কোথাও বাঙালির প্রশংসার ছলে নিন্দা, কোথাও বা তার আত্মবিস্মৃতি নিয়ে ৩২টা ফুল দিয়ে মালা গেঁথেছেন মৃদুল পাঠক। বাঙালির ইংরেজিপনা, বাঙালির দ্বিচারিতা, পরনিন্দা পরচর্চা, বাঙালির কবিতা, বাঙালি এবং কলকাতার বাণিজ্য, অর্থনৈতিক গতিশীলতা, বাঙালি নামক প্রাণী ৩০০ বছর পরে ডাইনোসর হবে কি না– এরকম হাজারো কথার বুনটে তৈরি এই বই।
বাঙালি ঠিক কাকে বলে বলুন তো? বিদেশ-বিভুঁইয়ে এক বাঙালির অপর বাঙালিকে দেখে ‘আপনি বাঙালি!’ বলে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে ওঠা? না কি নতুন ক্যালেন্ডার হাতে পেলেই আগে দেখে নেওয়া দুর্গাপুজো এবার ঠিক কোন তারিখ পড়েছে! পয়লা বৈশাখ এবং ২৫ বৈশাখ নিয়ে মাতামাতি। রবীন্দ্রনাথ নিয়ে অধিকারবোধ। প্রেমে ল্যাং খেয়ে দু’-কলম কবিতা বা গান লিখবে না, এমন বাঙালি আছে? বাঙালি হলে বা বাঙালি হতে গেলে কী কী বৈশিষ্ট্য প্রয়োজন– তাই নিয়ে একখান বই লিখেছেন মৃদুল পাঠক– ‘বাঙালি হতে হলে’। বাঙালির ইংরেজিপনা, বাঙালির দ্বিচারিতা, পরনিন্দা-পরচর্চা, বাঙালির কবিতা, বাঙালির এবং কলকাতার বাণিজ্য, অর্থনৈতিক গতিশীলতা, বাঙালি নামক প্রাণী ৩০০ বছর পরে ডাইনোসর হবে কি না– এরকম হাজারো কথার বুনটে তৈরি এই বই।
কথায় বলে, বাঙালি ধর্মেও আছে, জিরাফেও আছে। সমাজদর্শনের আরশিতে বাঙালি-সত্তাকে তুলে ধরেছেন লেখক। এই বইয়ে কোনও চিরাচরিত নিয়মে সূচিপত্র নেই। ব্যাক কভারে একযোগে বিষয়ের তালিকা সাজানো রয়েছে। ৩২টা গদ্য-সারণিতে ছবির পাশে পাশে লেখা। পড়ে ফেলা যাবে নিমেষে। মজার প্রচ্ছদ। প্রচ্ছদ-শিল্পী কাজল চক্রবর্তী। প্রকাশক ‘সম্পর্ক’। দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় যা দেখেছেন লেখক, যা বুঝেছেন, তাই-ই মজার মোড়কে তুলে ধরেছেন। ‘সড়ক ছাপ’ আড্ডা থেকে বিশ্বময় বিভিন্ন সামাজিক স্তরে মেলামেশা করেছেন। সেই অভিজ্ঞতার সঞ্চয় এই লেখা।
বাঙালি বিজ্ঞ এবং সর্বজ্ঞ। তার জ্ঞানের ভাণ্ডার অসীম। পাড়ার চা-দোকানের আড্ডা থেকে কফি হাউস– জ্ঞান বিতরণ উপচে পড়ে। আবার, সুযোগ বুঝে বাঙালি বাঙালিরই পশ্চাতে কাঠি করতে ওস্তাদ। যে কোনও টপিকে তার অবদান অনস্বীকার্য। ‘সবজান্তা’-এ লেখক লিখছেন, ‘নোবেলজয়ী, প্রায় ফসকে যাওয়া নোবেলপ্রার্থী, পৃথিবীর প্রায় সব সমস্যার সমাধানে কোনও না কোনও বাঙালির নাম খুঁজে বের করে দেবে, সে প্রাগৈতিহাসিক যুগে হোক, ঔপনিবেশিক যুগে হোক, কী স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে, সাহিত্য হোক, ধর্ম হোক, বিজ্ঞান, শিল্প– সবেতেই প্রতিভাশালীদের ছড়াছড়ি।’ হক কথা। এই যে চন্দ্রযান ৩-এর সফল অবতরণ হল, সেই বিজ্ঞানীদের ভিড়ে ঠিক বাঙালি খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। তাই নিয়ে আমরা যথেষ্ট গর্বিত। অথচ ভাত-খেকো বাঙালি জাপানিরা রাইস কুকার বানাবে, এই অপেক্ষায় কেন বসে রইল বলুন তো? আবার অনেক সময় কোনও একজন ব্যক্তিবিশেষকে তার আশপাশের মানুষজন এমন তোল্লাই দেয়, যে কোনও ব্যাপারে– বাড়ির গাছ থেকে শরীরের খুঁটিনাটি ব্যামো– পরামর্শ নেওয়ার জন্য হাপিত্যেশ করে, তাতে কী হয়, সেই ব্যক্তিবিশেষের অদৃশ্য চারটে ডানা গজায়। কাজেই লেখক বাঙালির সবজান্তা মনোভাব সম্পর্কে যা ব্যক্ত করেছেন, তা যথার্থই।
বাঙালি খেতে ভালবাসে। সকালে চা-টোস্ট, এখন ওট্স। দুপুরে একটু পেটপুরে খাওয়া। শরীর ফিট রাখতে কবজি না ডুবিয়ে কিছু মানুষ এখন এক-আঙুল সমান খায়। মনকে জবাই করে, মেপে খেয়ে জীবন অনেকটাই ফিকে তাদের। কী করা যাবে– স্বাস্থ্যই সম্পদ। ভাত খেলে মেদ বাড়ে। সন্দেশ-রসগোল্লা বাদ। অথচ ‘বাচ্চারা ম্যাগি খাচ্ছে, পিজা-বার্গার-মোমো-র ছড়াছড়ি।’ ‘খাদ্যরসিক’ বাঙালির তরকা-রুটি, মাটন কষা, এগ রোল জিন্দাবাদ। সবাই একমত: কলকাতা স্ট্রিট ফুডের রাজধানী। রাস্তার রগরগে চাউমিন থেকে পাইস হোটেলে ২০-৩০ টাকায় পেটভরা খাবার। এ বঙ্গ ছাড়া এত সস্তায় আর কোথাও সম্ভব? মাদ্রাজিরা ইডলি, দোসা বাড়িতে খায়, অতিথি এলে তাদেরও দেয়। পাঞ্জাবিরা বাইরে গিয়েও রুটি, ডাল, তন্দুরি, কাবাব খায়, বাড়িতেও তাই। কিন্তু আমরা তা পারি না। আমাদের বাড়িতে কোনও অবাঙালি বন্ধু এলে, তাদের রুটি, তরকা, দোসা, সম্বর খাওয়াই। পারি না মাছের ঝোল-ভাত করে খাওয়াতে।
‘বাঙালি মরণকালেও ভোলে না বলতে, কোন কলেজে পড়েছে, কোন চাকরিতে কোন পদে ছিল।’ টাকাপয়সার মুখ দেখে ফেললে সবার আগে সে তার সাবেক বাড়ি ফেলে কলকাতা বা অন্য বড় শহরে পাড়ি দেয়। “চুলোয় যাক বিদ্যাবুদ্ধি, ওই ঘুপচি বাড়ির সংস্কার করা যায় নাকি। আধুনিক বাড়িতে বসে ‘হতদরিদ্র’ বাঙালির কী করা উচিত, তাই সযত্নে whatsapp-এ জ্ঞান বিতরণ করি।” ‘একে একে নিভিছে দেউটি’। বাঙালি-সমাজের বাস্তব চিত্রই তুলে ধরেছেন লেখক।
কথা দিয়ে কথা রাখলে বাঙালি হওয়া যায় না। সমাজের সব স্তরে একই কেস। রাজনীতিবিদদের কথা অবশ্য বাদ দিন। ‘ওটা ওদের Professional Ethics’. সাফ কথা। তাই না লেখক লিখলেন, ‘মরদ কি বাত, হাতির দাঁত’। সবাই কথা দেয়, কিন্তু রাখে ক’জন!
বাঙালি নাকি কালিদাস! ‘গাছের যে-ডালে বসা, সেই ডাল কাটা’। ‘বাবাকে বলে দিলাম, করব না। বসকে শুনিয়ে দিয়েছি। …বন্ধুদের বনভোজন– ওমুক সমস্ত খরচা bear করবে? বলেছে? কী ভাবে নিজেকে? পয়সা দেখাচ্ছে। যাবই না। করতেই দেব না।’ আগু-পিছু না ভেবে শুধু বাঙালির গালভরা ‘না’। বাঙালির নিজের কোনও দোষ নেই। ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’। সবই পলিটিক্স। বাঙালির শুধু একটাই দোষ– খালি অভিযোগ। সে করুক। একমাত্র বাঙালিরাই এগিয়ে আসবে আপনাকে আপনার রাস্তা দেখিয়ে দিতে!
এইভাবে কোথাও বাঙালির প্রশংসার ছলে নিন্দা, কোথাও বা তার আত্মবিস্মৃতি নিয়ে ৩২টা ফুল দিয়ে যেন মালা গেঁথেছেন মৃদুল পাঠক। আত্মসমালোচনা থাকলেও বাঙালির গরিমাকে অবশ্য নীচে টেনে নামানোর প্রয়াস করেননি লেখক।
বাঙালি হতে হলে
মৃদুল পাঠক
সম্পর্ক। মূল্য ২২৫্