেই সভ্যতার অঙ্গীভূত করতে উঠে-পড়ে লাগেন। বেদে তাই শিবের প্রতিপক্ষ, না কি অনুকৃতি রুদ্র– এ নিয়েও মতভেদ আছে। পুরাণের জন্মকালে এক সমন্বয়ের চেষ্টা চলে সেই দ্বন্দ্বের অবসান ঘটাতে। এই আত্তীকরণের পদ্ধতিটি বহুবিধ সুবিধার ব্যবস্থা করেছিল সামগ্রিকভাবে সমাজ ব্যবস্থাপনায় সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা ব্রাহ্মণকুলের পক্ষে। ভারতের বহু মানুষ আর্যসভ্যতার গুঁতোয় ব্রাহ্মণ্যবাদের অনেক কিছুই যেমন উপরোধে গিলে নেন, তেমনই অনার্য দেবতাদের পরিপূর্ণ বিনাশ ঘটাতে ব্যর্থ হয়ে তাঁদের ব্রাহ্মণ্যকুলে অভিবাসন করে তাঁদের পূজার্চনাও অধিকারভুক্ত করে নেওয়া অধিকারের পরিসর ও কলা-মুলোর বাজারক্ষেত্র বেশ অনেকটাই বিস্তৃত করা সম্ভবপর হয়। ঠিক এমনটাই দেখা যাবে তারকেশ্বরের তারকনাথের পূজাধিকারের বেলায়।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
১৮২৪ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তৎকালীন মোহান্ত শ্রীমন্ত গিরিও এক বেশ্যার উপপতি খুনের দায়ে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হন। আর ১৮৭৩ সালে তৎকালীন মোহান্ত মাধব গিরি ষোড়শী এলোকেশীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লে এলোকেশীর স্বামী নবীনচন্দ্র তাঁর স্ত্রীর শিরোচ্ছেদ করে। সব জানাজানি হলে শেষে মোহান্তের জেল হয়ে যায়। এই ঘটনা জনমানসে যে সাংঘাতিক আলোড়ন তুলেছিল– তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। একাধিক বই, বটতলা থেকে, একাধিক নাটক বাংলার রঙ্গমঞ্চে, কালীঘটের পটচিত্রে প্রকাশিত হয়। হই হই পড়ে যায় গোটা ভারতে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ভারামল্ল রাজার এক বিশাল গো-ভাণ্ডার, আর সেই বিশাল গো-কুলের পালক মুকুন্দ ঘোষ নামের এক গোপ সন্তান। রাজার গোবাহিনীর অন্যতম ভারতী গাই সদ্য বাছুর বিইয়েছে, তাই তার যত্ন খানিক বেশি। কিন্তু মুকুন্দ দেখল ভারতী রোজ বনের মধ্যে হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে যায়, তারপর যখন ফিরে আসে তখন, তার বাঁটে দুধের সামান্যও মেলে না। রহস্যের উৎস খুঁজতে মুকুন্দ একদিন চুপিসারে ভারতীর অনুবর্তী হয়ে দেখে বনের মধ্যে এক কালো পাথরের কাছে দাঁড়ালেই ভারতীর বাঁট বেয়ে দুধের ধারা নামে, তারপর বেশ খানিক বাদে দুধের সবটুকু উজাড় করে ভারতী ফিরে আসে। কালো পাথরের কাছে গিয়ে মুকুন্দ বুঝতে পারে, ওটি আসলে লিঙ্গরূপী শিব। শিবের নানা স্তুতি করে অবশেষে মুকুন্দ তাঁর দর্শন লাভে সমর্থ হলেন। তিনি জানালেন,
আমার বচন শুন, এই যে লিঙ্গের গুণ তোমা হইতে হইবে প্রকাশ।
করিব রোগের নাশ, পুরাইব অভিলাষ ভক্তি মতে ফল দিব তার।।
তারপর ভারামল্লকে জানালে তিনি চাইলেন বনের মধ্যে থেকে শিবলিঙ্গ তুলে এনে রামনগরে মন্দির গড়ে প্রতিষ্ঠা করবেন। সেই মতো মাটি খোঁড়া শুরু হল, কিন্তু কিছুতেই শিবের তলদেশ পাওয়া গেল না। তারপর স্বপ্নে রাজা জানলেন,
তারকেশ্বর শিব আমি কাননে বসতি।
অবনী ভেদিয়া বাছা আমার উৎপত্তি।।
অকারণ দুঃখ পায়া মোরে কেন খোঁড়।
গয়া গঙ্গা বারানসী আদি মোর জড়।।
বাধ্য হয়েই ভারামল্ল সেই বনের মধ্যেই গড়ে তোলেন তারকেশ্বর শিবের মন্দির। আর মুকুন্দ হলেন তাঁর প্রথম ও প্রধান সেবক। কিন্তু সে কবে? আর সেই নিয়েই ঘনিয়ে উঠেছে নানা সন্দেহ, বিতর্ক। ‘হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ’ বইয়ের লেখক সুধীর কুমার মিত্রের মতে, তারকেশ্বরের মন্দির তৈরি হয় ১৭২৯ খ্রিস্টাব্দে। ‘তারকেশ্বর শিবতত্ত্ব’ বইতে টীকা রচনায় শিবেন্দু মান্না মন্তব্য করেছেন, তারকেশ্বরের মন্দির প্রতিষ্ঠা, “শঙ্করাচার্যের পদাঙ্ক অনুসরণকারী ‘গিরি’ সম্প্রদায়ভুক্ত দশনামী” সন্ন্যাসীদের ওই মন্দিরের দায়িত্ব গ্রহণ সম্পর্কে লোকশ্রুতিই ভরসা। নির্দিষ্টভাবে কোনও তথ্য লিখিতভাবে কোথাও উল্লেখিত ছিল না। সতীশ গিরি ১২৯৯ সনে মঠাধীশ হওয়ার পরে ‘তারকেশ্বর শিবতত্ত্ব’ রচনা করেন ও ১৩২৮ সনে সেটি প্রকাশিত হয়। লক্ষণীয় হল, সেখানেও উপাদান হল লোককাহিনি, মিথ ইত্যাদি। যদিও কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ তাঁর আত্মপরিচয় দিতে গিয়ে লিখেছেন, রাজা ভারামল্লের কাছ থেকে তিনটি গ্রাম পেয়ে বসবাস করতে থাকেন, এবং তারপরে রচনা করেন তাঁর ‘মনসার ভাসান’ কাব্য। সেই অনুযায়ী অনুমান করা যায়, ১৬৪০ খ্রিস্টাব্দের পরেই ভারামল্ল ওই জমি দান করেছিলেন এবং তার পরে পরেই কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ মনসার ভাসান রচনা করেন। আবার তারকেশ্বর সংক্রান্ত এক মামলায় মায়া গিরিকে দেওয়া ভারামল্লের এক দানপত্রের তারিখ ৭৮৫ সম্বত বলে দেখানো হলে আদালত মনে করে আদতে ওটি ১৭৮৫ সম্বত বা ১৭২৮ খ্রিস্টাব্দ হওয়া উচিত ছিল, কৌশলে সেটির তারিখ বদল করা হয়। দীনেশ ভট্টাচার্য এই গোটা দানপত্রটিকেই ‘কৃত্রিম’ বলে দাবি করেছেন।
বিতর্ক কি শুধু একটাই? গোপ বা গয়লা সম্প্রদায়ের আবিষ্কৃত তারকেশ্বর শিবের অধিকার দৈব আদেশে হস্তান্তরিত হয় চতুর্ভূজ গঙ্গোপাধ্যায় নামের ‘রাঢ়ী ব্রাহ্মণ’-এর হাতে, আবার কিছুদিন পরে সেটি সেই দৈব আদেশেই চলে যায় দশনামী সম্প্রদায় ভুক্ত ‘গিরি’ সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীদের হাতে। এত দৈব আদেশের সমাপতন অবশ্যই চমৎকৃত করে বইকি! তারপর ধরা যাক, বহু চর্চিত মোহান্ত এলোকেশীর কেলেঙ্কারি বিতর্ক। তারও আগে ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তৎকালীন মোহান্ত শ্রীমন্ত গিরিও এক বেশ্যার উপপতি খুনের দায়ে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হন। আর ১৮৭৩ সালে তৎকালীন মোহান্ত মাধব গিরি ষোড়শী এলোকেশীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লে এলোকেশীর স্বামী নবীনচন্দ্র তাঁর স্ত্রীর শিরশ্ছেদ করে। সব জানাজানি হলে শেষে মোহান্তের জেল হয়ে যায়। এই ঘটনা জনমানসে যে সাংঘাতিক আলোড়ন তুলেছিল– তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। একাধিক বই, বটতলা থেকে, একাধিক নাটক বাংলার রঙ্গমঞ্চে, কালীঘটের পটচিত্রে প্রকাশিত হয়। হইহই পড়ে যায় গোটা ভারতে।
আবার সংবাদের শিরোনামে আসে তারকেশ্বর ১৯২৪ সালে। মোহান্ত সতীশ গিরির জীবনযাত্রা ছিল এক বিলাসী বিত্তবান জমিদারের মতো। তারই অনুষঙ্গে ছড়াতে থাকে তাঁর ইন্দ্রিয়লোলুপতার নানা নিদর্শন। একটি বিজ্ঞাপন ছড়িয়ে পড়ে নানা জায়গায়, প্রধানত দু’টি ঘটনার প্রসঙ্গে। জনৈক পশ্চিমাবাসী তীর্থযাত্রী তারকেশ্বরে এলে মোহান্ত তাঁদের রাত্রিবাসের ব্যবস্থা করে দেন। রাতের বেলায় মোহান্ত কৌশলে সেই যাত্রীকে ডেকে অন্য ঘরে নিয়ে গিয়ে তাঁর স্ত্রীকে কুপ্রস্তাব দেন। স্ত্রীলোকটি কোনও ক্রমে আত্মমর্যাদা রক্ষা করেন এবং মোহান্তের দুষ্কর্মের কথা ছড়াতে শুরু করে। অপর এক ঘটনায় এক মাড়োয়াড়ি যুবতী মোহান্তের বাড়ি থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। সে নিয়েও অনেক হইচই শুরু হয়। মোহান্তের দুষ্কর্ম আর অত্যাচারের প্রকোপ থেকে তারকেশ্বরকে রক্ষা করার ডাক দিয়ে আন্দোলন শুরু হয়, নরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় ও ধরানন্দ ভট্টাচার্য, পরে দুই পাঞ্জাবি সন্ন্যাসী বিশ্বানন্দ ও সচিদ্দানন্দ সেই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে থাকেন। ‘যেখানেই অন্যায় সেখানেই সত্যাগ্রহ’ এই নীতিতে বাংলার প্রথম সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু হয় তারকেশ্বর মন্দির ঘিরে।
এত বিতর্ক সত্ত্বেও তারকেশ্বর মন্দির ও তারকনাথ দেবতা বাঙালির মাত্র নয়, সারা ভারতের শৈব ও অশৈব সকল সম্প্রদায়ভুক্ত হিন্দু ভক্তমাত্রেরই অতি গুরুত্বপূর্ণ এক তীর্থস্থান। প্রতি বছর চৈত্রমাসে গাজন আর নীলের উৎসবে অগণিত ভক্তদের ভিড়ে পরিপূর্ণ থাকে তারকেশ্বর। আবার গোটা শ্রাবণ মাস, বিশেষ করে প্রতি সোমবার– দূরদূরান্ত থেকে যাত্রীরা পায়ে হেঁটে, বাঁকে করে জল নিয়ে ‘বাবা’র মাথায় ঢেলে দিতে আসেন। এই একটি মন্দির গোটা তারকেশ্বর অঞ্চলের অর্থনীতিকেই গড়ে দিয়েছে, ঠিক যেমন নিয়ন্ত্রণ করেছে এলাকা মানুষের সমাজ ও ধর্মীয় জীবনকে।
…পড়ুন তীর্থের ঝাঁক-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৭। বামাক্ষ্যাপার টানে তারাপীঠে এসেছিলেন বিবেকানন্দ, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ
পর্ব ৬। তান্ত্রিক, কাপালিক এবং ডাকাতদের থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কালীঘাটে পুজো দিতেন যাত্রীরা
পর্ব ৫। কপিলমুনির আশ্রম খুঁজে না পেয়ে ‘শতমুখী’ হয়েছিল গঙ্গা
পর্ব ৪। কোন উপায়ে লুপ্ত বৃন্দাবনকে ভরিয়ে তুললেন রূপ-সনাতন?
পর্ব ৩। পুত্র রাম-লক্ষ্মণ বিদ্যমান থাকতেও পুত্রবধূ সীতা দশরথের পিণ্ডদান করেছিলেন গয়ায়
পর্ব ২। এককালে শবররা ছিল ওড়িশার রাজা, তাদের নিয়ন্ত্রণেই পুজো পেতেন জগন্নাথদেব
পর্ব ১। ছোটবেলায় ছবি দেখেই কাশীধামে যাওয়ার কথা ভেবেছিলেন ম্যাক্সমুলার সাহেব
প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশের সময় সম্পাদকের বক্তব্য ছিল কিঞ্চিৎ দ্বিধাজড়িত। একটি পৃথক গ্রন্থ হিসাবেই সংখ্যাটিকে ভাবছিলেন তাঁরা। সম্পাদকের নিবেদনে সেই সংশয় স্পষ্ট– ‘আগামীবারে এই বই আরও বিরাট আকারে বাহির করিবার ইচ্ছা রহিল।... তবে এর সাফল্যের সবটাই নির্ভর করিতেছে চিত্র-প্রিয়দের সহানুভূতির উপর।...’