বইটির লেখক অম্বরীশ রায়চৌধুরী বলেছেন, তিনি শ্রীদেবীর বায়োগ্রাফি লিখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু শ্রীদেবী সম্পর্কে কথা বলতে চায়নি অনেকেই।
শ্রীদেবী যে সময়ে বলিউডে পদার্পণ করেন, সেটা হিন্দি ছবির জন্য খুব একটা ভাল সময় ছিল না। আর ঠিক সেই সময়ে আমরাও বড় হচ্ছি। দূরদর্শনে দেখা কিছু গান মনে ধরে গিয়েছিল। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই ‘মেরে হাথো মে’, ‘হাওয়া হাওয়াই’, ‘মোরনি বাগামা’ খুব জনপ্রিয় ছিল আমাদের মধ্যে। বৃষ্টিতে স্বচ্ছ রেনকোট পরে শ্রীদেবীর নাচ, ‘না জানে কাহা সে আয়ি হ্যায়’ (ছবি: চালবাজ), এই গানটা আমার নিজের খুব প্রিয় ছিল। বিশেষ করে ‘কিসিকে হাথ না আয়েগি ইয়ে লড়কি’– এই লাইনটার জন্যই বোধহয়। অম্বরীশ রায়চৌধুরির সদ্য প্রকাশিত বই ‘শ্রীদেবী: দ্য সাউথ ইয়ার্স’ পড়তে গিয়ে গানের এই লাইনটাই বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল। ভূমিকায় অম্বরীশ উল্লেখ করেছেন, তিনি বায়োগ্রাফি লিখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু শ্রীদেবী সম্পর্কে কথা বলতে চায়নি অনেকেই। তাঁরা হয়তো সেভাবে বলতেও পারতেন না, কারণ এই বই থেকেই জানা যায় অভিনেত্রী প্রাইভেট পার্সন ছিলেন। একেবারেই সোশালাইজ করতেন না। চার বছর বয়স থেকে ক্যামেরার সামনে আসা শ্রীদেবীকে নিজের সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন করা হলে (২০১২) তিনি নিজেও খুব একটা পরিষ্কার করে বলতে পারেননি। ‘আই ফিল ইট হ্যাজ টু ডু উইথ দ্য ফ্যাক্ট দ্যাট আই স্টার্টেড অ্যাক্টিং হোয়েন আই ওয়াজ টু ইয়াং টু ইভেন রিয়ালাইজ হোয়াট ইট ওয়াজ’, বলেছিলেন অভিনেত্রী। ফিল্ম ক্রিটিক ভরদ্বাজ রঙ্গন এই বইয়ের ভূমিকায় বলেছেন, ‘হাউ ডু ইউ ওপেন আপ টু দ্য রিডার, দ্য ইনার ওয়ার্কিংস অফ সামওয়ান হু নেভার ওপেনড আপ টু এনিওয়ান?’ শ্রীদেবীর জীবনের মতো তাঁর মৃত্যুও যেন এক ধাঁধা। লেখকের কাজটা সহজ ছিল না বোঝাই যাচ্ছে।
‘শ্রীদেবী: দ্য সাউথ ইয়ার্স’ অভিনেত্রীর কেরিয়ারের গোড়ার কথা– চাইল্ড অ্যাক্টর থেকে অভিনেত্রী হওয়া এবং যথাক্রমে স্টার হয়ে ওঠার যাত্রাপথ নথিভুক্ত করে। রিসার্চ-ভিত্তিক এই বইয়ে শ্রীদেবীর তেলুগু, তামিল, মলয়লম এবং কন্নড় ছবির রেখাচিত্র তৈরি করেছেন লেখক। দক্ষিণের বড় বড় পরিচালক এবং সুপারস্টার অভিনেতার সঙ্গে তাঁর কাজের ম্যাপ তৈরি করেছেন বলা যায়। শ্রীদেবীর সহ-অভিনেতা ছিলেন দক্ষিণের প্রভাবশালী সব অভিনেতা। শিবাজী গণেশন, এম.জি.আর, জেমিনি গণেশন, এ.এন.আর, সুপারস্টার কৃষ্ণা, জয়ললিতা, অঞ্জলি দেবী, শোকার জানকি, কমল হাসান, রজনীকান্ত, চিরঞ্জীবী, নাগার্জুন, ভেঙ্কটেশ এবং অন্যান্য। তথ্যের সঙ্গে রয়েছে সেইসব অসংখ্য ছবি সম্পর্কে একটি ধারণা। যাতে বুঝতে সুবিধা হয় অল্প বয়সেই শ্রীদেবী কত রকমের চ্যালেঞ্জিং চরিত্রের মুখোমুখি হয়েছিলেন, যেটা বলিউডে পা দেওয়া মাত্রই কমে এসেছিল। শ্রীদেবীর হিন্দি ছবিগুলো বেশিরভাগই ‘মশলা এন্টারটেনার’, যেখানে অভিনয়ের সুযোগ কম। আছে গ্ল্যামারাস, ‘ডিভা’ শ্রীদেবীর উদ্যাপন, যা নাচ-গানে ভরপুর। বইয়ে ‘কমল হাসান’-এর লেখা ভূমিকা থেকে জানা যায় কীভাবে ছোট্ট শ্রীদেবী বাধ্য ছাত্রীর মতো প্রায় তোতাপাখি হয়ে সব নির্দেশ পালন করতেন। পরিচালক বালাচন্দরের তত্ত্বাবধানে কমল হাসান, শ্রীদেবীর ফিল্ম সেটের শিক্ষক ছিলেন। আমরা শ্রীদেবী-কমল হাসানের জুটির ‘সদমা’ ছবিতেই সীমাবদ্ধ থেকেছি। কিন্তু দক্ষিণে এই পার্টনারশিপের গুরুত্বপূর্ণ ছবির তালিকা এবং বর্ণনা রয়েছে এই বইয়ে। ক্যামেরার সামনে কাঁদুনে বাচ্চার চরিত্রে শ্রীদেবী ঠোঁট ফুলিয়ে দারুণ কাঁদতে পারতেন। পড়তে গিয়ে অবাক হয়ে যেতে হয় যখন দেখি, ১৯৭০ সালে সুপারস্টার কৃষ্ণার মেয়ের চরিত্রে শ্রীদেবী, ১৯৭৫ সালে বোনের চরিত্রে এবং ১৯৭৯ সালে মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে অন্তরঙ্গ দৃশ্যে অভিনয় করেন ‘আলিয়াঙ্গনম’ ছবিতে। মাত্র ১৪ বছর বয়সে রজনীকান্তের সঙ্গে ‘গায়ত্রী’-র মতো ডার্ক ছবিতে অভিনয় করেন, যেখানে শ্রীদেবীর নায়ক রজনীকান্ত এই ছবিতে ব্লু ফিল্ম প্রোডিউসারের চরিত্রে। রজনীকান্তের সঙ্গে শ্রীদেবী ১৮টি ছবি করেছেন, কমল হাসানের সঙ্গে ২৭টি এবং তিনজনে একসঙ্গে বেশি কিছু ছবিতে অভিনয় করেছেন। এই বই পড়তে গিয়ে বোঝা যায় খুব তাড়াতাড়ি শৈশবের দিন পেরিয়ে যৌবনে পা দিয়ে ফেলতে হয়েছিল অভিনেত্রীকে। এইরকম নানা তথ্যে ভরপুর অম্বরীশের এই বই।
কখনও কখনও মনে হয়েছে এই বইয়ে শ্রীদেবীর দক্ষিণের ছবি, তাঁর পরিচালক এবং সহ-অভিনেতা সম্পর্কে অনেক বেশি কথা রয়েছে, অভিনেত্রী শ্রীদেবীর চেয়ে। বেশিরভাগ চ্যাপ্টার শুরু হচ্ছে শ্রীদেবীর কেরিয়ারের উল্লেখযোগ্য পরিচালক, প্রযোজক বা অভিনেতাদের দিয়ে। পড়তে গিয়ে মাঝে মাঝে গতি শ্লথ হয়, খেই হারিয়ে যায়। শ্রীদেবীর সম্পর্কে বলতে গিয়ে ‘Histrionics’ শব্দটি বারবার ব্যবহার করেছেন লেখক, বিশেষ করে চাইল্ড অ্যাক্টর শ্রীদেবীর ক্ষেত্রে। বোঝা যায়, তখনকার অভিনয়ের ভাষায় মেলোড্রামার চল অনেক বেশি ছিল। তবে এই একটি শব্দে ‘এনিগম্যাটিক’ শ্রীদেবীকে ধরে রাখা মুশকিল। শ্রীদেবী অভিনীত ছবির টাইমলাইন, ছবির গল্প এবং নানা ব্যক্তিত্বের মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যে লেখা হয়েছে বইটি। তাই অনেক সময় মনে হয়েছে, তাঁদের মতামত এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা যেন বেশি প্রাধান্য পেয়ে যায় তুলনামূলকভাবে। তবে একটা আখ্যান বারবার উঠে আসে, সেটা হল শ্রীদেবীর অধরা ব্যক্তিত্ব, যা রহস্যে মোড়া। এবং সেই রহস্যের উদ্ঘাটনে অম্বরীশ কখনও ফ্যানবয়, কখনও অ্যানালিস্ট! যাঁরা শ্রীদেবীর দক্ষিণের ছবির কথা জানতে চান, তাঁরা এই বই পড়তে পারেন।