আটটি প্রবন্ধ এবং আটটি সাক্ষাৎকার– দু’য়ে মিলে অনির্বাণ ভট্টাচার্যের এই ‘ষোলো কলাম’। যেন জীবন নামক স্টেশনের দুই প্ল্যাটফর্ম, যেখানে অতীত ও বর্তমান সমান্তরাল ভাবে বয়ে চলে। প্রবন্ধ এবং সাক্ষাৎকারের মূল সুর এক তারে বাঁধা। ইতিহাসের পর্যালোচনা এবং ইতিহাস বিকৃতির যে ধারা, ব্যক্তি ও সমাজকে কীভাবে গিলে খায়, সেই নির্মম সত্যকে প্রতিবাদ ও প্রতিস্পর্ধার দৃষ্টিকোণে হাতড়ে দেখতে প্রত্যয়ী ‘ষোলো কলাম’।
রুহিতন কুরমির কথা আপনাদের মনে আছে? সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখেছিল যে রুহিতন। যার বোধের আয়নায় ধরা পড়ে এক বিশেষ ভূখণ্ডের, এক বিশেষ শ্রেণির মানুষের ক্রমবিবর্তনশীল সার্বিক ইতিহাস। গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার সেই বুক ভরা স্বপ্নকে সে বাস্তবায়িত করতে পারেনি। আরও হাজার হাজার রুহিতনের মতোই হারিয়ে গিয়েছিল সেই স্বপ্ন, কোনও অন্ধ কারাগারের গোপন কুঠুরিতে। ‘মহাকালের রথের ঘোড়া’ উপন্যাসে এভাবেই রুহিতন চরিত্রকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন সমরেশ বসু। জেল এবং সাত বছর আগের ও পরের নকশালবাড়ি এলাকা ও সংলগ্ন গ্রাম। তার মাঝে একটা থমকে পড়া জীবন– রুহিতনের। যার প্রতিবাদ রাজনৈতিক ভাবে ব্যর্থ, পারিপার্শ্বিক মানুষজনের কাছে সে ‘দয়ার পাত্র’!
অনির্বাণ ভট্টাচার্যের লেখা ‘ষোলো কলাম’ পড়তে বসে আচমকাই মনে পড়ে গেল রুহিতনের কথা। প্রায় ৪৮ বছর আগে উপন্যাসের চরিত্রকে যেন খুঁজে পাই পুরুলিয়ার ভিতরের এক গ্রামে, পরমেশ্বর শিকারির বেশে। না, রুহিতনের মতো সমাজ বদলের স্বপ্নে ঝাঁপিয়ে সে পড়েনি, বরং তার লড়াই একান্তই ব্যক্তিগত অস্তিত্বরক্ষার। সেই পরমেশ্বরবাবুকে কি আমরা চিনি? দৈনিকপত্রের রোজনামচায় কয়েক কলাম ‘খবর’ হয়েই হয়তো সে ধামাচাপা পড়ে গিয়েছে আজকের পৃথিবীতে। তাকে মনে করা দুষ্কর। যেমন রুহিতনের মতো অনেক মুখ জ্বলে উঠেও বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। ‘ষোলো কলাম’-এর লেখক সচেতনভাবেই সেই ছিন্নমূল জীবনকে দেখতে চেয়েছেন সময়ের প্রেক্ষাপটে। যে সময় বর্তমানে দাঁড়িয়ে অতীতকে মনে করায়। আর জাগিয়ে তোলে এক হতাশার উপলব্ধি, যেখান থেকে লেখকের আক্ষেপ মিলে যায় পাঠকের চেতনায়– ‘আমাদের আসলে কিছু হবে না। হাঁটছি, চলছি এই সময়ে, কিন্তু সারাক্ষণই বাঁচছি সেই পুরনো সময়ে, ফিরতে চাইছি ফেলে আসা সময়ে। তাই আমরা ঘুরপাক খেয়ে যাই শুধুই। আমাদের গল্প, আমাদের আক্ষেপ শেষ হয় না তাই কখনও।’ চারপাশের এই অস্থির পরিস্থিতি জমাট বেঁধেছে এ গ্রন্থে। অচেনা পরমেশ্বর শিকারির মতোই সেখানে ভিড় করে এসেছে রোহিত ভেমুলার সুইসাইড নোট, বিলকিস বানোর ‘অপরাধী’দের মুক্তির মতো চেনামুখের কথা।
আটটি প্রবন্ধ এবং আটটি সাক্ষাৎকার– দু’য়ে মিলে অনির্বাণ ভট্টাচার্যের এই ‘ষোলো কলাম’। যেন জীবন নামক স্টেশনের দুই প্ল্যাটফর্ম, যেখানে অতীত ও বর্তমান সমান্তরাল ভাবে বয়ে চলে। প্রবন্ধ এবং সাক্ষাৎকারের মূল সুর এক তারে বাঁধা। ইতিহাসের পর্যালোচনা এবং ইতিহাস বিকৃতির যে ধারা, ব্যক্তি ও সমাজকে কীভাবে গিলে খায়, সেই নির্মম সত্যকে প্রতিবাদ ও প্রতিস্পর্ধার দৃষ্টিকোণে হাতড়ে দেখতে প্রত্যয়ী ‘ষোলো কলাম’। এক বিপন্ন বাস্তবের মধ্যে যে আমরা এগিয়ে চলেছি, এর থেকে মুক্তির কোনও উপায় নেই, সেই অস্বস্তিকে জাগিয়ে দিয়ে ‘প্রকৃত বাঁচা’র অর্থ কী, সেই অনুসন্ধানের সামনে পাঠককে দাঁড় করিয়েছেন লেখক।
………………………………………..
এক তাজা প্রাণের আত্মহত্যা, যা নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা দেশকে, সেই আত্মহননের বয়ানকে অনুবাদ করে পাঠককে গ্রন্থপাঠের শুরুতেই এক কর্কশ বাস্তবের মুখোমুখি করেছেন লেখক। বইয়ের ভূমিকা অংশে অন্তরের যে ক্রোধের কথা তুলে ধরেছেন তিনি, তার প্রতিফলন দেখা যায় ‘বিলকিস বানো, প্রথম রাজনৈতিক হত্যা এবং…’ প্রসঙ্গে। ইতিহাসকে বিকৃত করার প্রয়াস, একটা অল্টার-ট্রুথ নির্মাণ করার অভিসন্ধি যে সমাজকে ঘুণপোকার মতো কুরেকুরে খাচ্ছে ক্রমাগত, তাকে চোখে আঙুল দিয়ে লেখক দেখিয়েছেন ‘ষোলো কলাম’-এর প্রবন্ধ পর্যায়ের।
………………………………………..
এ আলোচনার শুরুতে পরমেশ্বর শিকারির কথা উল্লেখ করেছিলাম, তা দিয়েই ‘ষোলো কলাম’-এ প্রবন্ধপাঠে দাঁড়ি টেনেছেন লেখক, সেই প্রবন্ধের শুরু রোহিত ভেমুলার সুইসাইড নোট থেকে। এক তাজা প্রাণের আত্মহত্যা, যা নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা দেশকে, সেই আত্মহননের বয়ানকে অনুবাদ করে পাঠককে গ্রন্থপাঠের শুরুতেই এক কর্কশ বাস্তবের মুখোমুখি করেছেন লেখক। বইয়ের ভূমিকা অংশে অন্তরের যে ক্রোধের কথা তুলে ধরেছেন তিনি, তার প্রতিফলন দেখা যায় ‘বিলকিস বানো, প্রথম রাজনৈতিক হত্যা এবং…’ প্রসঙ্গে। ইতিহাসকে বিকৃত করার প্রয়াস, একটা অল্টার-ট্রুথ নির্মাণ করার অভিসন্ধি যে সমাজকে ঘুণপোকার মতো কুরেকুরে খাচ্ছে ক্রমাগত, তাকে চোখে আঙুল দিয়ে লেখক দেখিয়েছেন ‘ষোলো কলাম’-এর প্রবন্ধ পর্যায়ের।
এর পাশে সাক্ষাৎকার অংশ গ্রন্থের আকর্ষণীয় অপর দিক। যেখানে গতানুগতিকতা নেই, বরং রয়েছে এক বিশেষ আবহ, যা মান্যতা দেয় প্রবন্ধে লেখকের বক্তব্যকে। চন্দ্রিল ভট্টাচার্যের সাক্ষাৎকারে লেখক বুঝে নিতে চান ‘চন্দ্রবিন্দু’র সময় যাপনকে, সমাজকে দেখার অভিপ্রায়কে। যেখানে সচেতন ভাবেই চন্দ্রিল ভট্টাচার্য স্বীকার করে নেন, এই দুর্দশাগ্রস্ত পৃথিবী আর কোনও দিন ভালোর দিকে যাবে না! বরং উত্তরোত্তর খারাপের দিকে যাবে। অর্থাৎ ক্ষয়িষ্ণু এই সমাজজীবনে আশাবাদের, ইতিবাচক মনোভাবের বাণী শোনানোর দায় ‘চন্দ্রবিন্দু’র নেই। ঠিক একইভাবে মধ্যবিত্তের সংকট এবং গণ আন্দোলন যে ক্রমশ তার চরিত্র বদলে ব্যক্তিস্বার্থে পরিণত হয়েছে, সেই আক্ষেপ ধরা পড়েছে একান্ত আলাপচারিতায়, সুধীর মিশ্রের গলায়। ‘হাজারোঁ খোয়াইশেঁ অ্যায়সি’র রূপকারকে বলতে শোনা যায়– ‘এখন যারা লড়ছে, লড়াইটা আদতে তাদেরই। মানে যারা খাচ্ছে খাঁড়ার ঘা, তারাই হাতে তুলে নিচ্ছে অস্ত্র।… আর এখন তো ভারত ভেঙে গিয়েছে এক গাদা আন্দোলনে। ছোটো ছোটো অজস্র লড়াই।’ সেই লড়াইয়ের অভিপ্রায় সাধারণের চোখে কেমন করে ধরা দেবে, তার সূত্র যেন বেঁধে দেন অভিনেতা অনির্বাণ ভট্টাচার্য, সমনামীর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে।
প্রশ্ন এবং প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে সতর্ক-উত্তরের মাপা গণ্ডি ভেঙে লেখক এভাবেই সচেষ্ট হয়েছেন সাক্ষাৎকার-দাতার মন ও মানসিকতাকে তুলে ধরতে। ঠিক একইভাবে ইতিহাস সচেতনতায় খুঁড়ে দেখতে চেয়েছেন নেহরু-সুভাষ প্রসঙ্গকে, রজন্তকান্তি রায়ের সঙ্গে আলাপে। রোহিত ভেমুলা থেকে সনাতম ধর্ম, ‘চন্দ্রবিন্দু’র সমাজবীক্ষা থেকে দেবজ্যোতি মিশ্রের চোখে রবিশঙ্কর– নানা বিষয়-প্রবাহে ‘ষোলো কলাম’ ভাবনার স্রোতকে জারিয়ে দিতে চেয়েছে তার সিঁড়ি-ভাঙা ঘাটে। আসলে ইতিহাস বিকৃতিকে ‘ধ্রুব’জ্ঞানে স্বীকার করে নেওয়াটা যতই চেনা হোক, তা আসলে ন্যুব্জ মানসিকতা, আপসশীল মনোভাবের পরিচয় বহন করে। সেই লজ্জার বিপ্রতীপে দাঁড়ানোটাই প্রতিবাদের মূল লক্ষ্য। সেই অভিপ্রায়ে লেখক অনির্বাণের ‘ষোলোকলা’ম পূর্ণ।
ষোলো কলাম
অনির্বাণ ভট্টাচার্য
এবং অধ্যায়
২৭৫ টাকা