‘জলপাই কাঠের এসরাজ’ কাব্যগ্রন্থটি বের হয় ১৯৮০ সালের এপ্রিলে। আজ পর্যন্ত এই বই মোট চারবার প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত লেখা কবিতা আছে এই কাব্যগ্রন্থটিতে। ফুলস্কেপ কাগজের একটি পাতায়, সিগারেটের রাংতার পিছনে, ক্যালেন্ডারে পিছনে বা ছেড়া কাগজের টুকরোয়, যেখানেই লিখি, ভাঁজ করে কিছুদিন পকেটে নিয়ে ঘুরতাম আমি, বন্ধুদের পড়াতাম, বিশেষত কয়েক নির্দিষ্টজনকে। তারপর রেখে দিতাম জুতোর বাক্সে। ১৯৭৮ এর শেষে সারারাত জেগে আমার দুই বন্ধু রানাঘাট ও শিবপুরের– দু’টি বাক্স উপুড় করে বেছে দেন কবিতাগুলি। তৈরি হয় পাণ্ডুলিপি।
পুস্তিকাকে যদি ‘বই’ হিসেবে ধরি, না, না, আমি গ্রন্থট্রন্থ বলে নিজের ওই শীর্ণ পুস্তিকাটিকে দাবি করছি না, কিন্তু যদি বলি, নিজের লেখালিখি নিয়ে প্রথম কী প্রকাশিত হয়েছিল, তাহলে তা ওই পুস্তিকা। এবং তাহলে সেটা– বই!
আমার পাঠক-পাঠিকা, আমি জানি, তাঁরা আঙুলে গোনা। তাঁদের কয়েকজন মনে হয় ভাবেন, আমার প্রথম বই ‘জলপাই কাঠের এসরাজ’, কবিতার বই। তা নয়, তা নয়। আমার প্রথম বই গল্পের। তিনটি গল্প ছিল তাতে। সেই তিনটি গল্পের বইটির নাম ছিল, ‘আমি আর পিপি’। সেটাই আমার প্রথম বই। টুক করে তাহলে প্রথম বইটির কথা একটু বলে নিই।
১৯৮০ সালে প্রকাশিত ‘জলপাই কাঠের এসরাজ’ আমার পয়লা বা প্রথম কবিতার বই হিসেবে বের হলেও, প্রকাশ কালের হিসেবে আমার গল্পের বইটি ‘আমি আর পিপি’ বের হয়েছিল আগে, ১৯৭৭ সালের মার্চের পর, জরুরি অবস্থার অন্তে। গল্প তিনটি রচিত হয়েছিল ১৯৭৬ সালের অক্টোবরে একটি, ওই বছর ডিসেম্বরে দ্বিতীয়টি, তৃতীয়টি ১৯৭৭ সালে ফেব্রুয়ারিতে। জরুরি অবস্থা বলবৎ ছিল তখন।
ঘোর জরুরি অবস্থাতেই আমাদের শ্রীরামপুরের লাগোয়া শেওড়াফুলি থেকে আমার বন্ধু শ্যাম ভাওয়াল ও শ্যামলেন্দু বিশ্বাস বের করত ‘সংবর্ত’ নামে একটি লিটিল ম্যাগাজিন। সেসময় পত্রপত্রিকাগুলি ঝুঁকিপূর্ণ স্বাধীনতায় মশগুল ছিল। তবে আমার ওই তিনটি গল্প বৈপ্লবিক ছিল না।
১৯৭৬ সালের অক্টোবর ও ওই বছর ডিসেম্বরে আমার ওই প্রথম ও দ্বিতীয় গল্প– এই দু’টি গল্প লিখিত হওয়ার পরপরই ‘সংবর্ত’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। হয়েছিল কী, আমি কবিতাই লিখে যাচ্ছিলাম। ১৯৭৬ সালের ওই পুজোর সময় ‘সংবর্ত’ ছাপতে গিয়ে দেখা গেল শেষ ফর্মাটিতে শেষের তিন-চারটি পাতা ফাঁকা থেকে যাচ্ছে। লেখা নেই। সম্পাদক শ্যামদা, শ্যাম ভাওয়াল বললেন, তুই একটা গল্প লিখে দে। ঠিক পারবি, লেখ। সারা রাত জেগে গল্পটি লিখে ফেললাম।
সে সময় একটি সিগারেট বাজারে বের হয়েছিল, পার্সোনাল প্রেফারেন্স। সংক্ষেপে, পিপি। আমার ওই তিনটি গল্পেই কল্পিত প্রেমিকার নামটি দিয়েছিলাম পিপি। প্রথম গল্পে পিপি খচর মচর চিবিয়ে খেয়ে ফেলছে আমাকে, আমিও চুষে-চেটে-কামড়িয়ে খেয়ে ফেলছি তাকে। প্রথম ও দ্বিতীয় গল্প দু’টি বের হয় সংবর্ত পত্রিকার, তৃতীয় গল্পটি বের হয় আমার বন্ধু পল্লব বন্দ্যোপাধ্যায় (অকাল প্রয়াত) সম্পাদিত ‘বেলাভূমি’ পত্রিকায়। এর মাস খানেকের পর নিজের উদ্যোগে পুস্তিকাকারে বের করি ‘আমি আর পিপি’। বছর খানেক পর আমার ওই গল্পগুলি সম্পর্কে কী যেন এক বিরক্তি জেগে ওঠে। আমি ওই গল্পবই বা পুস্তিকাটিকে আড়াল করতে থাকি, মনোনিবেশ করি কবিতায়। গল্পের বইটিকে পাঠিয়ে দিই জঙ্গলে। জন্তু-জানোয়ারের তাড়া খেয়ে হাড়গোড় ভেঙে পড়ে আছে সে বই কোথাও, হয়তো। কিংবা বাঁশ পাতার ছায়া পড়া তিরতির কোনও নদীর কালোসবুজ জলে সাঁতরে বয়ে যাচ্ছে।
এবার আমার দ্বিতীয় বই ‘জলপাই কাঠের এসরাজ’ নিয়ে বলি, এই কাব্যগ্রন্থটি বের হয় ১৯৮০ সালের এপ্রিলে। আজ পর্যন্ত এই বই মোট চারবার প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত লেখা কবিতা আছে এই কাব্যগ্রন্থটিতে। ফুলস্কেপ কাগজের একটি পাতায়, সিগারেটের রাংতার পিছনে, ক্যালেন্ডারে পিছনে বা ছেড়া কাগজের টুকরোয়, যেখানেই লিখি, ভাঁজ করে কিছুদিন পকেটে নিয়ে ঘুরতাম আমি, বন্ধুদের পড়াতাম, বিশেষত কয়েক নির্দিষ্টজনকে। তারপর রেখে দিতাম জুতোর বাক্সে। ১৯৭৮-এর শেষে সারারাত জেগে আমার দুই বন্ধু রানাঘাট ও শিবপুরের– দুটি বাক্স উপুড় করে বেছে দেন কবিতাগুলি। তৈরি হয় পাণ্ডুলিপি। চাকরি পেলে টাকা জমিয়ে তিন ফর্মার বই হবে– এরকমটি ভেবেছিলাম আমি। ১৯৭৮ সালেই চাকরি পাই আমি। মাইনে পেয়ে সব টাকাই সংসার খরচে বাবাকে দিতাম আমি। তা থেকে হাত খরচের টাকা দিত বাবা। তা থেকে কিছু কিছু টাকা বই ছাপার জন্য জমাতাম আমি। যে হিসেব হয়েছিল তাতে ১৯৮০ সালের গোড়ায় টাকা জমল অর্ধেকটি। হঠাৎ ওই সময় সিঁথি থেকে এল একটি ছেলে, সবে কলেজে ভর্তি হয়েছে সে। প্রকাশক হতে চায় সে। বলল, বাকি টাকা সে দেবে, ‘জলপাই কাঠের এসরাজ’ বের করবে। নির্মল বলল, ‘চল, পূর্ণেন্দু পত্রী প্রচ্ছদ এঁকে দেবেন।’ কিন্তু আমি শুনলাম আর্ট কলেজ থেকে তাঁর ছেলে পুণ্যব্রত পাস করেছে। আমি বললাম, ‘পুণ্য আঁকবে প্রচ্ছদ।’
………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………….
বের হল ‘জলপাই কাঠের এসরাজ’। ৪ টাকা দামের ৪০০ বই। সিঁথির ছেলেটি আমাকে ২০০ বই দিল, নিজে নিল ২০০। বছর দুয়েকে ২০০ বই বইমেলা ও কলেজ স্ট্রিটে বিক্রি করে আমাকে রয়্যালটিও দিল সে। এমনটি আর পরে সে থাকেনি। প্রকাশক হিসেবে বিবিধ তার তৎপরতা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কৃত্তিবাস’ এখন তার হস্তগত। সুনীল শক্তি-সহ কৃত্তিবাসীরা সকলেই প্রয়াত। সুনীল অনুরাগীরা অনেকেই এখন লেখেন ওই জাল কৃত্তিবাসে।
… দ্বিতীয় বই-এর অন্যান্য লেখা …
অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়-এর লেখা: আমায় ডিরেক্টর বানিয়েছে আমার আদরের দ্বিতীয়
স্বপ্নময় চক্রবর্তী-র লেখা: হলদে গোলাপ নয়, নবম পর্ব-ই তোমার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস, বলেছিলেন বুদ্ধদেব গুহ
রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়-এর লেখা: আমার সমস্ত ভয়েরিজম নিয়েই দ্বিতীয় বইতে নিজের প্রেমপত্রটি রেখেছি
মন্দাক্রান্তা সেন-এর লেখা: অবাধ্য হৃদয়ের কথা অন্যভাবে বলতে চেয়েছিলাম আমার দ্বিতীয় বইয়ে
অনিতা অগ্নিহোত্রী-র লেখা: পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ শুধু নয়, বহু অনাগত উপন্যাসের সম্ভাবনাও ছিল ‘বৃষ্টি আসবে’ বইটিতে
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved